এক দরিদ্র বাউল পরিবারে জন্ম। শৈশব-কৈশোর-যৌবনের বেশিরভাগ সময়ই কেটেছে চরম অভাব আর দৈন্যতায়। বাবা মধু বয়াতির ছিল ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ অবস্থা। ঘরহীন, সংসারহীন বাউল বাবার হাত ধরেই তার গানের ভুবনে পথ চলা। গানকে সঙ্গী করেই জীবনের সমস্ত ক্ষুধা নিবারণের এক জীবন্ত উদাহরণ কিংবদন্তি মমতাজ। কোনো বাধা-প্রতিবন্ধকতাই দমিয়ে রাখতে পারেনি গানপাগল মমতাজের স্বপ্নকে। গান দিয়েই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন তিনি। হাজারো দুঃখের মাঝে গান গেয়েই আনন্দ খুঁজে পান। গানেই প্রেম-ভালোবাস, গানেই বিরহ অনুভ‚ত করে চলছেন। ফলে সংসার জীবনের অস্থিরতা থাকলেও তা সঙ্গীত জীবনের কোনো ছন্দপতন ঘটাতে পারেনি। বরং নিজের সুর আর ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যতায় জনমানুষের আজ অতি কাছের মমতাজ। পালাগানে শুরু হলেও বিচ্ছেদ আর মুর্শিদী গানে প্রতিষ্ঠা পাওয়া। কেবল দেশেই নয়, দেশের বাইরেও মেলে ধরেছেন তার এই অসাধারণ প্রতিভা। আবার সঙ্গীত জীবনের বিশালতায় ঠাঁই দিয়েছেন রাজনীতি আর সামাজিক কর্মকাণ্ডকেও। ধলেশ্বরী পাড়ের সেই পালাগান শিল্পী মমতাজ আজ সংসদ সদস্যও। সঙ্গীত জীবন, রাজনীতি, সামাজিক ভাবনা, জীবনের অর্জন-বিসর্জন নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন তিনি। আত্মজৈবনিক সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সায়েম সাবুজাগো নিউজ : শৈশব দিয়েই শুরু করতে চাই। মমতাজ বেগম : ঢাকার শ্যামলীতে ১৯৭৬ সালে এক বাউল পরিবারে আমার জন্ম হয়। বাবা বিখ্যাত বাউল শিল্পী মধু বয়াতী। মা উজালা বেগম। বাবা মাকে নিয়ে তখন ঢাকায় থাকতেন। তবে মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার জয়মণ্ডপ ইউনিয়নের ভাকুম নামক গ্রামই আমার আসল ঠিকানা। আমি আমার জন্ম পরিচয় বলতে গেলে এ গ্রামের নামই বলে থাকি। কারণ শিশুকালেই বাবা-মার সঙ্গে গ্রামে চলে যাই। ওই গ্রামের ধূলিবালিতেই আমার বেড়ে ওঠা। জাগো নিউজ : পরিবার নিয়ে কি বলবেন? মমতাজ : আমার বাবার দুই পরিবার ছিল। আমার বড় মায়ের ঘরে এক ভাই ও তিন বোন। আর আমার মায়ের ঘরে আমি এবং আরও দুই ভাই রয়েছেন। বাউল বাবা বেশির ভাগ সময় বাইরেই থাকতেন। জাগো নিউজ : বাবা ঘরছাড়া। এ সময় সংসার চলল কীভাবে? মমতাজ : হ্যাঁ, একপর্যায়ে বিষয়টি এমন দাঁড়ালো যে আমরা ক্রমেই বড় হচ্ছি, আর বাবা ঘরছাড়া হচ্ছেন। সংসারের কোনো চিন্তা করতেন না। দাদার রেখে যাওয়া সম্পত্তি একের পর এক বিক্রি করতে থাকলেন। দীর্ঘদিন বাবা বাড়িতে না থাকায় মা অন্যের কাছে ধারদেনা করে সংসার চালাতেন। চাচারা সহযোগিতা করতেন। এরপর বাবা বাড়িতে এসে দেখতেন, অনেক টাকা ঋণ হয়ে গেছে। পরে ওই পাওনাদারের কাছে আরও কিছু টাকা নিয়ে জমি বিক্রি করতেন। এক সময় বাড়ির ভিটা এক চিলতে জায়গা ছাড়া কিছুই আর থাকল না। এরপর থেকেই অভাব ছিল আমাদের