দেশে আমদানি ব্যয় বাড়ছে। কিন্তু সে অনুযায়ী বাড়ছে না রফতানি আয়। ফলে আশংকাজনক হারে বেড়েছে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ। চলতি অর্থবছরের (জুলাই-জানুয়ারি) সাত মাসে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ১২ কোটি ৩০ লাখ ডলার। স্বাধীনতার পর অর্থাৎ ৪৭ বছরে এটি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বাণিজ্য ঘাটতি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
Advertisement
এর আগে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ২০১০-১১ অর্থবছরে; ৯৯৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার। ২০১১-১২ অর্থবছরে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৯৩২ কোটি ডলার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমদানি ব্যয় যে হারে বেড়েছে, সে তুলনায় রফতানি আয় না বাড়ায় বড় ধরনের বাণিজ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে। একই সঙ্গে দীর্ঘদিন রেমিট্যান্স প্রবাহে নেতিবাচক এবং সেবা খাতের ঘাটতি বেড়ে যাওয়ায় ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে চলতি হিসাবের ভারসাম্য।
তাদের মতে, আমদানির এ প্রভাব উৎপাদনশীল খাতের বিনিয়োগে পড়লে তা অর্থনীতির জন্য ভালো। তবে এ অর্থ যদি পাচার হয়ে থাকে তাহলে ফল অত্যন্ত ভয়াবহ। বর্তমান অবস্থা অব্যাহত থাকলে চাপের মুখে পড়বে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও।
Advertisement
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে এ প্রসঙ্গে বলেন, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলসহ বেশকিছু বড় প্রকল্পের কাজ চলছে। এসব প্রকল্পের প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ আমদানিতে অনেক অর্থ ব্যয় হচ্ছে। আমদানি যেভাবে হয়েছে সেই হারে রফতানি বাড়েনি। ফলে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে। তিনি বলেন, আমাদের দেশে সব সময় বাণিজ্য ঘাটতি থাকে। তবে এখন তা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। এর মূল কারণ একদিকে রফতানি আয় বাড়ছে না, অন্যদিকে দীর্ঘদিন রেমিট্যান্স প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব। সম্প্রতি রেমিট্যান্স কিছুটা বাড়লেও যে হারে কমেছে সেই হারে বাড়েনি।
প্রবীণ এ অর্থনীতি বিশ্লেষক বলেন, বাণিজ্য ঘাটতির এ নেতিবাচক ধারা সার্বিক অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে। কারণ এটি অব্যাহত থাকলে বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের (রিজার্ভ) ওপর প্রভাব পড়বে; এক্সচেঞ্জ রেট বেড়ে যাবে। ফলে টাকার অবমূল্যায়ন বাড়বে। সর্বোপরি মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জানুয়ারি শেষে ইপিজেডসহ রফতানি খাতে বাংলাদেশ আয় করেছে দুই হাজার ১০৫ কোটি ৩০ লাখ ডলার। বিপরীতে আমদানি বাবদ ব্যয় হয়েছে তিন হাজার ১১৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার। এ হিসাবে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়ায় এক হাজার ১২ কোটি ৩০ ডলার। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী, প্রতি ডলার ৮২ টাকা হিসেবে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৮৩ হাজার কোটি টাকার বেশি।
আলোচিত সময়ে আমদানি বেড়েছে ২৫ দশমিক ২০ শতাংশ হারে। অন্যদিকে রফতানি বেড়েছে মাত্র ৭ দশমিক ৩১ শতাংশ। ফলে চলতি হিসাবে ঘাটতি বড় হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকার অর্থ হলো নিয়মিত লেনদেনে দেশকে কোনো ঋণ করতে হচ্ছে না। ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়। সেই হিসাবে উন্নয়নশীল দেশের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকা ভালো। কিন্তু গত কয়েক বছর উদ্বৃত্ত থাকলেও গেল অর্থবছরে ঋণাত্মক ধারায় চলে যায়। জানুয়ারি শেষেও এ ধারা অব্যাহত থাকে।
Advertisement
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৪-১৫ ও ২০১৫-১৬ অর্থবছরজুড়ে চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত ছিল। বৈদেশিক দায় পরিশোধে সরকারকে বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু ২০১৬-১৭ অর্থবছরের ১৪৮ কোটি ডলার (-) ঋণাত্মক হয়। যা এখনও অব্যাহত রয়েছে।
২০১৭-১৮ অর্থবছরের জানুয়ারি শেষে ৫৩৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার ঋণাত্মক হয়েছে। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী এর পরিমাণ প্রায় ৪৪ হাজার কোটি টাকা। যা এর আগের অর্থবছরের একই সময়ে ঋণাত্মক ছিল ৮৯ কোটি ডলার।
আলোচিত সময়ে সেবাখাতে বিদেশিদের বেতনভাতা পরিশোধ করা হয়েছে ৫০৫ কোটি ২০ লাখ ডলার। বাংলাদেশ এ খাতে আয় করেছে মাত্র ২৪৬ কোটি ৭০ লাখ ডলার। এ হিসাবে সাত মাসে সেবায় বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৫৮ কোটি ৫০ লাখ ডলার। যা গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের একই সময়ে ছিল (ঘাটতি) ১৯৯ কোটি ৫০ লাখ ডলার।
দেশে-বিদেশি বিনিয়োগও কিছুটা ভাটা পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) দেশে এসেছে মোট ১১০ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১১৩ কোটি ডলার।
তবে আলোচিত সময়ে শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের সাত মাসে নিট পোর্টফোলিও বিনিয়োগ হয়েছে ৩১ কোটি ২০ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২১ কোটি ১০ লাখ ডলার।
এসআই/এমএআর/জেআইএম