বিশেষ প্রতিবেদন

বিমান বিধ্বস্তের অফিসিয়াল স্কেচ কী বলছে?

নেপালের কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের বিএস-২১১ ফ্লাইটটি বিধ্বস্তের পর একটি তদন্ত কমিটি করে দেয় দেশটির সরকার। ইতোমধ্যে তদন্ত শুরু করেছে কমিটি। তদন্তের আগে রেফারেন্স হিসেবে সেদিনের একটি স্কেচ তৈরি করেছে তারা। তদন্ত কমিটির দুর্লভ সেই স্কেচটি জাগো নিউজ’র হাতে এসেছে। স্কেচটি তৈরিতে ত্রিভুবন বিমানবন্দরের রানওয়ে, এটিসি (এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল) টাওয়ার এবং এর আশপাশের এলাকার ৩০টি সিসিটিভি ক্যামেরা, স্যাটেলাইট ইমেজ, রাডার ইমেজ, ২৩ প্রত্যক্ষদর্শী (সাধারণ মানুষ), এটিসি টাওয়ারের কর্মকর্তা, বিমানবন্দরের রানওয়ে এলাকায় থাকা ২০ কর্মকর্তার দেয়া তথ্যের সহায়তা নেয়া হয়েছে।  স্কেচে দেখানো হয়েছে, অবতরণের অনুমতি না পেয়ে বিমানের ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতান রানওয়ে জিরো-টু (০২) থেকে ল্যান্ডিংয়ের জন্য রানওয়ে টু-জিরো (২০) নম্বরের দিকে এগিয়ে যান। এরপর তাকে টাওয়ার থেকে কিছুক্ষণ আকাশে উড্ডয়নের নির্দেশনা দেয়া হয়। টাওয়ারের সঙ্গে সম্মতি প্রকাশ করে কিছুক্ষণ রানওয়ে টু-জিরো’র (২০) বাম দিকে অরবিট তৈরি করে (গোল হয়ে ঘোরা) বিমানটি। কিছুক্ষণ পর বিমানটি রানওয়ে টু-জিরো’র (২০) ডানে চলে যান ক্যাপ্টেন। সেখানে একটি অরবিট তৈরি করেন। এরপর চূড়ান্তভাবে তাকে জিরো-টু (০২) রানওয়েতে অবতরণের অনুমতি দেয়া হয়।

Advertisement

রানওয়ে টু-জিরো’র (২০) কাছ থেকে জিরো-টু (০২) তে যাওয়ার সময় ‘নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে’ হঠাৎ কাত হয়ে যায় বিমানটি। বিমানবন্দরের কিউ’য়ে দাঁড়িয়ে থাকা দুটি বিমানের মাঝামাঝি এবং টাওয়ারের কাছে এসে কাঁপতে শুরু করে কানাডিয়ান কোম্পানি বোমবারডিয়ার তৈরি ড্যাশ-৮ বিমানটি। স্কেচ অনুযায়ী, বিমানের সঙ্গে টাওয়ারের দূরত্ব যখন মাত্র ৫০ ফিট, তখন টাওয়ার থেকে বলা হয়, ‘বাংলাস্টার-২১১! আই সে এগেইন, টার্ন। (বাংলাস্টার-২১১! আমি আবারও বলছি, ঘুরে যাও।)’ এরপর টাওয়ার থেকে বিমানটি বামে ঘুরিয়ে রানওয়ের ওপর দিয়ে নির্দেশনা অনুযায়ী, জিরো-টু’র (০২) দিকে যেতে থাকে। তবে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এটি রানওয়েতে আঁছড়ে পড়ে এবং পাশের একটি মাঠের খাদে পড়ে যায়। কিছুক্ষণ পর বিধ্বস্ত হয় বিমানটি। স্কেচ অনুযায়ী, সে সময় ত্রিভুবন বিমানবন্দরের কিউতে অবতরণ এবং উড্ডয়নের অপেক্ষায় যাত্রীসহ পাঁচটি বিমান অবস্থান করছিল। এর মধ্যে একটি বিমান ও টাওয়ারের ‘অনিরাপদ দূরত্ব দিয়ে’ বিমানটি রানওয়ের দিকে এগিয়ে যায়।

ওই দুর্ঘটনার পর দেশটির ইংরেজি দৈনিক নেপালি টাইমস একটি গ্রাফিক্স চিত্রের মাধ্যমে ড্যাশ-৮ বিমানের সর্বশেষ অবস্থান এবং বিধ্বস্তের সময়ের চিত্র প্রদর্শন করে। তারা বিমানের পাইলট ও এটিসি টাওয়ারের মধ্যকার কথোপকথনের একটি অডিও রেকর্ডও প্রকাশ করে।

