“এ খেদ মোর মনে/ ভালবেসে মিটল না আশ- কুলাল না এ জীবনে/ হায়, জীবন এত ছোট কেনে?/ এ ভুবনে? ”
Advertisement
১২ মার্চের সকালটা ছিল অন্য আট দশটা দিনের মতোই স্বাভাবিক। তবে কারো কারো কাছে সেদিনের ভোরের সূর্যটা একটু বেশিই গাঢ় ছিল। কারণ তাদের চোখে ছিল তখন আকাশে উড়ার স্বপ্ন। কাজের অবসরে কিংবা নতুন বিয়ের পর হানিমুনে যাবার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন কেউ কেউ।
সকালে মিরপুর বস্তিতে আগুনে সবকিছু পুড়ে যাওয়ার ঘটনায় দিনের শুরুটা কিছুটা বিষাদে কাটলেও বাদবাকি সবকিছুই ছিল মোটামুটি শান্ত। বাইরে রোদ থাকলেও ফাগুনের ফুরফুরে বাতাসের আনাগোনা ছিল, ঝরা পাতাগুলো উড়ে যাচ্ছিল আপন মনে। সাথে মন উদাস করা কোকিলের ডাকও হয়ত কেউ কেউ শুনেছেন। কিন্তু দুপুরের পরপরই এ দেশের মানুষের জীবনে এমন একটা দুর্যোগের ঘনঘটা বয়ে আসবে তা যেন ছিল সকলেরই ধারণার বাইরে।
দুপুর তিনটা থেকে যখন একে একে টেলিভিশন ও অনলাইন সংবাদমাধ্যমগুলোতে নেপালের ত্রিভুবন বিমানবন্দরে ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের বিমান বিধ্বস্ত হবার ঘটনার ব্রেকিং নিউজ যাচ্ছিল ঠিক তখনই এদেশের মানুষের কাছে দিনটা বদলে যায় এক লহমায়। আর যাদের স্বজন একটু আগেই নেপালের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন তাদের অবস্থাটা সহজেই অনুমেয়।
Advertisement
প্রকৃতির নিয়মেরই মানুষ পৃথিবীতে আসে আবার প্রকৃতির নিয়মেই ছেড়ে যেতে হয় এ সুন্দর পৃথিবী। তবুও যেন মানব জীবনে আফসোসের শেষ নেই। প্রিয়জনকে চিরতরে হারাবার কষ্ট , শোক মানুষকে প্রকৃতির নিয়মেই যেন মেনে নিতে হয় একসময়। তবুও কিছু কিছু মৃত্যু, কিছু কিছু হারাবার বেদনার গভীরতা এতটাই থাকে, যা কোন ফ্যাদোমিটারে মাপা সম্ভব হয় না, যে বেদনা থেকে যায় সারাজীবন।
এ ক্ষত কতটা গভীর সে উপলব্ধি কেবল তাদেরই আছে যারা কিনা অকালে হারিয়েছেন তাদের ভালবাসার মানুষদের। এ গভীরতা উপলব্ধি করেই হয়ত কবি তারাশঙ্কর বন্ধ্যোপাধ্যায় উপরের আফসোসের শব্দমালাগুলো সাজিয়েছিলেন।
আমাদের গলা ভারী হয়ে আসে , কণ্ঠ রোধ হয়ে আসে কোন কোন অনাকাঙ্খিত মৃত্যুর ঘটনায়। যখন নেপাল বিমান দুর্ঘটনায় নিহত একজনের স্ত্রীর বুক ফাটা আর্তনাদ কানে বাজে , “তার সাথে সংসার করেতো আমার মন ভরেনাই”। অথবা আমেরিকান প্রবাসী স্বামী স্ত্রীকে শেষ বিদায় জানাতে বাংলাদেশে যাত্রাপথে যখন ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেন –
“ আমার জান, আমার কলিজা কেন তুমি আমাকে একা করে দিয়েছ? তুমি ছিলে আমার জীবনের সেরা পাওয়া। তুমি সবসময়, প্রতিটি দিন, প্রতিটি সেকেন্ড আমাকে পরিপূর্ণ করেছ। তুমি প্রতি মুহুর্তে আমার বেঁচে থাকার কারণ। তুমিতো তা জানতে তাহলে কেন এভাবে আমার বুক থেকে সারাজীবনের জন্য আকাশে লুকিয়ে গেলে? ’’ নিকটজন হারানো এ শোকের যেমন শেষ নেই তেমনই কারো জানা নেই এ অবস্থায় সান্ত্বনা দেবার কোন ভাষা।
Advertisement
নেপালের ত্রিভুবন বিমানবন্দরেই এ ভুবন থেকে বিদায় নিয়েছেন যারা, তাদের প্রায় সবাই বয়সে তরুণ।পরিবারকে, দেশকে দেবার মতো তাদের ছিল অনেক কিছু বাকি। সদা হাস্যোজ্জ্বল, দেশসেবক ,বন্ধুবৎসল বিপাশার অফিসের ডেস্কটপের উপরে রাখা লাল টিপটি যেন সহকর্মীদের বুকে এখন কাঁটার মতো বিঁধছে। তা দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন তারা। কাঁদছেন বন্ধু, স্বজনেরাও। এক বুক কান্না আর হাহাকার করা ছাড়া আর কিই বা করার আছে! কাঁদছেন সবাই তার ছোট সন্তান ও স্বামীর জন্যও।
“দূরলোক থেকে আলো দেখে চিনে নিও” এভাবেই মোমবাতি প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে বন্ধুরা স্মরণ করছেন তাদের। কেউ বা বিয়ের দিনের কথা, কেউবা হল লাইফ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের দিনগুলোর কথা। “জীবন সে তো পদ্মপাতার শিশিরবিন্দু” অথবা “আহারে জীবন, আহা জীবন, জলে ভাসা পদ্ম যেমন”। জীবন এত ছোট, এত ক্ষণিকের বলেই কি যুগ যুগ ধরে এ ধরনের মর্মস্পর্শী গানগুলো সৃষ্টি হয়ে চলেছে!
মাত্র কয়েকটা দিন আগেই পারিবারিক আয়োজনের মাধ্যমে আঁখিমনি গাঁটছড়া বাঁধেন দীর্ঘ দিনের ভালবাসার মানুষ মিনহাজ বিন নাসিরের সাথে। চোখে মুখে যখন নতুন জীবনের স্বপ্ন সাজাতে ব্যস্ত তখনই এ নির্মম সত্যির কাছে স্বপ্নগুলো যে থেকে গেল অধরাই। “ভালবেসে সখী নিভৃতে যতনে ” এ কথা রাখতেই বুঝি একই সাথে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। কিন্তু সন্তান হারানোর এ বেদনা কি করে সইবে তাদের পরিবারগুলো! জানেনা আঁখিমনির হাতের মেহেদির লাল রঙ, জানেনা আঙুলের আংটিগুলোও।
বলা হয়ে থাকে একটি মেয়ের কাছে বাবাই হচ্ছেন একমাত্র পুরুষ যার কাছে কিনা সে নিরাপদ, যে কিনা নিঃস্বার্থভাবে ভালবাসে তার কন্যাকে। হ্যাঁ, পেশা এবং নেশায় ফটোগ্রাফার প্রিয়ক তার প্রমাণ রেখে গেছেন। স্ত্রীকে কোনরকমে ধ্বংস হয়ে যাওয়া বিমান থেকে বের করে দিয়ে আগুনের ভেতরেই খুঁজতে চলে যান তিন বছরের মেয়েকে।
নাহ! বাবা মেয়ে কেউই আর ফিরে আসতে পারেনি। সংবাদ মাধ্যমে আমরা শুনেছি, স্ত্রী অ্যানি স্বামী, সন্তানকে হুইল চেয়ারে করে ঘুরে ঘুরে খোঁজে ফিরছিলেন ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। আগে থেকেই স্বামী হারা প্রিয়কের মা এবার হারালেন তার একমাত্র সন্তান ও নাতনিকে। হে সৃষ্টিকর্তা! শোক যদি দিলে তবে তা বইবার শক্তিও তুমি তাকে দিও!’
