ব্যাটিং, বোলিং আর ফিল্ডিং করতে সমস্যা হয় না। বাঁ-হাতের যে কনিষ্ঠা আঙুলে ব্যথা পেয়ে দেড় মাসের বেশি সময় মাঠের বাইরে, তা এখন আর ভোগাচ্ছে না। খাঁটি বাংলায় ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিং করতে ব্যথা লাগছে না। তাই ৪৭ দিন পর ১৬ মার্চ শ্রীলঙ্কার সঙ্গে অঘোষিত সেমির যুদ্ধে মাঠে নামেন সাকিব। কিন্তু এ কটা দিন যে তিনি একদমই অনুশীলন করেননি, ম্যাচ ফিটনেস ছাড়াই দেশ মাতৃকার টানে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে মাঠে নেমেছেন, সে খবর জানেন কজন?
Advertisement
তাই তো সাকিব কলম্বো যাবার আগে বিসিবি প্রধান চিকিৎসক দেবাশিষ চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেছিলেন, ‘ব্যথা নেই। ব্যাটিং, বোলিং আর ফিল্ডিং করতে সমস্যা নেই। কিন্তু ম্যাচ ফিটনেস বলতে একটা কথা আছে। তা ফিরে পেতে একটু হলেও সময় দরকার ছিল। আমার জানা মতে তা না নিয়েই জাতীয় দলকে সার্ভিস দিতে কলম্বো গেছেন সাকিব।’
প্রধান চিকিৎসকের এমন মন্তব্যের পর আর বুঝতে বাকি থাকে না, ইনজুরি জনিত সমস্যা কেটে গেলেও ব্যাটিং, বোলিং আর ফিল্ডিংয়ের সত্যিকার প্রস্তুতি এবং মাঠে নামার আগে নিজেকে তৈরি করার সময় হয়নি। সাকিব দেশ মাতৃকার টানে ঝুঁকি নিয়ে শতভাগ প্রস্তুত না হয়েও নেমে পড়েছেন মাঠে। প্রশ্ন উঠেছে, হঠাৎ কেনই বা সাকিবের নিদাহাস ট্রফি খেলতে সাকিবের কলম্বো উড়ে যাওয়া? ইনজুরির কারণে তিনি খেলতে পারবেন না, জেনেই মাহমুদউল্লাহকে ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক করা। তাহলে রবিন লিগের শেষ ম্যাচের আগের দিন কী কারণে ' অপ্রস্তুত' সাকিব ঢাকা ছাড়লেন? বোর্ডের দায়িত্বশীল সূত্রের খবর, নিদাহাস ট্রফিতে বাংলাদেশ তখন ধুকছিল। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে প্রথম ম্যাচ জেতা ছাড়া ভারতের বিপক্ষে দুইবার হেরে প্রায় বাদ পড়ার শঙ্কা গ্রাস করেছিল। সেই সঙ্কট উত্তরণ ও দলকে চাঙ্গা করার লক্ষ্য বিসিবি প্রধান নাজমুল হাসান পাপন সাকিবকে খেলার কথা বলেন। জাতীয় দলের বৃহতরও স্বার্থের কথা ভেবে সাকিবও তা মেনে কলম্বো পাড়ি জমান।
গত ১৬ মার্চ শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মাঠে নামার আগে বারবার নিজের শারীরিক, মানসিক ও ক্রিকেটীয় প্রস্তুতির ঘাটতির বিষয়টি মাথায় এনেছেন সাকিব। তাই নিজে খেললেও আরেক বাঁ-হাতি স্পিনার নাজমুল অপুকে দলে রেখে দেয়ার কথা বলেন। ম্যানেজমেন্ট সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ম্যাচের আগে সাকিব খানিক সংশয়ে ছিলেন। তাই বাঁ-হাতি স্পিনার নাজমুল