দেশজুড়ে

৬৫২টি স্কুলে শুদ্ধভাবে জাতীয় সঙ্গীত শিখিয়েছেন তিনি

৫৫ ছুঁই ছুঁই চা শ্রমিকের সন্তান সুদর্শন রবিদাস ইতোমধ্যে সারা দেশের ৬৫২টি প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে শুদ্ধভাবে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার নিয়মাবলী শিখিয়েছেন। কোনো পারিশ্রমিক ছাড়াই রবিদাস এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে হেঁটে হেঁটে বিগত পাঁচ বছর থেকে শুদ্ধ জাতীয় সঙ্গীত শেখানোর মিশনে কাজ করছেন।

Advertisement

তার মতে বিদ্যালয়ে অ্যাসেম্বলিতে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার সময় সুর, তাল ও লয়ে ভুল থাকে। এ ভুলগুলো মানতে নারাজ সুদর্শন রবিদাস। তাই উচ্চারণ সঠিক করে জাতীয় সঙ্গীত শেখানোর কাজে ২০১৩ সালের ১৭ মার্চ থেকে যাত্রা শুরু করেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধানেরা এ কাজে তাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন।

কখনও খুব সকালে, কখনও দুপুর বেলাবেলায় তিনি ছুটে চলেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। শেখান দেশাত্মবোধক ও ছড়াগান। দেশমাতৃকার প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে অবিরাম ছুটে চলা এ মানুষটি হলেন সুদর্শন রবিদাস।

কোনো পারিশ্রমিক ব্যতীত নিজের দায়বদ্ধতা থেকে জাতীয় সঙ্গীত তালিম দিয়ে চলেছেন বলে তিনি জানান।

Advertisement

কুলাউড়ার উপজেলার রাঙ্গিছড়া চা-বাগানের দেবমণ্ডপ লাইনে স্ত্রী ও চার ছেলে নিয়ে তার অভাবের সংসার। এক ছেলে তার সহকারী হিসেবে কাজ করে, বাকি ৩ ছেলে প্রতিদিন ৮৫ টাকা মজুরিতে চা বাগানে কাজ করে। অভাব অনটনের মধ্যে বেড়ে ওঠা এ মানুষটির শৈশব থেকে সঙ্গীতের প্রতি অপরিসীম টান।

রবি দাস জাগো নিউজকে জানান, আট বছর বয়সে সঙ্গীত জগতে পা রাখেন তিনি। কাকা রাম নারায়ণ রবিদাসের হাত ধরে সঙ্গীত শুরু করেন। পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন শিক্ষকদের কাছ থেকে সঙ্গীত শিক্ষা লাভ করতে শুরু করেন। ১৯৯২ সালে লংলা চা বাগানে সপ্তসুর সঙ্গীত বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। দীর্ঘ আট কিলোমিটার পথ হেঁটে সেই বিদ্যালয়ে গানের ক্লাসে অংশ নিতেন তিনি। বিদ্যালয়ে সুদর্শন রবিদাসের সঙ্গীতে দৃঢ় দখল ও সুরে মুগ্ধ হয়ে সপ্তসুর সঙ্গীত বিদ্যালয়ের পরিচালক সুরকার নুরুল ইসলাম সরকারের সহযোগিতায় ১৯৯৩ সালে সিলেট বেতারে শতদল নামে সঙ্গীত পরিবেশন করেন। হঠাৎ সপ্তসুর সঙ্গীত বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাওয়াতে ১৯৯৪ সালে কুলাউড়ায় ডা. রজত কান্তীর প্রতিষ্ঠিত রুদ্রবীণা সঙ্গীত বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে একাধারে পাঁচটি বছর নজরুল পঞ্চম কোর্স সমাপন করে দ্বিতীয় অধ্যায় সমাপ্ত করেন তিনি।

