মতামত

বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচাগ্র মেদিনী

শ্রীলঙ্কার মাটিতে শ্রীলঙ্কা-ভারত ফাইনালটা আয়োজকদের জন্য স্বপ্নের। একে তো শ্রীলঙ্কা স্বাগতিক। আর ভারতে আছে কোটি কোটি ক্রিকেটপাগল মানুষ। তাই বিশ্বের যে প্রান্তেই হোক, ভারত ফাইনালে গেলে টিভি দর্শকের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে। তাই শ্রীলঙ্কা-ভারত ফাইনাল হলে মাঠে এবং টিভিতে দর্শক হতে পারতো সর্বোচ্চ। লক্ষ্মী এসে বাসা বাধতো শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট বোর্ডের একাউন্টে। বাণিজ্যের চিন্তায় মশগুল শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট ভাতের থালা সাজিয়ে বসে ছিল। খালি লুটেপুটে খাওয়ার অপেক্ষা। যাদেরকে তারা গোনায়ই ধরেনি, সেই ‘পুচকে’ বাংলাদেশ তাদের বাড়া ভাতে টন টন ছাই ঢেলে দিয়েছে।

Advertisement

আগের টুর্নামেন্ট ও সিরিজে বাংলাদেশের যা পারফরম্যান্স, তাতে শ্রীলঙ্কা-ভারত ফাইনালটাই স্বাভাবিক ভাবনা। কিন্তু গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা ক্রিকেটে তো র‌্যাংকিং আর আগের পারফরম্যান্স মেনে সবকিছু হয় না। তাই যদি হতো, তাহলে আর এত লম্বা টুর্নামেন্ট করার কী দরকার ছিল, শ্রীলঙ্কা আর ভারত ফাইনাল খেলে ফেললেই পারতো। শ্রীলঙ্কান বোর্ড শ্রীলঙ্কা-ভারত ফাইনালের পোলাও শুধু স্বপ্নে খাচ্ছিল না বা ভেবেই বসে থাকেনি। অলিখিত ‘সেমিফাইনাল’ হয়ে ওঠা বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কার গ্রুপের শেষ ম্যাচ শুরু হওয়ার ২/৩ দিন আগেই ফাইনালের প্রেসিডেন্ট বক্সের অতিথিদের জন্য বিলি করা কার পাসে লেখা ছিল ফাইনাল হবে ভারত-শ্রীলঙ্কার মধ্যে। বাংলাদেশ যে এভাবে বাগড়া দেবে, এটা কেউই ভাবতে পারেননি আসলে।

এটা ঠিক, হুট করে অপেশাদার ভঙ্গিতে প্রধান কোচ লঙ্কান হাথুরুসিংহের চলে যাওয়ার পর উড়তে থাকা বাংলাদেশ হঠাৎ করেই যেন মাটিতে নেমে আসে। দেশের মাটিতে জিম্বাবুয়ে ও শ্রীলঙ্কাকে নিয়ে ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্ট এবং শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সব ফরম্যাটে সিরিজ হারার পর বাংলাদেশকে অচেনা লাগছিল। আত্মবিশ্বাস যেন তলানিতে ঠেকেছিল। তাই ভারত, শ্রীলঙ্কার সাথে নিদাহাস ট্রফিতে খেলতে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা গিয়েছিল কোনো প্রত্যাশা ছাড়াই। সবাই বলছিলেন, একটি জয়ই বদলে দিতে পারে বাংলাদেশকে। ভারতের বিপক্ষে পরাজয় দিয়েই শুরু হয় বাংলাদেশের টুর্নামেন্ট। কিন্তু পরের ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেই পেয়ে যায় কাঙ্খিত সেই জয়। আর জয় আসে রেকর্ডের পালকিতে চড়ে।

