বরিশাল-ঢাকা নৌরুটে আগামীকাল বুধবার থেকে নিয়মিত যাত্রী পরিবহন শুরু করবে দেশের সর্ববৃহৎ যাত্রীবাহী অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর বিলাসবহুল লঞ্চ কীর্তনখোলা-১০। বরিশালের টাইটানিকখ্যাত কীর্তনখোলা-১০ লঞ্চ নয় যেন পাঁচ তারকা হোটেল।
Advertisement
তবে আনুষ্ঠানিকভাবে লঞ্চটি উদ্বোধন হবে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে। দেশের সর্ববৃহৎ লঞ্চটির নির্মাণকাজ শেষে প্রায় ৯০ ঘণ্টারও বেশি সময় নদীতে চালিয়ে দেখা হয়েছে।
বুধবার রাতে কীর্তনখোলা-১০ লঞ্চ বরিশাল থেকে যাত্রী নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যাবে। এর অধিকাংশ কেবিন ইতোমধ্যে বুকিং হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন মালিক পক্ষ। প্রথম যাত্রায় যাত্রীদের চমকে দেয়ার পাশাপাশি লঞ্চে ভ্রমণে নতুন রেকর্ড গড়তে যাচ্ছে কীর্তনখোলা-১০।
এমভি কীর্তনখোলা-১০ লঞ্চের নির্মাতা দেশের অন্যতম আধুনিক ও বিলাসবহুল নৌযান প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান সালমা শিপিং কর্পোরেশন।
Advertisement
সালমা শিপিং কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মঞ্জুরুল আহসান ফেরদাউস বলেন, প্রায় ৯০ ঘণ্টারও বেশি সময় নদীতে চালিয়ে ইঞ্জিনের পরীক্ষা করা হয়েছে। কোনো ত্রুটি ছাড়াই সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে লঞ্চটি। বুধবার থেকে নিয়মিত বরিশাল-ঢাকা নৌরুটে যাত্রী পরিবহন শুরু করবে কীর্তনখোলা-১০। তবে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ঢাকার সদরঘাটে জমকালো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে লঞ্চটির উদ্বোধন হবে।
অত্যাধুনিক লঞ্চটি নিয়ে মানুষের আগ্রহের কমতি নেই। লঞ্চটি নির্মাণ হয়েছে বরিশাল নগরীর কীর্তনখোলা নদীর তীরে বেলতলা ফেরিঘাট এলাকায় বাগেরহাট শিপ বিল্ডার্স নামের একটি ডকইয়ার্ডে। সেখানে প্রতিদিনই ভিড় করছে উৎসুক মানুষ।
মঙ্গলবার দুপুরে কীর্তনখোলা-১০ লঞ্চটি ঘুরে দেখা যায়, যাত্রীদের আকৃষ্ট করতে লঞ্চে প্লে-গ্রাউন্ড, ফুড কোড এরিয়া, বিনোদন স্পেস, বড় পর্দার টিভি, অত্যাধুনিক সাউন্ড সিস্টেম, ইন্টারকম যোগাযোগের ব্যবস্থা, উন্মুক্ত ওয়াইফাই সুবিধাসহ রয়েছে বিভিন্ন বিনোদনের ব্যবস্থা।
অভিজাত শ্রেণির বিলাসি যাত্রীদের জন্য লঞ্চটিতে রয়েছে ১৭টি ভিআইপি কেবিন। কেবিনগুলো বানানো হয়েছে বিলাসবহুল আবাসিক তিন তারকা হোটেলের আদলে। ব্যয়বহুল ও দৃষ্টিনন্দন আসবাবপত্রে সাজানো প্রতিটি কক্ষ। প্রতিটি কেবিনের সঙ্গে রয়েছে সুবিশাল বারান্দা। এখানে বসে নদী, পানি, আকাশ আর আশপাশের মনোরম প্রকৃতি দেখার ব্যবস্থা রয়েছে। কক্ষের ভেতরে রয়েছে এলইডি টিভি। রিভার সাইটের কেবিনের ভেতর থেকেও সহজেই দেখা যায় বাইরের নয়নাভিরাম দৃশ্যাবলি। লঞ্চের করিডরগুলোতে রয়েছে নান্দনিক ডিজাইন। নকশা ও কারুকাজ যে কারো মন কাড়বে। ভিআইপি ও কেবিন যাত্রীদের জন্য রয়েছে আলাদা সুসজ্জিত খাবার হোটেল।
Advertisement