ওই বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় বাংলাদেশ মহাবিদ্যালয় ধ্রুপদী সঙ্গীত বিদ্যালয়ে ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত তিন বছর মেয়াদি কোর্স সঙ্গীত ‘মুকুল’ সমাপ্তি করেন। এর পাশাপাশি সঙ্গীত ‘উপাধি’ কোর্স সমাপন করেন।

২০০১ সাল থেকে কুলাউড়া পৌর এলাকার মাগুরা নামক স্থানে প্রতিষ্ঠিত রবিদ্রবীণা সঙ্গীত বিদ্যালয়ে প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। সঙ্গীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের গান শেখানোর পাশাপাশি একেক দিন একেক বিদ্যালয়ে গিয়ে চলে শুদ্ধ করে জাতীয় সঙ্গীত শেখানো।

Advertisement

এরপর তিনি লক্ষ্য করেন বিভিন্ন স্কুলের অ্যাসেম্বলিতে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা ভুল সুর, তাল, লয়ে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করে থাকে। এ বিষয়টি তার মনে নাড়া দেয়। ভাবতে থাকেন কেমন করে শিক্ষার্থীদের জাতীয় সঙ্গীত শুদ্ধভাবে শেখানো যায়? ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে বাস্তবায়নের পথে পা বাড়ান। বিভিন্ন স্কুলের প্রধান শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কার্যক্রমে হাত দেন।

২০১৩ সাল থেকে ব্যাপক পরিসরে শুরু হয় তার শুদ্ধ সুর, লয়, তালে জাতীয় সঙ্গীত শেখানোর পালা। জেলার মক্তদীর বালিকা বিদ্যালয়, দক্ষিণ জাঙ্গিরাঈ মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, আমির সলফু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ দেশের প্রায় ৬৫২টি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শুদ্ধভাবে বিনাপারিশ্রমিকে জাতীয় সঙ্গীত শিখিয়েছেন তিনি। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণায় দিনদিন তার কার্যক্রম এগিয়ে চলছে।

রবি দাসের ইচ্ছা সারা দেশে জাতীয় সঙ্গীত শেখাবেন, কিন্তু যাতায়াতের খরচ না মেটাতে পেরে তিনি তা পারছেন না। এ বয়সে সুযোগ সুবিধা পেলে কি শেখাবেন? রবি দাসের উত্তর, আমার আত্মবিশ্বাস আছে আমি পারব, সহযোগিতা পেলে সারা দেশ চষে বেড়াব।

জেলার কুলাউড়ার রদ্রবীণা সঙ্গীত বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ রজত কান্তি ভট্টাচার্য বলেন, সুদর্শন শুদ্ধ জাতীয় সঙ্গীত শেখান। তার তাল, লয় ও সুর ঠিক আছে।

জাগো নিউজের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করার আবেদন জানালেন মৌলভীবাজারের জাতীয় সঙ্গীতের ফেরিওয়ালা নামে খ্যাত সুদর্শন রবিদাস। বাধ্যক্যজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে ভালো নেই রবিদাস। তার বিশ্বাস প্রধানমন্ত্রীর নজরে আসলে অবশ্যই তার আবেদন গ্রহণ করে দেখা করার সুযোগ দেবেন এবং সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবেন।

সম্প্রতি মৌলভীবাজার জেলা শিল্পকলা একাডেমি থেকে সুদর্শন রবি দাসকে সম্মাননা দেয়া হয়। সুদর্শন রবিদাস সর্ম্পকে জেলা কালচারাল অফিসার জ্যোতি সিনহা জাগো নিউজকে জানান, সুদর্শন রবিদাস নিজের আবেগের জায়গা থেকে নিজ উদ্যোগে এ মহান কাজটি করে যাচ্ছেন। এর জন্য উনি কোনো প্রতিদানও চান না। এমন মানুষ সমাজের মূল শক্তি। উনার জাতীয় সঙ্গীতের সুর তাল লয় সম্পূর্ণ ঠিক আছে।

রিপন দে/এমএএস/জেআইএম