অপুকে একাদশে রেখে দেবার পরামর্শ দেন। নিজে পুরো চার ওভার বল করতে না পারলে বাকিটুকু অপুকে দিয়ে সাড়া যায়। একই ভাবে নিজের প্রস্তুতির ঘাটতির কথা ভেবে তিন নম্বরে ব্যাটিং করা থেকেও ছিলেন বিরত। সাম্প্রতিক সময় সীমিত ওভারের ক্রিকেটে তিন নম্বরে খেলা সাকিব গত ম্যাচে দলে ফিরে নিজে তিন নম্বরে না নেমে সাব্বিরকে পাঠিয়েছেন মূলত, নিজে পুরোপুরি প্রস্তুত না থাকায়।
Advertisement
সত্যিকার ক্রিকেটীয় প্রস্তুতি না নিয়ে মাঠে ফিরে সাকিব যে বাজিমাত করে দিয়েছেন তা নয়। পরিসংখ্যানকে নিয়ামক বা মানদণ্ড ধরলে ওই খেলায় স্বাগতিক লঙ্কানদের বিপক্ষে খুব তার পারফরমেন্স আহামরি ছিল না। তার নৈপুণ্যে দল জিতেছে এমনও নয়। তারপরও মাঠে ফিরে টস জেতার পর সামনে থেকে নেতৃত্ব দেবার ইচ্ছে ও দৃঢ় সংকল্পে বোলিং শুরু করে নিজের দ্বিতীয় ও লঙ্কান ইনিংসের তৃতীয় ওভারে দানুষ্কা গুনাথিলাকেকে ফিরিয়ে ব্রেক থ্রু উপহার দেন।
অধিনায়কের মাঠে ফেরা এবং বল হাতে শুরুতেই লঙ্কান উদ্বোধনী জুটি ভাঙায় উজ্জিবীত অণুপ্রাণিত টাইগাররা তেঁতে শেষ পর্যন্ত মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের অবিস্মরণীয় উইলোবাজিতে ২ উইকেটের নাটকীয় জয়ে ফাইনালে বাংলাদেশ।
আজ (রোববার) ভারতের বিপক্ষে প্রেমাদাসায় ফাইনালে সত্যিকারের সাকিবকে পেতে চায় বাংলাদেশ। চেনা সাকিবইে দেখতে উন্মুখ গোটা জাতি। রোববার সন্ধ্যায় ‘সব্যসাচি’, ‘টু ইন ওয়ান’ আর ‘ম্যাচ উইনার সাকিবের দেখা মিলবে? এমন প্রশ্ন এখন সবার মুখে মুখে।
সাকিব বাংলাদেশ দলের প্রাণশক্তি। চালিকাশক্তি। ব্যাটিং ও বোলিংয়ের প্রধান হাতিয়ার। সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র। নিঃসন্দেহে সেরা ও এক নম্বর ম্যাচ উইনার। সব ফরম্যাটে দলের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পারফরমার। তার দলে থাকা মানেই ব্যাটিং শক্তির পুরোটা থাকা। আর সাকিব বল হাতে নেয়ার অর্থ বোলিং শক্তি অন্তত ৩০ ভাগ বেড়ে যাওয়া। তাই সাকিব দলে থাকা মানেই ভাল করার কার্যকর দাওয়াই বা রসদ ফিরে পাওয়া।
Advertisement
কিন্তু কঠিন সত্য হলো, সাকিব কি আসলে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার জন্য শতভাগ ফিট? রোহিত শর্মা, শিখর ধাওয়ান, মানিশ পাণ্ডে , লোকেশ রাহুল, যুগেন্দ্র চাহাল, ওয়াশিংটন সুন্দর আর শার্দুল ঠাকুরের গড়া ভারতের বিপক্ষে আজকের ধুন্ধুমার ফাইনাল ভাগ্য গড়ে দেয়ার জন্য যেমন শতভাগ শারীরিক, মানসিক ও ক্রিকেটীয় প্রস্তুতি প্রয়োজন, ২৭ জানুয়ারির পর মাঠের বাইরে ছিটকে পড়ে আঙুলের ক্ষত সাড়াতেই ব্যতিব্যস্ত