বিশেষ প্রতিবেদন

মর্গের গেটে জীবনের কঠিনতম মুহূর্তের অপেক্ষা

পরিবারের সদস্য ঘরে ফিরবে। কত উল্লাস, কত আশা নিয়ে অপেক্ষা করে আপনজনরা। প্রিয়জনের দেশে ফেরার সংবাদ পাওয়ার পর থেকেই ক্যালেন্ডারে দিন গণনা শুরু। যেদিন আসবে সে দিন যেন সময়ই কাটে না। ঘরে প্রিয়জনের পছন্দের রান্না। বিমানবন্দরে ফেরার অপেক্ষা। বিমানবন্দরে বাইরের একপাশ থেকে কাঁচের ওপারে প্রিয়জনকে ঝাপসা দেখার জন্য বুকটা ছটফট করে। কতই না মধুর সেই অপেক্ষা।

Advertisement

তবে কাঠমান্ডুর বাস্তবতাটা একটু ভিন্ন। এখানে প্রিয়জনের জন্য পরিবারের সদস্যরা ঠিকই অপেক্ষা করছেন। কিন্তু কারো মুখে হাসি নেই। মুখটা অবশ্য গোমড়াও না। চোখে মুখে তাদের শূন্যতা ভাসছে। এই অপেক্ষা প্রিয়জনের মরদেহের অপেক্ষা। এই অপেক্ষা শেষবারের মতো প্রিয়জনকে হাত দিয়ে ছোঁয়ার, নিজ হাতে সৎকার করার। জীবনের কঠিনতম মুহূর্তের অপেক্ষা এটি।

সোমবার (১২ মার্চ) থেকে নেপালের কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন ইউনিভার্সিটি (টিইউ) টিচিং হাসপাতালের মর্গের গেটের সামনে কঠিনতম এ নির্মম অপেক্ষায় রয়েছেন ইউএস বাংলার নিহত যাত্রীদের স্বজনরা। সোমবার থেকেই নেপালিরা মর্গের গেটের বাইরে থেকে অপেক্ষা করছেন প্রিয়জনের মুখটি একবারের জন্য দেখতে। মঙ্গলবার (১৩ মার্চ) থেকে অপেক্ষার প্রহর গুণছেন বাংলাদেশিরাও।

নেপালের কাঠমান্ডুতে বাংলাদেশের বেসরকারি উড়োজাহাজ ইউএস বাংলার বিএস-২১১ বিধ্বস্ত হওয়ার পর থেকেই একে একে নিহতদের মরদেহ নেয়া হয় টিইউ টিচিং হাসপাতালের মর্গে। প্রিয়জনের মরদেহ শনাক্ত করতে অন্তত একবারের জন্য হলেও দেখতে চাচ্ছেন তারা। তবে আগুনে পুড়ে মরদেহ বীভৎস হয়ে যাওয়ায় ময়নাতদন্তের আগে মরদেহ দেখতে দিচ্ছে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

Advertisement

তবে মন কি আর মানে? ঘণ্টার পর ঘণ্টা মর্গের বাইরে অপেক্ষা করছেন নিহতদের স্বজনরা। মর্গের বাইরে অপেক্ষারত স্বজনদের সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের এ প্রতিবেদকের।

সুবিন্দ্রা সিং বোহরা, নেপালের নাগরিক। বাংলাদেশের একটি হোটেলে ক্যাসিনো পরিচালনার কাজ করতেন তিনি। ৭ দিনের ছুটিতে দেশে ফিরেছিলেন বিএস-২১১ ফ্লাইটে। কিন্তু কাঠমান্ডুর মাটিতে পা রাখার আগেই হয়েছেন পরকালের বাসিন্দা। তার মরদেহের জন্য মর্গের বাইরে অপেক্ষা করতে দেখা যায় তার ছোট ভাই দেব সিং বোহরাসহ চাচাতো ভাই এবং ভাগ্নেকে।

শনিবারের (১৭ মার্চ) আগে মরদেহ হস্তান্তর হচ্ছে না, এটা জানা সত্ত্বেও বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন তারা। জানতে চাইলে দেব সিং বোহরা জাগো নিউজকে বলেন, ‘শনিবারের আগে মরদেহ পাব না এটা চিকিৎসকরা আগেই বলেছেন। তবুও সারাদিন থাকি। প্রতিদিনই আসব। আমাদের সবকিছুই এখন ভাইয়াকে ঘিরে, তাই এখানেই থাকি সারাদিন।’