টি-২০তে ২১৫ রান তাড়া করে পাওয়া জয় বাংলাদেশের আত্মবিশ্বাস এবং একই সঙ্গে প্রত্যাশার পারদ চড়িয়ে দেয়। সেমিফাইনাল হয়ে ওঠা গ্রুপের শেষ ম্যাচে ফিরে আসেন সাকিব আল হাসান, নেতৃত্বও তার কাঁধে। দ্বিতীয় ওভারেই উইকেট নিয়ে সাকিব নেতৃত্বটা দেন সামনে থেকেই। শ্রীলঙ্কা ১০ ওভারে ৫ উইকেটে ৫৩ রান করার পরই যেন জিতে গিয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু শ্রীলঙ্কা ঠিকই ১৬০ রানের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। সেই চ্যালেঞ্জে পৌঁছাতে বারবার রঙ পাল্টায় খেলার। সব নাটকীয়তা যেন জমা ছিল শেষ ওভারের জন্য। ৬ বলে দরকার ১২ রান। স্ট্রাইকিং প্রান্তে মুস্তাফিজ আর সেট ব্যাটসম্যান মাহমুদুল্লাহ অপর প্রান্তে। মুস্তাফিজের দায়িত্ব ছিল কোনোরকমে মাহমুদুল্লাহকে স্ট্রাইক দেয়া।

Advertisement

উদানার প্রথম বল বাউন্সার, চেষ্টা করেও পারলেন না। পরের বলে আবার বাউন্সার। পরিমরি চেষ্টায় নিজে রানআউট হলেও মাহমুদুল্লাহকে স্ট্রাইক দিয়ে গেলেন মুস্তাফিজ। পরপর দুটি বাউন্সার, যার একটি নো বল ডেকেও ফিরিয়ে নিয়েছেন আম্পায়ার। মাঠের ভেতরে-বাইরে প্রতিবাদ জানায় বাংলাদেশ। এমনকি এক পর্যায়ে সাকিব ব্যাটসম্যানদের ডেকেও পাঠিয়েছেন। ভাগ্যিস তারা মাঠ ছাড়েননি। নইলে বাংলাদেশ বড় শাস্তি পেতে পারতো। সাকিবের ম্যাচ ফি’র ২৫ শতাংশ জরিমানায় অল্পের ওপর দিয়ে পার পেয়ে যায় বাংলাদেশের। নাটক জমে ওঠে শেষ ওভারে। মুস্তাফিজের আত্মঘাতী রান আউটে মাহমুদুল্লাহর সামনে বল আছে ৪টি, রান সেই ১২। মাহমুদুল্লাহ ওভারের দ্বিতীয় বলে ৪, পরের বলে মরিয়া চেষ্টায় ২ এবং পঞ্চম বলে ছ-ক-কা। সব হিসাব-নিকাশ উল্টে দিয়ে বাংলাদেশ ফাইনালে।

মাঠের ভেতরে মাহমুদুল্লাহ যা করেছেন তার কোনো তুলনা নেই। মাঠের বাইরে সাকিব আর নুরুল হাসান সোহান যা করেছেন, তারও কোনো তুলনা নেই। আমার মত যারা শুদ্ধ ক্রিকেটের সমর্থক, তারা হয়তো সাকিব বা সোহানের প্রতিক্রিয়ার পক্ষে থাকবেন না। বলবেন, এসব ফুটবলে হয়, ক্রিকেটে নয়। কিন্তু আমি শুদ্ধতার সমর্থক হলেও, তাদের এই আবেগকেও ধারণ করি পরম মমতায়। ক্রিকেটিয় হয়তো নয়, কিন্তু এই প্রতিবাদের পেছনে আছে গভীর দেশপ্রেম। আর অন্যায়ের প্রতিবাদ করার দরকার ছিল। লঙ্কানদের চোখে চোখ রেখে আঙ্গুল উচিয়ে বুঝিয়ে দেয়ার দরকার ছিল, বাংলাদেশকে হিসাবের বাইরে রাখার দিন শেষ।

তোমরা ৩ দিন আগেই ফাইনালের কার পাস ছেপে রাখবে, আর আমরা তোমাদের ছেড়ে কথা বলবো, এটা আর হবে না। লর্ডসে জার্সি উড়িয়ে সৌরভ গাঙ্গুলী বদলে দিয়েছিলেন ভারতকে। রানাতুঙ্গা প্রতিবাদ না করলে অস্ট্রেলিয়ানরা শেষ করে দিতো মুরলিধরনের ক্যারিয়ার। সাকিবের এই প্রতিবাদ তাই বদলে দিতে পারে বাংলাদেশকে।

