মতামত

ড. জাফর ইকবালের বক্তৃতা ও আমাদের সভ্যতা

বুধবার ড. জাফর ইকবালের বক্তৃতা শোনার পর থেকে ভাবছিলাম লিখতে হবে। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনেছিলাম প্রায় ১৫ মিনিট। শেষ কবে এমন বিনয় দেখেছিলাম মনে নেই। বুঝতে পারছিলাম, টেলিভিশনে কারো বক্তৃতা শুনে আপ্লুত হওয়া মানায় না। বার্তাকক্ষে বসে তো নয়ই। কিন্তু আমার আপ্লুত না হয়ে উপায় ছিল না। কারণ এমন সহজ করে মনন ছোঁয়া কথা শোনা তো আজকাল ভাগ্যে জোটে না।

Advertisement

আপ্লুত হয়েও ভাবছিলাম ৬৬ বছর বয়সী এই মানুষটি যা বললেন, শুধু তাই নিয়ে নিজের প্রতিক্রিয়া লিখবো। পাঠকদের বলবো, অনুসরণ করার মত মানুষ এখনো আমাদের সামনে আছে। কিন্তু লিখতে বসার কিছুক্ষণ আগেই মত বদলাতে হলো। কারণ হঠাৎ সামাজিক যোগাগোগের মাধ্যমে দেখলাম মাহমুদুল হাসান নামে এক ব্যক্তির তথা কথিত ওয়াজ নামের হুঙ্কার।

যেখানে তিনি নিজস্ব ফর্মুলায় নাস্তিক চিহ্নিত করছেন এবং তাদের হত্যার ব্যাপারে উৎসাহ দিচ্ছেন। অগত্যা আমাকে চিন্তার গতি বদল করতে হলো। না করে উপায় কী, একদিকে মানুষের প্রতি ক্ষমা ও বিনয়ের বিশালতা অন্যদিকে সেই মানুষকেই কূপমণ্ডুকতার কৃষ্ণগহ্বরে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা। এড়িয়ে যাই কী করে?

শুরুতে একটু মন খারাপ হলেও, মনে হলো ভালই হলো, সুযোগ পাওয়া গেল খোলা এবং বদ্ধ চিন্তার মানুষের পার্থক্য দেখানোর। জাফর ইকবাল, বার বার বলছিলেন মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থে, বলা হয়েছে একজন মুসলমান একজনকে হত্যা করলো মানে গোটা জাতিকেই হত্যা করলো। আর একজন মানুষকে উদ্ধার করলো মানে গোটা জাতিকে উদ্ধার করলো। সেখানে মাহমুদুল হাসান, মানুষ হত্যার ব্যাপারে উৎসাহ দিচ্ছিলেন এবং এ ব্যাপরে বার মহানবী মোহাম্মদ (সঃ) এর উদাহরণ দিচ্ছিলেন ।

Advertisement

ধর্মীয় দর্শন ব্যাখ্যা করার মত জ্ঞান আমার নেই, যে কারণে এনিয়ে আামি কখনো কারো সঙ্গে তর্ক করি না। এ ক্ষেত্রেও করতে চাই না। শুধু বলতে চাই মোহাম্মদ (সঃ) এর কথা মনে করে, চোখ বন্ধ করতেই, চোখে ভাসে পথে কাঁটা বিছানো সেই বুড়ির কথা। যিনি প্রতিদিন কাঁটা বিছিয়ে রাখতেন রাস্তায়। এক দিন কাঁটা না থাকায় মহানবী ভাবলেন, আজ কাঁটা নেই তবে কি বুড়ি মা অসুস্থ ? তার পর খুঁজে সেই বুড়ির বাড়ি খুঁজে বের করলেন এবং তার খোঁজ নিলেন। এই বিনয়ে মুগ্ধ হয়ে বুড়ি মা সেদিন থেকেই অনুসারী হলেন মহানবীর ।

মহানবীর এমন বিনয়ের কথা রয়েছে গোটা ইসলামের ইতিহাস জুড়ে। অথচ মাহমুদুল হাসানের কথায় কোথাও বিনয় পেলাম না। বার বার তিনি যুদ্ধের কথা, হত্যার কথা বললেও, কোথাও মহানবীর শান্তি উদ্যোগের কথা বললেন না, ক্ষমা করার নজিরের কথা বললেন না, বললেন শুধু ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা। এরকম একটি লোকের মুখে ধর্মীয় কথা, কতটুকু ধর্মীয় তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এটা নিয়ে রীতিমত তদন্ত হওয়া দরকার।