ছিলেন গত সাত সপ্তাহ। দৌড়াদৌড়িও কম করেননি। ঢাকা, ব্যাংকক, কলম্বো, অস্ট্রেলিয়া ঘুরে আবার নিজ রাজধানিতে ফেরা। এবং ২৪ ঘণ্টার নোটিশে কলম্বো চলে যাওয়া। তারপর দিন শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মাঠে নামা। এ সময়ে নাম মাত্র ব্যাট ধরেছেন সাকিব। বোলিং, ফিল্ডিং প্র্যাকটিস হয়নি বললেই চলে। অনুশীলন যা করার, তা করেছেন কলম্বো গিয়ে।
এক কথায় নিদাহাস ট্রফির মত আন্তর্জাতিক আসর খেলার আগে প্রায় বিনা প্রস্তুতিতে মাঠে সাকিব। কাজেই তার পক্ষে কি নিজের সেরাটা উপহার দেয়া সম্ভব? কাজটা কঠিন। কিন্তু ক্রিকেটারটি সাকিব, তাই বলে দেয়া যায়, ‘হ্যা সম্ভব।’ তিনি পারেন। ছুটি কাটিয়ে অল্প ক'দিন হালকা অনুশীলন করে মাঠে নেমে ব্যাট ও বল হাতে দলের সেরা পারফরমার হয়েছেন অনেকবার।
ইতিহাস সাক্ষী দিচ্ছে একবার নয়, কয়েকবার ইনজুরি, ছুটি কিংবা সাসপেন্সনের খারায় বেশ কিছু দিন খেলার বাইরে থেকে মাঠে ফিরে ব্যাট ও বল হাতে অলরাউন্ডিং নৈপুণ্যে মাঠ মাতানোর পাশাপাশি দল জেতানোর রেকর্ড আছে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের।
কয়েকবার এমন হয়েছে, জাতীয় দলের ক্যাম্প চলছিল মাস খানেক কিংবা তারও আগে থেকে। সাকিব আল হাসান তখন বিগ ব্যাশ, আইপিএল , ইংলিশ কাউন্টি কিংবা অন্য কোন টুর্নামেন্ট খেলতে দেশের বাইরে। ঠিক আসর বা সিরিজ শুরুর বড়জোর সপ্তাহ খানেক আগে দেশে ফিরে তিন-চার দিন জাতীয় দলের সঙ্গে নামমাত্র অনুশীলন করে মাঠে নেমেই দুর্বার। ম্যাচ সেরা পারফরমার সাকিব।
সমালোচকরা হয়তো খুনসুঁটি করে বলবেন, আরে তিনি তো দেশের বাইরে প্র্যাকটিসের মধ্যেই ছিলেন, তাই জাতীয় দলের সঙ্গে দীর্ঘ দিনের ক্যাম্প করার দরকারই পড়েনি। আচ্ছা তা মানা গেল, কিন্তু ইতিহাস জানাচ্ছে সাকিব ক্যারিয়ারে বার দুয়েক সাসপেন্সনের খারায় পড়ে কিংবা ছুটি কাটিয়ে মাঠে ফিরেও বল ও ব্যাট হাতে ঠিক জ্বলে ওঠার রেকর্ড আছে সাকিবের।
একটি উদাহারন দেই। মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করুন। ইতিহাস জানাচ্ছে ২০১৪ সালের ৭ জুলাই অখেলোয়াড়ই আচরণ তথা শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ছয় মাসের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছিলেন সাকিব। মূলতঃ কোচ চন্দিকা হাথুরুসিংহে এবং একজন দর্শকের সঙ্গে বাজে ব্যবহারের জন্য তাকে ছয় মাস জাতীয় দল থেকে সাময়ীকভাবে বহিষ্কার করা হয়। ওই সময় বিসিবি প্রধান নাজমুল হাসান পাপর প্রকাশ্যে বলেছিলেন, সাকিবের আচরণে বড় ধরনের সমস্যা আছে। বাংলাদেশের ক্রিকেটে তার মতো বাজে আচরণের নজির আগে কখনো দেখা যায়নি। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে জাতীয় দলের ওপর। তাই তাকে ছয় মাসের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে।’