২০১৫ সালের বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে এমন আরেক অন্যায় বদলে দিয়েছিল বাংলাদেশকে। ভারতকে জেতাতে সেবার অন্যায়ভাবে হারিয়ে দেয়া হয়েছিল বাংলাদেশকে। সেই পরাজয় থেকে পাওয়া নৈতিক শক্তিতে বলিয়ান বাংলাদেশ পরের দুই বছর খেলেছে স্বপ্নের ক্রিকেট। হঠাৎ বেপথু বাংলাদেশকে আবার ঠিক পথে তুলে দিতে পারে এই জয়, এই প্রতিবাদ।

Advertisement

নিদাহাস ট্রফির ফাইনালে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ভারত। সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স, রেটিং বিবেচনায় বাংলাদেশের বাইরের সবাই ভারতকেই এগিয়ে রাখবেন। কিন্তু আমি তাদের বলে রাখছি, আপনারা সবাই সিট বেল্ট বেধে তৈরি হন আরেকটি বাংলাদেশ রূপকথা দেখার আশায়। আমার বাজি বাংলাদেশের পক্ষেই। টুর্নামেন্টে ভারতের বিপক্ষে দুটি ম্যাচেই হেরেছে বাংলাদেশ। তবে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দুটি ম্যাচ যে স্টাইলে জিতেছে, তাই আমাকে বাজি ধরতে অনুপ্রাণিত করেছে। ক্রিকেটে ল অব অ্যাভারেজ বলে একটা কথা আছে। ভারত পরপর তিন ম্যাচেই বাংলাদেশকে হারিয়ে দেবে, সেটা হওয়ার কথা নয়। আর অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচ মানেই উত্তেজনার বারুদে ঠাসা। আগে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে যে উত্তেজনা ছিল, এখন সেটা বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচে বদলে গেছে। এই উত্তেজনার ইতিহাস বহু পুরোনো।

২০১৫ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালের কথা তো বলা হলোই। ইতিহাস কিন্তু আরো পুরোনো। ২০০৭ সালে ভারত বিশ^কাপ খেলতে গিয়েছিল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে। কিন্তু তখন সত্যিই পুচকে বাংলাদেশ গ্রুপ পর্বেই ভারতের স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত করেছিল। সেই ম্যাচেই বিশ্বকে নিজের আগমনী গান শুনিয়েছিলেন তামিম। সেই তামিম এখন অনেক পরিণত, রীতিমত ম্যাচ উইনার। মুশফিক অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশের ভরসার নাম। তবে টি-২০তে ঠিক যেন মানাচ্ছিল না তাকে। তবে মুশফিক এই টুর্নামেন্টে হঠাৎ করেই টি-২০ ব্যাটসম্যান হয়ে গেলেন। পরপর দুই ম্যাচে অপরাজিত ৭২ রান করে তিনি এখন টি-২০তেও ব্যাটিং ভরসা।

মাহমুদুল্লাহ তো শেষ ম্যাচেই নতুন করে চিনিয়েছেন নিজেকে। লিটন দাস এক ম্যাচে জ্বলে উঠেছেন। বাকিটা নিশ্চয়ই ফাইনালের জন্য তুলে রেখেছেন। সৌম্য, সাব্বিরদের নিজেদের প্রমাণ করার পালা। বোলিঙে যেটুকু ঘাটতি ছিল, সাকিব যেন তা পুরণ করতেই এসেছেন। আর সাকিব দলে ফেরা মানে দুজন ফেরা- দলের সেরা বোলার, সেরা ব্যাটসম্যান।

এমনিতে পারফরম্যান্স যাই হোক, ভারতকে সামনে পেলে বাংলাদেশ জ্বলে ওঠে। আর মুস্তাফিজকে তো বিশ্ব চিনেছেই, ভারতকে ধ্বসিয়ে দেয়া পারফরম্যান্সে। তবে বাংলাদেশের পক্ষে আমার বাজির কারণ শুধু পারফরম্যান্স নয়। কারণ ক্রিকেট নিছক শারীরিক খেলা নয়, মানসিক লড়াইও। সেই লড়াইয়ে এখন বাংলাদেশ এগিয়ে। একচুলও ছাড় না দেয়ার মানসিকতায় উজ্জীবিত সবাই। সবাই তৈরি ভারতকে সেই লড়াইয়ের বাণী শুনিয়ে দিতে- বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচাগ্র মেদিনী।