পাঠক ভাবুন নাস্তিক বলে যে মানুষটির ওপর গত ৩রা মার্চ জেহাদি জোসে ঝাপিয়ে পড়লো ফয়জুল, সেতো এই মাহমুদুল হাসানদের অনুসারী। সেই মানুষটি সুস্থ হয়ে ফিরেই তাঁকে ক্ষমা করে দিলেন। বললেন, তার ওপর আমার কোন রাগ নেই। নানা মজা করে ক্ষুব্ধ ছাত্রদের সামনে বিষয়টি হালকা করার চেষ্টা করলেন। বোঝালেন, ছেলেটি যা করেছে ভুলবুঝে করেছে। এজন্যে তার প্রতি করুণাও প্রকাশ করলেন ।

ড. জাফর বার বার বলতে চাইছিলেন, যারা জঙ্গিবাদ এবং নাশকতার মধ্যে আছে তারা ভুল পথে আছে। তাঁর হত্যা চেষ্টাকারীদের সঙ্গে কথাও বলতে চাইলেন তিনি। এই যে উদারতা, এই যে পরিমিতি বোধ, এটা কোন মানুষের এক দিনে হয় না। দিনের পর দির চর্চা করে অর্জন করতে হয়। এর জন্যে অনেক ছাড় দিতে হয়। অনেক সহনশীলতারও ব্যাপারও আছে।

Advertisement

চার পাশের পরিবেশ থেকে নেয়া অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝতে পারি, এমন বিনয়ী আচরণ কেন আপ্লুত করে। খুব পরিষ্কার বোঝা যায়, আমরা বেশিরভাগ মানুষ কোন ছাড়ও দিতে পারি না, তাই সহনশীলও হতে পারি না। আসলে একারণেই জাফর ইকবালদের সঙ্গে আমার মত সাধারণ মানুষের পার্থক্য চকচক করে।

ধর্মের মত একটি সূক্ষঅনুভূতির বিষয় নিয়ে যখন মাহমুদুল হাসানরা সত্যের অপলাপ করেন, যথন মানুষ হত্যায় ঝাঁপিয়ে পড়ার হুঙ্কার দেন, তখন বুঝতে পারি ড. জাফর ইকবালকে আমাদের সমাজে কতটা দরকার। কারণ যুগে যুগে এরকম হুঙ্কার দিয়েছেন বহু মাহমুদুল, কিন্তু ড. জাফর ইকবালের মত মানুষরা আছেন বলেই কিছু মানুষ অন্ধ হয়ে যায়নি। এতে বেঁচে গেছে গোটা সমাজ।

যাই হোক আবারো ফিরছি ড. জাফর ইকবালের বিনয়ের কাছে। সেদিন তিনি যে ভাবে তার ওপর হামলাকারীদের তাঁর কাছে যেতে বলেছেন, তাতে কোটি কোটি মানুষ মুগ্ধ হয়েছে। কিন্তু আমাদের চিন্তার বিষয়, যাদের লক্ষ্য করে তিনি বলেছেন তারা কী বলছে, তারা কী কখনো নিজেদের এজেন্ডার বাইরে বুঝতে চাইবেন? অতীত ইতিহাস অনুযায়ী, তাদের বোঝার বাইরে, কেউ কিছু বললেই সে তো নাস্তিক। সঙ্গে সঙ্গেই চিৎকার, "ওর কল্লা নিয়ে নাও"। যেন এখানে ওরাই থাকবে।

সুতরাং বিনয়ী জাফর ইকবালের বিপদ কিন্তু কাটছে না। কারণ তাঁর কাছে যদি ওরা যায়ও, যাবে পেছনের দরজা দিয়ে। অস্ত্র নিয়েই যাবে। সত্যি বলতে কী, বিনয় মানুষকে মহান করে ঠিকই কিন্তু আমাদের মত ভারসাম্যহীন সমাজ ব্যবস্থায়, বিপদমুক্ত করে না।বিনয় এখানে গুণ নয়, একটা দোষ রীতিমত। সব বিনয়ী মানুষ যদি নিরাপদ হতো তাহলে, আমাদের সমাজকে আমরা সভ্য সমাজ বলতে পারতাম।

জাফর ইকবালের সঙ্গে কখনো কথা বলার সুযোগ হয়নি। কিন্তু তাঁর প্রকাশিত চিন্তা পড়েছি। আর সব শেষ দেখলাম সেই হাস্যোজ্জ্বল ১৫ মিনিট। এই দুই অভিজ্ঞতা মিলিয়ে বলতে চাই, স্যার, আমি মহা আস্তিক। তাই এখন থেকেই বিশ্বাস করতে শুরু করেছি, এভাবে হেসে হেসে, ক্ষমা করে সভ্য সমাজের দিকে এগোনো সম্ভব।

লেখক : বার্তা সম্পাদক একাত্তর টেলিভিশন। palash_ahasan2003@yahoo

এইচআর/জেআইএম