এছাড়া দুই হাজার যাত্রী ধারণক্ষমতা সম্পন্ন লঞ্চটিতে রয়েছে ৭০টি ডাবল ও ১০২টি সিঙ্গেল কেবিন। চারতলা লঞ্চটির ডেকের যাত্রীদের জন্য যাত্রা আরামদায়ক করতে নিচতলা ও দোতলায় রয়েছে মসৃণ কার্পেট। আলোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে অত্যাধুনিক ডিজিটাইল লাইট। বিনোদনের জন্য তৃতীয় শ্রেণির যাত্রীদের জন্য থাকছে বড় পর্দার টিভি এবং অত্যাধুনিক সাউন্ড সিস্টেম। খাবার জন্য কেন্টিন ও পর্যাপ্ত টয়লেট ব্যবস্থা রাখা হয়েছে লঞ্চটিতে।
এছাড়া ডেকের যাত্রীদের জন্য রয়েছে মোবাইল চার্জের ১২৪টি পয়েন্ট। যেখানে ২৪৮টি মোবাইলে একসঙ্গে চার্জ দেয়া সম্ভব হবে। সর্ববৃহৎ যাত্রীবাহী এই জাহাজে রোগীদের জন্য থাকছে আইসিইউ, সিসিইউসহ মেডিকেল সুবিধা। যাত্রীদের নামাজের জন্য রয়েছে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত নামাজের স্থান। যেখানে একসঙ্গে ৩০ জন মুসল্লি নামাজ পড়তে পারবেন।
যাত্রীদের নিরাপত্তায় লঞ্চটিতে থাকবে একজন কমান্ডারসহ সহস্র আনসার সদস্য। পুরো লঞ্চটি ক্লোজসার্কিট ক্যামেরার আওতাভুক্ত। আধুনিক অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা ও পর্যাপ্ত লাইফ-বয়া রাখা হয়েছে।
লঞ্চটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান সালমা শিপিং কর্পোরেশনের সহকরী ব্যবস্থাপক (এজিএম) মো. রিয়াজুল করিম জানান, বিশেষজ্ঞ নৌ-স্থপতির নকশায় সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের প্রকৌশলীদের নিবিড় তত্ত্বাবধানে প্রায় দুই বছর ধরে কীর্তনখোলা-১০ লঞ্চের নির্মাণকাজ শেষ হয়। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৮০ জন শ্রমিকের নিরলস পরিশ্রমে লঞ্চটির নির্মাণকাজ শেষ হয়। ৩০০ ফুটেরও বেশি দৈর্ঘ্যের নৌযানটির প্রস্থ ৫৯ ফুট।
এছাড়া দুই শতাধিক টন পণ্য পরিবহনের সুবিধা রয়েছে নৌযানটিতে। জাপানের একটি কোম্পানির তৈরি ৩ হাজার ২০০ অশ্ব শক্তির দুটি মূল ইঞ্জিন ছাড়াও নৌযানটির বাতানুকূল প্রথম শ্রেণি ও ভিআইপি কক্ষসহ ডেক যাত্রীদের জন্য পর্যাপ্ত আলো ও বাতাস নিশ্চিতকরণে ৩টি জেনারেটরসহ আরও একটি স্ট্যান্ডবাই জেনারেটরও সংযোজন করা হয়েছে।
কীর্তনখোলা-১০ লঞ্চের হুইল হাউজে (চালকের কক্ষ) সম্পূর্ণ অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর যন্ত্রাংশ সংযোজন করা হয়েছে। এর রাডার-সুকান ‘ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক’ ও ম্যানুয়াল দ্বৈত পদ্ধতির। পাশাপাশি নৌযানটিতে আধুনিক রাডার ছাড়াও জিপিএস পদ্ধতি সংযুক্ত করা হয়েছে। ফলে লঞ্চটি চলাচলরত নৌপথের ১ বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে গভীরতা ছাড়াও এর আশপাশের অন্য যেকোনো নৌযানের উপস্থিতি চিহ্নিত করতে পারবে। এমনকি ঘন কুয়াশার মধ্যেও নৌযানটি নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারবে।