শেষ ম্যাচের নাটকীয় জয় ঢেকে দিয়েছে বাংলাদেশের অনেক দুর্বলতা। কিন্তু ফাইনালে শক্তিশালী ভারতের বিপক্ষে নামার আগে সেই বিষয়গুলোও আমলে নিতে হবে। অনেকদিন পর মাঠে ফিরেই দ্বিতীয় ওভারে উইকেট পেয়েছেন সাকিব। কিন্তু এরপর ম্যাচে বাকি দুই ওভার বল করলেন না কেন তিনি? স্পেশালিস্ট বোলার নাজমুলকে একাদশে যদি নেয়াই হলো, তার হাতে বল দেয়া হলো না কেন? কেন অনিয়মিত বোলার সৌম্য সরকারকে দিয়ে দুই ওভার করাতে হলো? ৪৯ ওভারের শেষ বলে এক রান নেয়ার জন্য মিরাজের মরিয়া দৌড় দেখে বোঝা গেছে আসলে ব্যাটিং নিয়ে কোনো পরিকল্পনাই ছিল না। কারণ শেষ বলে মিরাজ দাড়িয়ে থাকলে শেষ ওভারের প্রথম বল থেকেই সুযোগ পেতেন মাহমুদুল্লাহ।উইনিং কম্বিনেশনের দোহাই দিয়ে ফাইনালে একাদশ অপরিবর্তিত রাখা হবে কিনা জানি না। তবে সময় এসেছে আমার অতি প্রিয় ব্যাটসম্যান সৌম্য সরকারকে একটু বিরতি দেয়ার। আর সাব্বিরকে তো অনেক আগেই অন্তত অ্যাটিচ্যুড সমস্যার কারণে দল থেকে বাদ দেয়া দরকার ছিল। অসাধারণ পারফরম্যান্সই কেবল তাকে বাঁচাতে পারতো। সেটাও তিনি দেখাতে পারেননি। যে গরু দুধ দেয়, তার লাথি না হয় খাওয়া যায়। কিন্তু সাব্বির নিছকই দুষ্ট গরু। তাই গোয়াল শূন্য থাকলেও এই দুষ্ট গরুকে দূর করা দরকার। কারণ সাব্বিরের সংস্পর্শে নষ্ট হয়ে যেতে পারে, অন্য ভালো ছেলেগুলোও।

বলছিলাম বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচের কথা। এই লড়াই যতটা মাঠে হয়, তারচেয়ে বেশি হয় মাঠের বাইরে, ভার্চুয়াল জগতে। এই লড়াইটা অবশ্য শুরু করেছে ভারতীয়রাই। ২০০৭ সালের ক্ষতটা তারা ভুলতে পারেনি। তাই ২০১৫ সালের ম্যাচের আগে তারা ‘মওকা মওকা’ বিজ্ঞাপন বানিয়েছিল। সেই ‘মওকা’টা তারা পেয়েছিল তখন ইন্ডিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলে পরিণত হওয়া আইসিসির চোট্টামির বরাতে। আশা করি এবার আইসিসি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল হিসেবেই দায়িত্ব পালন করবে। ভারতের উগ্র সমর্থকদের ব্যাপারে আমার কিছু বলার নেই। তবে বাংলাদেশের সমর্থকদের প্রতি অনুরোধ, ভারতীয়দের উসকানিতে পা দিয়ে কাদা ছোড়াছুড়িতে জড়াবেন না। নিজেদের তাদের পর্যায়ে নামিয়ে আনবেন না।

আমরা বাংলাদেশের পাশে আছি, বাংলাদেশের পাশে থাকবো। ক্রিকেটিং নেশন হিসেবে ক্রিকেটের চেতনাটা যেন ঊর্ধ্বে তুলে ধরি আমরা। তবে তার মানে এই নয়, ভারতীয়রা অন্যায় কিছু বললে আমরা মুখ বুজে বসে থাকবো। আমরা যে অন্যায় সহ্য করি না সেটা তো সাকিব শ্রীলঙ্কাকে বুঝিয়েই দিয়েছেন। এবার ভারতের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার পালা। তবে কোনো প্রতিক্রিয়াই যেন ক্রিকেটিং ভব্যতাকে ছাড়িয়ে না যায়। তুমি অধম, তাই বলিয়া আমি উত্তম হইবো না কেন।

১৭ মার্চ, ২০১৮

এইচআর/পিআর