আড্ডাগুলো তোর হাসিতে জমবে না আর। তুই নেই কেমন করে বইব এ কষ্টের ভার।’ বন্ধুকে হারিয়ে শোকে কাতর বন্ধুরা এভাবেই স্মরণ করছেন তাদের লেখায়। কিছু কিছু কষ্টের ভার এমনই বিশাল যে তা সহ্য করা যায় না। আর পৃথুলা নামের মেয়েটি ইউএস বাংলার কো পাইলট, বাবা মার একমাত্র সন্তান। আকাশ জয়ের স্বপ্ন যার সারাজীবনের, বাবা মায়ের একমাত্র আশ্রয় সেই মেয়েটি সকলকে কাঁদিয়ে বীরের মতো চলে গেল দশজনকে বাঁচিয়ে। যাকে নেপালের বিভিন্ন গণমাধ্যম ‘ডটার অব বাংলাদেশ’ খেতাবে ভূষিত করেছে। একমাত্র সন্তানকে নিয়ে অনেক আশায় ছিলেন পাইলট আবিদ সুলতানের স্ত্রী। কিন্তু হাসপাতালে মারা যাওয়ায় তিনিও ভেঙে পড়েন । বললেন, এ ক্ষতি অপূরণীয়। এরকম আরো অনেক। মা হারালেন সন্তান, সন্তান মাকে অথবা স্ত্রী স্বামীকে আর স্বামী হারিয়েছেন স্ত্রীকে। বিমানের কেবিন ক্রু নাবিলার মেয়ে এখনও আছে মায়ের প্রতীক্ষায়। মা অফিসে গেছে সেটাই সে জানে। কিন্তু নিষ্ঠুর এ নিয়তি যে আর তার মাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে না, তাকে ডেকে উঠবেনা ‘ইয়া পাখি’ বলে !
এ ঘটনাগুলো কোন গল্পের নয়, নয় কোন অস্কার বা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রাপ্ত মুভির। এই একেকটি ঘটনা আজ একেকটি বাস্তব চিত্র। যা ১২ মার্চের তারিখটি বাংলাদেশকে দিয়ে গেছে। আজ এ ঘটনাটি শত শত নয় কোটি কোটি পরিবারকে, মানুষকে কাঁদাচ্ছে। পালিত হয়েছে রাষ্ট্রীয় শোক। বুকে কালো ব্যাজ ধারণ করে অফিস করেছেন সরকারী, বেসরকারী, স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা।
এছাড়াও দেশের সকল প্রতিষ্ঠান ও বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশী মিশনগুলোতেও জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়েছে। মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করে নিহতদের স্মরণ করছেন আত্মীয়, বন্ধু ও পরিজনেরা। কিন্তু কোন কিছুতেই যে আর কথা বলে উঠবেনা ত্রিভুবনে চিরতরে নিভে যাওয়া প্রাণগুলো!
মৃত্যুর এ অমোঘ নিয়মের কাছে যে আমাদের কোন হাত নেই। নব্বইয়ের দশকের ফিডব্যাকের বঙ্গাব্দ ১৪০০ অ্যালবামের সেই গানটি যেন চিরকাল সে কথাটিই আমাদের মনে করিয়ে দেবে-
জীবন সুন্দর। আকাশ, বাতাস, পাহাড় সমুদ্র/ সবুজ বনানী ঘেরা প্রকৃতি সুন্দর, আর সবচেয়ে সুন্দর এই বেঁচে থাকা/ তবুও কি আজীবন বেঁচে থাকা যায় ?/ বিদায়ের সেহনাই বাজে, নিয়ে যাবার পালকি এসে দাঁড়ায় দুয়ারে/ সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে, এইযে বেঁচে ছিলাম/ দীর্ঘশ্বাস নিয়ে যেতে হয়, সবাইকে অজানা গন্তব্যে/ হঠাৎ ডেকে ওঠে নাম না জানা পাখি/ অজান্তেই চমকে উঠি, জীবন ফুরালো নাকি? / এমনি করে সবাই যাবে যেতে হবে... !!!
লেখক : সম্পাদক, লুক।
এইচআর/এমএস