সালমা শিপিং কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মঞ্জুরুল আহসান ফেরদাউস বলেন, সালমা শিপিং কর্পোরেশনের এটি তৃতীয় লঞ্চ। কীর্তনখোলা-১০ লঞ্চটি তৈরির সময় যাত্রী ও নৌযানের নিরাপত্তার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। জাহাজ নির্মাণের অন্যতম কাঁচামাল ইস্পাতের তৈরি নতুন পাত আমদানি করা হয়েছে। এছাড়া ইঞ্জিন, প্রপেলারসহ সব কিছুই নতুন আমদানি করা হয়েছে। জাপানের তৈরি ৩ হাজার ২০০ অশ্ব শক্তির ২টি মূল ইঞ্জিনের কারণে লঞ্চটি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২৫ নটিক্যাল মাইল বেগে চলতে সক্ষম। আর লঞ্চটির ঝুঁকিমুক্ত চলাচলের জন্য জিপিআরএস সিস্টেম, রাডার, ইকোসাউন্ডার, এক জাহাজ থেকে একই কোম্পানির আরেক জাহাজে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের জন্য ভিএইচএফ এবং জাহাজের অভ্যন্তরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সার্বক্ষণিক কথোপকথনের জন্য ওয়কিটকির ব্যবস্থা রয়েছে। কয়েক স্তর বিশিষ্ট স্টিলের মজবুত তলদেশ থাকায় দুর্ঘটনায় তলদেশ ফেটে লঞ্চডুবির আশঙ্কা নেই। অর্থাৎ জাহাজটিতে সম্ভাব্য সব ধরনের প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা থাকবে।
ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মঞ্জুরুল আহসান ফেরদাউস বলেন, সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে পেশাদার ইন্টেরিয়র ডিজাইনারদের দিয়ে লঞ্চের কেবিন, করিডরসহ ভেতরের বিভিন্ন অংশে নান্দনিক ডিজাইন ও ডেকরেশন করানো হয়েছে। এসব নকশা ও কারুকাজ যে কারো মন কাড়বে। যাত্রীদের নিরাপত্তার স্বার্থে প্রথমবারের মতো বিদেশ থেকে আমদানিকৃত ব্রোঞ্জ ও সুসজ্জিত দরজার ব্যবস্থা করা হয়েছে। লঞ্চের কেবিনগুলো যে কোনো লঞ্চের কেবিন থেকে প্রশস্ত করা হয়েছে। এক একটি সিঙ্গেল কেবিনে দুইজন মানুষ অনায়াসে থাকতে পারবেন।
এছাড়া একজন চিকিৎসকসহ হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীদের জন্য লঞ্চে করোনারি কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ) ও নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রসহ (আইসিইউ) ৩ বেডের একটি মিনি হসপিটালের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। নতুন এই লঞ্চ যাত্রীদের ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নতুন একটা ধাপে নিয়ে যাবে। দুই বছর ধরে নির্মাণ করার পর সর্ববৃহৎ লঞ্চটি এখন নৌ-পথে যাত্রী পরিবহন করতে সক্ষম। আমরা আত্মবিশ্বাসী, এই সেবা যাত্রীদের চমকে দেবে। তবে নৌযানটি বিলাসবহুল হলেও ভাড়ায় তেমন পরিবর্তন হবে না। সব শ্রেণির যাত্রী ভাড়া অন্যসব নৌযানের মতোই থাকবে।
মো. মঞ্জুরুল আহসান ফেরদাউস বলেন, সবচেয়ে বেশি যাত্রী ধারণক্ষমতা সম্পন্ন ও আকারে বড় হওয়ার কীর্তনখোলা-১০ লঞ্চটি দেশের সর্ববৃহৎ যাত্রীবাহী বিলাসবহুল লঞ্চ। ভ্রমণ অভিজ্ঞতা বদলে দেবে লঞ্চটি।
তিনি বলেন, জাহাজ ব্যবসা ও নির্মাণ শিল্পে এখন মন্দা চলছে। বিলাসবহুল প্রযুক্তিনির্ভর লঞ্চটি নির্মাণে বিপুল অর্থের প্রয়োজন হয়েছে। অর্থ জোগাড়ে বিভিন্ন ব্যাংকে ধরনা দিতে হয়েছে। সহজ শর্তে ঋণ এবং সুদের হার কমানো হলে জাহাজ ব্যবসা ও নির্মাণ শিল্প এই অঞ্চলের মানুষের কর্মসংস্থানে বড় ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি জাহাজ ব্যবসা ও নির্মাণ শিল্প টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারিভাবে এই শিল্পকে সহায়তা করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
সাইফ আমীন/এএম/পিআর