তিনি আরও বলেন, ‘ভাইয়াকে (সুবিন্দ্রা সিং বোহরা) শনাক্তের জন্য ইতোমধ্যে পরিচয় শনাক্তকরণের কয়েকটা চিহ্নের কথা চিকিৎসকদের জানিয়েছি। ভাইয়ার ডান হাত, কপালের ডান দিক এবং বাম পায়ের গোড়ালিতে পুরানো ক্ষত আঘাত রয়েছে। এসব লিখে দিয়েছি হাসপাতালের ফর্মে। চিকিৎসকরা বললেন, এগুলো না মিললে প্রথমে ফিঙ্গার প্রিন্ট দেখবে। তাতেও কাজ না হলে ডিএনএ টেস্ট করবে। মরদেহ পাওয়ার আগ পর্যন্ত এখানেই থাকব।’

Advertisement

এদিকে মঙ্গল ও বুধবার সারাদিনই বাংলাদেশিরাও ভিড় করেছেন মর্গের গেটের বাইরের ছাউনিতে। ইউএস বাংলার কেবিন ক্রু শারমিন আক্তার নাবিলার স্বজনদেরও দেখা গেছে মর্গের বাইরে। নিহতদের তালিকায় কেবিন ক্রু খাজা হোসেন ও কে এইচ এম শাফির নাম ছাপা হলেও নাবিলার স্বজনরা বলছেন ফ্লাইটে ক্রু হিসেবে ছিলেন নাবিলা। হয়তো তাকে শনাক্ত করতে না পারায় নামটি সংশোধন করা হয়নি। কাঠমান্ডুতে নাবিলার জন্য অপেক্ষারত তার ভাসুর (স্বামীর বড় ভাই) বাবলু জাগো নিউজকে বলেন, ‘নাবিলা মারা গেছে শুনে এসেছি। কিন্তু আমাদের দেখতে দেয়া হচ্ছে না।’

মর্গের বাইরে অপেক্ষারত ইউএস বাংলার ফ্লাইটের কো-পাইলট পৃথুলা রশীদের নানা এম এ মান্নান বললেন, ‘মরদেহ পাব কি না জানি না, অপেক্ষায় আছি।’

মর্গের বাইরে নেপালি ও বাংলাদেশি ছাড়াও চীনা যাত্রীর পরিবারকে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। গত সোমবার (১২ মার্চ) দুর্ঘটনার পর থেকেই মর্গের গেটে ২৪ ঘণ্টা ১০ জন করে সশস্ত্র নেপাল পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

গেটের দায়িত্বরত অবস্থায় গণেশ বিকে নামে নেপাল পুলিশের এক সদস্য জাগো নিউজকে বলেন, ‘দুর্ঘটনার পর থেকে আমাদের এখানে দায়িত্বপালন করতে বলা হয়েছে। মর্গে নিহতদের স্বজনসহ হাসপাতালের বাইরের কাউকে ঢুকতে না দেয়ার নির্দেশনা দেয়া আছে আমাদের।’

হাসপাতালে মরদেহ দেখতে না দেয়ায় নেপালে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাসকে জানিয়েছেন নিহতের পরিবারের সদস্যরা। এ বিষয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাশফি বিনতে শামস বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বলছে, মরদেহগুলো অধিকাংশ আগুনে পুড়ে বীভৎস হয়ে গেছে। এগুলো চোখে দেখে শনাক্ত করা সম্ভব নয়। অথবা ভুল শনাক্তের আশঙ্কা রয়েছে। তাই তারা আপাতত কাউকে দেখতে দিচ্ছে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘এছাড়া এখানকার হাসপাতালগুলোর প্রোসেস (কার্যপ্রক্রিয়া) একটু কমপ্লিকেটেড (জটিল)। আমরা প্রক্রিয়াগুলো শিথিল করার জন্য আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি।’

এদিকে গতকাল বুধবার (১৪ মার্চ) সন্ধ্যা পর্যন্ত মর্গে মোট ২২ জনের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। ময়নাতদন্তসহ মরদেহের শরীরের খুঁটিনাটি নিয়ে কাজ করছে হাসপাতালের ৩ জন অধ্যাপক, ৪ জন সহকারী অধ্যাপক, ৮ জন আবাসিক ডাক্তার, ৫ জন সহকারী এবং নেপাল পুলিশের ২৫ জন।

টিইউ টিচিং হাসপাতালের ফরেন্সিক মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রিজেন শ্রেষ্ঠ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আশা করছি শনিবারের (১৭ মার্চ) মধ্যে সব মরদেহের ময়নাতদন্ত শেষ করে হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরু করা যাবে। তবে অতি বীভৎস কোনো মরদেহ যদি শনাক্ত না করা যায় তাহলে সেগুলো ডিএনএ টেস্ট করা হবে। ডিএনএ টেস্টের জন্য পরিবারের কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হবে। পরে দুইটা মিলিয়ে দেখা হবে। নমুনা সংগ্রহ করে ডিএনএ টেস্টের ফলাফল জানতে সবমিলে ৩ সপ্তাহের মতো সময় লাগবে।’

এআর/আরএস/আরআইপি