জাতীয়

অবশেষে আলোর মুখ দেখছে চিড়িয়াখানা আইন

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে বিরোধের কারণে ১০ বছর ধরে আটকে আছে চিড়িয়াখানা আইন। অবশেষে সমঝোতা হয়েছে দুই মন্ত্রণালয়ের। খসড়া চিড়িয়াখানা আইনটি অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভা বৈঠকে পাঠানো হচ্ছে।

Advertisement

বেসরকারি চিড়িয়াখানাগুলোর নিয়ন্ত্রণ বন মন্ত্রণালয়ের হাতে নিতে তারা চিড়িয়াখানা আইনটি করতে দিচ্ছিল না। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দাবি ছিল, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এ ধরনের আইন করার সুযোগ নেই। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, ২০০৮ সাল থেকে চিড়িয়াখানা আইন করার চেষ্টা চালিয়ে আসছেন তারা। এ আইনটি না হওয়ায় ওয়ার্ল্ড অ্যাসোসিয়েশন অব জু অ্যান্ড একুরিয়ামসহ (ওয়াজা) সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সদস্য হতে পারছে না বাংলাদেশ। সহযোগিতা পেতে সমস্যা হচ্ছে ওই সব সংগঠন থেকে। সরকারি দুটি চিড়িয়াখানা (মিরপুরে জাতীয় চিড়িয়াখানা ও রংপুর চিড়িয়াখানা) পরিচালনায় জটিলতা নিরসনসহ ব্যবস্থাপনাকে আইনগত ভিত্তি দিতে আইন প্রয়োজন। আইনি কাঠামো না থাকায় চিড়িয়াখানায় বড় ধরনের উন্নয়ন করা যাচ্ছে না। এছাড়া বেসরকারি ও ব্যক্তি পর্যায়ে গড়ে ওঠা চিড়িয়াখানাগুলোর উপরও সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় ব্যবহৃত হবে এ আইন।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. নজরুল আনোয়ার জাগো নিউজকে বলেন, খসড়া চিড়িয়াখানা আইনটি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষে পাঠানো হয়েছিল। তারা ভাষাটা ঠিক করে পাঠিয়েছে, আমরা এখন এটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠাব। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগেও একটি কমিটি আছে সেই কমিটি এটি দেখে মন্ত্রিসভা বৈঠকে অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করবে। তিনি বলেন, এটি নিয়ে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আর কোন দ্বিমত নেই। তাদের সঙ্গে একাধিক সভা করে আমরা আপত্তিগুলো নিষ্পত্তি করে খসড়াটি চূড়ান্ত করেছি। এখন আর কোন জটিলতা নেই, যেগুলো ছিল সেগুলো দূর হয়েছে।

প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, ২০০৮ সাল থেকে চিড়িয়াখানা আইন করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত ২০১২ সালে মন্ত্রিসভা বৈঠকে খসড়া আইনটি পাঠানো হয়। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের আপত্তির মুখে কিছু পর্যবেক্ষণসহ মন্ত্রিসভা খসড়াটি ফেরত দেয়। ২০১২ সালের ২ আগস্ট মন্ত্রিসভা বৈঠকে ‘বাংলাদেশ চিড়িয়াখানা আইন’ এর খসড়া নীতিগত অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হলেও তা ফেরত পাঠানো হয়। তখনকার মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা জানিয়েছিলেন, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের সঙ্গে কিছু বিষয় সাংঘর্ষিক থাকায় আইনটি ফেরত পাঠানো হয়েছে। তিনি আরও জানান, আইনটি নিয়ে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এবং প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে আরও সংশোধন ও সংযোজনের মাধ্যমে নতুনভাবে আইনটি মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করতে বলা হয়েছে।

Advertisement

মৎস্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পর্যবেক্ষণ নিয়ে অনেকবার বৈঠক হয়েছে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে। বহুবার আন্তঃমন্ত্রণালয় মিটিং হয়েছে। সেখানে বন মন্ত্রণালয় আপত্তি দিয়েছে, সেই আপত্তি আমরা নিষ্পত্তি করেছি। পরের মিটিংয়ে এসে তারা বলে, না আমরা এটা বলিনি। লিখিত মতামত চাইলে সেটা আবার দেয় না। আগের সচিব ও মন্ত্রী বন সচিব ও মন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখেছেন। বিষয়টি নিষ্পত্তি না হওয়া ও রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী দুই মন্ত্রণালয় ঐক্যমত না হওয়ায় সিদ্ধান্তের জন্য ২০১৪ সালের এপ্রিলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে প্রস্তাব পাঠনো হয়। বন মন্ত্রণালয় কোথায় কোথায় দ্বিমত পোষণ করে সেগুলো ও বিশেষজ্ঞদের মতামত আলাদা ছকে দেয়ার জন্য বলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। পরে বিষয়টি নিয়ে আবার দুই মন্ত্রণালয় আলোচনায় বসলে বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়। ইতোমধ্যে দুই মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পদগুলোতেও পরিবর্তন আসে।

পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব আবদুল্লাহ আল মোহসীন চৌধুরী বলেন, চিড়িয়াখানা আইনটি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় করছে। আমি এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে পারব না। বন অধিদফতরের বন সংরক্ষক (বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ) জাহিদুল কবির বলেন, ‘চিড়িয়াখানা আইন করা নিয়ে এখন আর কোন জটিলতা নেই। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় আইনটি করছে।

পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২’ একটি সমন্বিত আইন। এর সঙ্গে চিড়িয়াখানা আইনের কিছু ধারা সাংঘর্ষিক ছিল। বাঘ যখন বনে থাকে তখন সেটা বন্যপ্রাণী, বাঘ যখন চিড়িয়াখানায় থাকে তখন সেটি প্রাণিসম্পদ মন্ত্রালয়ের অধীন। আমরা যদি বন থেকে প্রাণী ধরে চিড়িয়াখানায় রাখি তবে বন থেকে এগুলো হারিয়ে যাবে। আমাদের উদ্দেশ্য বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ, ব্যবসা করা নয়।

জাতীয় চিড়িয়াখানার একজন কর্মকর্তা জানান, চিড়িয়াখানায় কোনো প্রাণী স্বাভাবিক আয়ুস্কাল অতিক্রম করলে সেগুলো বয়স্ক তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। এসব প্রাণী সাধারণত দৃষ্টিনন্দন থাকে না, প্রদর্শনের অযোগ্য হয়ে পড়ে। বার্ধক্যজনিত জটিলতায় চিকিৎসা ও এসব প্রাণীর খাবারের পেছনে সরকারে বিপুল অঙ্কের অর্থের অপচয় হয়। তাই এদের বেদনাহীন মৃত্যুর ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে চিড়িয়াখানা আইন না থাকায় মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বয়স্ক প্রাণী ও পাখি অপসারণ করা যায় না। ওই কর্মকর্তা আরও জানান, চিড়িয়াখানায় জন্ম দেয়া উদ্বৃত্ত প্রাণী হস্তান্তর ও বিনিময়ের জন্য আইন প্রয়োজন। ২০১৩ সালের ১০ জানুয়ারি এক বৈঠকে দেশের চিড়িয়াখানাগুলোর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য দ্রুত চিড়িয়াখানা আইন প্রণয়নের তাগিদ দেয় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি।

Advertisement

জাতীয় চিড়িয়াখানার কিউরেটর নজরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, চিড়িয়াখানা আইনটি এখন মন্ত্রিসভা বৈঠকে উঠার পর্যায়ে আছে। ৩২টি মন্ত্রণালয়ের সচিবদের প্রতিনিধিদের নিয়ে আইনের খসড়াটি রিফাইন করে দিয়েছি আমরা। এখন হয়ে যাবে আশা করি। এবার আর অসুবিধা হবে বলে মনে করছি না। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বিষয়গুলোও আমরা বিবেচনায় নিয়ে নিষ্পত্তি করেছি। চিড়িয়াখানার ব্যবস্থাপনায় একটি সমন্বিত আইন থাকা প্রয়োজন।

আইনের খসড়াটি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, খসড়া আইনে চিড়িয়াখানায় জন্ম দেয়া উদ্বৃত্ত প্রাণী বিনিময় ও হস্তান্তরের বিধান রাখা হয়েছে। বেসরকারি চিড়িয়াখানা অনুমোদন দেয়ার বিধানও থাকছে এতে। ব্যক্তি পর্যায়ে চলমান চিড়িয়াখানাগুলোকে নিবন্ধন ও খাঁচায় পাখি ক্রয়-বিক্রয়ের অনুমোদন দেয়ার বিধান রাখা হয়েছে খসড়া আইনে। এছাড়া প্রদর্শনের অনুপযুক্ত বয়স্ক প্রাণীর ব্যথাহীন মৃত্যুর (ইউথেনেসিয়া) ব্যবস্থা, প্রতিটি চিড়িয়াখানায় আধুনিক ভেটেরিনারি কেয়ার হাসপাতাল রাখা, ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসার ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে খসড়ায়।

আরএমএম/ওআর/আরআইপি