২০১৪ সালের ৭ জুলাই থেকে পরবর্তী ছয় মাস। এই সময় জাতীয় দল থেকেই শুধু নয়, দেশের বাইরে সব ধরনের বিদেশি লিগ বা টুর্নামেন্ট খেলার অনুমতি না দেয়ার সিদ্ধান্তও হয়। ফলশ্রুতিতে আগষ্টে ওয়েষ্ট ইন্ডিজ সফরে যেতে পারেননি। ওয়েষ্ট ইন্ডিজের মাটিতে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ খেলা হয়নি। দেশের ক্রিকেটের প্রধান অভিভাবকের মুখে অমন কটুক্তি শোনার পর যে কারো হতাশায় মুষরে পড়ার কথা। কিন্তু প্রচণ্ড সাহস আর মনোবলের অধিকারি সাকিব ছয় মাস ক্রিকেটের বাইরে থেকে মাঠে ফিরে ঠিক পারফরম করেছেন।
মজার বিষয় হলো ২০১৪ সালের ১৭ জুন শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে ভারতের সঙ্গে খেলার পর ছয় মাস জাতীয় দল ও সব ধরনের ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ সাকিব ২৫-২৭ অক্টোবর (ম্যাচটি তিনদিনে শেষ হয়ে গিয়েছিল) ঢাকার শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্টে নেমেই স্পিন ভেলকিতে মাঠ মাতিয়ে বসেন। জিম্বাবুয়ানদের বিপক্ষে প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসে ২৪.৫ ওভারে ৫ মেডেনে ৫৯ রানে ৬ উইকেট শিকার করে নিজেকে ঠিক মেলে ধরেন এ বাঁ-হাতি স্পিনার।
খুলনায় ঠিক পরের টেস্টে ক্যারিয়ারের বিরাট মাইল ফলক স্পর্শ করে ক্রিকেট বিশ্বে হৈ চৈ ফেলে দেন।একই বছর ৩ থেকে ৭ নভেম্বর খুলনায় পরের টেস্টে প্রথম ইনিংসে শতরান (২৫০ মিনিটে ১৮০ বলে ১৮ বাউন্ডারি ও দুই ছক্কায় ১৩৭) ম্যাচে ১০ উইকেট ( ৫/৮০ ও ৫/৪৪) শিকার করে ইতিহাসের পাতায় নিজের নামকে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখেন বিশ্বসেরা এই অলরাউন্ডার।
সেটা তো টেস্টে, পাঁচ মাস পর ওয়ানডেতে ফিরেও ম্যাচ জেতানো পারফরমেন্স করে ম্যাচ সেরা পারফরমার হয়ে যান। নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ওই বছর ২১ নভেম্বর চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডে খেলতে নেমে শতরান করে বসেন সাকিব। শুধু শতরান নয়, ব্যাট ও বলে দুরন্ত-দূর্বার (১০১ রান ও ৯৯ বলে ৪/৪১) সাকিব হন ম্যাচসেরা। তার চৌকস নৈপুণ্যে বাংলাদেশ জয়ী হয় ৮৭ রানে।
কাজেই ইতিহাস বলে দিচ্ছে, মাঠের বাইরে থাকা কিংবা নামমাত্র অনুশীলন করে মাঠে নেমে একবার নয়, বেশ কবার ব্যাট ও বল হাতে জ্বলে উঠে দল জিতিয়েছেন সাকিব। আজ সেই সাকিব ঝলেেকর দেখা মিলবে ?
এআরবি/এমআর/পিআর