নেপালি টাইমস জানায়, ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অব্যবস্থাপনার কারণে মর্মান্তিক ওই দুর্ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া দেশটির ইংরেজি দৈনিক দ্য হিমালয়ান টাইমস জানায়, উদ্ধার অভিযানে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের দক্ষতার অভাব ছিল। এছাড়া যথাযথ সুরক্ষা সামগ্রীর ব্যবস্থা না থাকায় বিধ্বস্ত বিমানের জ্বলন্ত ধ্বংসস্তূপ থেকে আরও অধিক মানুষকে রক্ষা করা সম্ভব হয়নি।

Advertisement

এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মহাব্যবস্থাপক রাজ কুমার ছেত্রি জাগো নিউজকে বলেন, ইউএস-বাংলার দুর্ঘটনার দিন পাইলট ও এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল রুমের অডিও ক্লিপটি আমিও শুনেছি। এটা পরিষ্কার যে, এটিসির কোনো ভুল ছিল না। পাইলটকে অনেকবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছে যে, তিনি কোন রানওয়ে ব্যবহার করতে চান। পাইলট যখন বললো তিনি টু-জিরো (২০) নম্বর রানওয়ে চান, তখন এটিসি সম্পূর্ণ রানওয়ে খালি করে দেয়। ওই সংবাদপত্রের তথ্য ভুল।

ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের যথাযথ সুরক্ষা সামগ্রীর অভাবের বিষয়ে তিনি বলেন, বিমানটি ক্র্যাশের পর আগুন লাগলে আমি চার মিনিটের মাথায় সেখানে যাই। আমি দেখি ফায়ার সার্ভিস, সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যরা উদ্ধার কাজ চালাচ্ছেন। উদ্ধার শেষ হওয়ার পর থেকে সরকার কর্তৃক তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কমিটিতে অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার আছেন, পাইলট আছেন, ডাক্তার আছেন। তারাই সব তথ্য বের করে নিয়ে আসবেন। আমি এখনই কোনো কারণ বললে, এটা ঠিক হবে না।

‘উড়োজাহাজে আমার একজন ভাই ছিলেন। সে বর্তমানে মেডিসিটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। সে আমাকে জানিয়েছে, অবতরণের সময় প্লেন কাত হয়ে যায়, এটা দেখে সবাই চিৎকার করতে থাকে। সবাই কাঁদছিল। এছাড়া বাংলাদেশি এক ভাইও বলেছেন, দ্রুত উদ্ধার করায় তারা প্রাণে বেঁচে যান। আশা করছি তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত কারণ বেরিয়ে আসবে’- যোগ করেন তিনি।

গত ১২ মার্চ ইউএস-বাংলার বিএস-২২১ ফ্লাইটটি বিধ্বস্তের ঘটনায় ৪৯ জনের মারা যান। আহত হন ২২ জন। আহতদের নেপালের কাঠমান্ডু মেডিকেল কলেজ (কেএমসি) হাসপাতাল, নরভিক হাসপাতাল, গ্রান্ডে হাসপাতাল, ওম হাসপাতাল ও মেডিসিটিতে চিকিৎসা দেয়া হয়। আহত ছয়জনকে ইতোমধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞ একটি মেডিকেল বোর্ডের আওতায় সেখানে তাদের চিকিৎসা চলছে।

Advertisement

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের প্রধান সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন বলেন, সব রোগীই স্ট্যাবল আছেন, মেডিকেলের ভাষায় আমরা স্ট্যাবল বলি কিন্তু কাউকে শঙ্কামুক্ত বলি না। একটা রোগী যতক্ষণ পর্যন্ত ছাড়পত্র নিয়ে হাসপাতাল থেকে চলে না যান ততক্ষণ শঙ্কামুক্ত বলা যায় না।’

তবে সবার মধ্যে দুশ্চিন্তা, দুঃস্বপ্ন, ভয়ভীতি- এগুলো কাজ করছে বলেও জানান তিনি। (বিশেষ দ্রষ্টব্য : স্কেচটি নেপালের তদন্ত কমিটির তৈরি। মূল ঘটনার সঙ্গে এটির মিল থাকতে পারে, নাও পারে।)

এআর/এমএআর/আরআইপি