নিত্যসঙ্গী। কারণ, তখন আর বিক্রির কিছুই ছিল না। তবে চাচাদের সংসার আগের মতোই ছিল। জাগো নিউজ : বাবার এই বাউল জীবন চাচারা কীভাবে দেখতেন? মমতাজ : আমার বাবা ভালো গান করতেন। প্রথম দিকে চাচারা উৎসাহ দিতেন। কিন্তু এক সময় বাবার এই ছন্নছাড়া জীবন তারা অপছন্দ শুরু করলেন। মাও বাবাকে বলতেন, সংসার তো আর চলে না। একটু সংসারে নজর দাও। আবার আমি যখন গান শুরু করলাম তখন চাচারা আমার বাবাকে বলতেন, তুমি গান গাইতে গাইতে ফকির হইলা, এবার মেয়েটার সর্বনাশ করবা। মেয়ে গান করলে ওকে ভালো জায়গায় বিয়েও দিতে পারবা না। বরং পড়াশোনা করলে ভালো জায়গায় বিয়ে দিতে পারবা। আমার গান গাওয়াকে প্রথম প্রথম চাচারা মানতে পারেনি। বাবাকে অনেক নিষেধ করতেন। সংসার এবং বাস্তবতার কারণে বাধা দেয়ার যৌক্তিক কারণও ছিল। কারণ চাচারা তো আমাদের ভালোই চাইতেন। কিন্তু বাবা চাচাদের বাধা মানেননি। জাগো নিউজ : তাহলে শৈশব কি ঢাকাতেই কেটেছে? মমতাজ : না, শৈশব ঢাকায় কাটেনি। আমার বয়স যখন চার বছর তখনই বাবা মাকে নিয়ে গ্রামে চলে যান। শৈশব গ্রামেই কেটেছে। গ্রামেই বাবার কাছে গান শুনতাম এবং শিখতাম। জাগো নিউজ : গ্রামের শৈশব। কেমন কেটেছে সেই সময়ের দিনগুলো? মমতাজ : ধলেশ্বরী নদী হচ্ছে আমাদের বাড়ির একেবারে কাছে। শৈশবের বেশিরভাগ সময়ই আমার নদীতে কেটেছে। নদীতে সাঁতার কাটাই ছিল আমার প্রধান কাজ। নদী দিয়ে বড় বড় পাল তোলা নৌকা যেত। আমরা ছেলেমেয়েরা পিছনের বৈঠা বেয়ে নৌকায় উঠতাম। সঙ্গে যারা থাকত তারা মাঝিদের বলত, মমতাজ গান গাইতে পারে। মাঝিরা আমার গান শুনত। গান শুনে আমাদের কখনও কখনও দুপুরে খাওয়াইত। বাড়ি থেকে আনা ফলমূল দিত। মাঝিরা অনেক আদর করত। এভাবে গান গাইতে গাইতে দুই-তিন মাইল উজানে চলে যেতাম। আবার নৌকা থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে নেমে সাঁতার কেটে আমাদের ঘাটে চলে আসতাম। সে মজা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। আমি বাড়ির কাজ করতাম না। বাড়ির সবার ছোট ছিলাম বলেই হয়ত বেশি ডানপিটে ছিলাম। মা-ভাবিরা অনেক বকত। ভাবিরা বলত, ‘ও মাইয়্যা মানুষ। ছেলেদের মতো চলাফেরা। সারাক্ষণ দস্যির মতো ঘুরে বেড়ায়। ছেলেদের মতো নদীতে সাঁতার কাটে।’ অনেক সময় মার কাছে নালিশ করতেন তারা। দাঁড়িয়াবান্দা, গোল্লাছুট, বউছি খেলা নিয়েই দিন কাটত। ছেলেমেয়ের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ ছিল না। সবাই মিলেমিশে খেলাধুলা করতাম। গরমের দিনে জ্যোৎস্না রাতে গ্রামের মাঠে গোল্লাছুট খেলার মজাই আলাদা। মধ্য রাত পর্যন্ত মাঠেই থাকতাম। স্কুল যাওয়া আর খেলাধুলা নিয়েই সময় পার করেছি। গ্রামে যাত্রা গান হতো। গ্রামের মানুষই অভিনয় করত। আমরা রাত জেগে দেখতাম। পরের দিন আবার আমরা ওই অভিনয়গুলো নকল করে দেখাতাম। মেয়েদের মধ্য থেকেই কেউ নায়ক আবার ছেলেদের মধ্য থেকে কেউ নায়িকা হতাম। ওইভাবেই সাজতাম। ডায়ালগ দিতাম। এমন কোনো খেলাধুলা বা কাজ নেই যা আমি করিনি। ছেলেরা যা করত আমিও তাই করতাম। শুধু করতাম না ঘরের কাজ। ঘরের কাজ করা আমি কখনও পছন্দ করিনি। এখনও করি না। জাগো নিউজ : শৈশবের এই দস্যিপনা নিয়ে কোনো স্মৃতি মনে পড়ে? মমতাজ : অনেক স্মৃতিই তো আছে। শৈশব স্মৃতিই মজার স্মৃতি। আমার দুরন্তপনা নিয়ে ভাবিরা কিছু বললেও মা তেমন কিছু বলেনি। মা প্রচুর কাজ করতেন। এখনও করেন। গ্রামের মায়েরা যেমন হয়। কাজ ছাড়া মা কিছুই বোঝেন না। কিন্তু ভাবিরা চাইতেন যে, আমি বাড়ির কাজ করি। ননদদের নিয়ে ভাবিদের যে রকম ভাবনা হয় আর কী। ভাবিরা আমাকে নিয়ে মাকে নালিশ করলেও মা পাত্তা দিতেন না। মা বলতেন, আমি তো তোমাদের দশ জনের কাজ একাই করি। আমার মেয়ে কাজ করে না তাতে হিংসা কেন। তবে একদিন মার কাছেও ধরা খেয়ে যাই। বাড়িতে অনেক মুরগির বাচ্চা ফুটেছে। আমাদের বাড়ির পাশেই বটগাছে একটি চিলের বাসা ছিল। বিকাল হলেই চিল এসে মুরগির বাচ্চা ধরে নিয়ে যেত। মা ওইদিন আমাকে বলল দেখ মমতাজ, ‘আমি রান্না করছি। তুই কিন্তু আজ খেলতে যাবি না। মুরগির বাচ্চা পাহারা দে।’ মার কথা শুনে আমি বললাম দুর ছাই, আমি বাচ্চা টাচ্চা পাহারা দিতে পারুম না। এই বলেই এক দৌড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছি। যেই না বাড়ি থেকে চলে গেছি, তখনই চিল এসে বাচ্চা নিয়ে গেছে। আর কোথায় যায়। এবার তো মায়ের পালা। বাড়িতে আসলে মা তো দিল ইচ্ছামতো উত্তম মধ্যম। বকুনিরও শেষ নাই। জাগো নিউজ : এরপর? মমতাজ : আমি তো কান্নাকাটি করে অস্থির। আগেই বলেছি, আব্বা আমাকে খুব ভালোবাসত। আব্বা আমার নাম খুবই সুন্দর এবং শুদ্ধ করে ঢাকতেন। আব্বা রাতে বাড়িতে খেতে বসেই জিজ্ঞেস করতেন আমি খেয়েছি কিনা। আর কারও কথা জিজ্ঞেস না করলেও আমার কথা জিজ্ঞেস করতেন। ঘুম থেকে ডেকে তুলে আমাকে খাওয়াতেন। তো ওই দিন রাতে বাড়িতে এসে আব্বা দেখছেন যে, আমার মন খুব খারাপ। আমি কান্নাকাটি করছি। ঘটনা শুনে তো আব্বা মায়ের ওপর ভীষণ রাগ। মাকে সেই রকম বকুনি দিলেন। ওইদিনের স্মৃতি মনে একেবারে গেঁথে আছে। বাবা আমাকে কখনও বকুনি দেয়নি, মারধরও করেনি। জাগো নিউজ : মমতাজ নাম রাখার প্রেক্ষাপট জানতে পেরেছিলেন? কার ইচ্ছাতে এ নাম? মমতাজ : বাবা-মায়ের দুজনের ইচ্ছাতেই এ নাম রাখা। আমার বড় দুই ভাই হওয়ার কারণে মায়ের খুব ইচ্ছা ছিল যেন পরবর্তী সন্তান মেয়ে হয়। মায়ের কাছে গল্প শুনেছি, আমি যখন তার গর্ভে ছিলাম তখন একদিন রাতে মায়ের কাছে আমার নামকরণ নিয়ে বাবা আলোচনা করছিলেন। মা বলছিলেন, এবার ছেলে সন্তান হলে আমি লালন পালন করব না। আমার এবার মেয়ে চাই। ছেলে হবে নাকি মেয়ে হবে তখন তো আর পরীক্ষা করে দেখার সুযোগ ছিল না। বাবা তখন নাকি মাকে বলছিলেন, মেয়ে হলে নাম রাখব মমতাজ। এভাবেই গর্ভে থাকা অবস্থাতেই আমার নাম রাখা হয়। মূলত বাবার ইচ্ছাতেই এই নাম। আমি দেখেছি, বাবার মতো করে আর কেউ আমার নাম ধরে ডাকতে পারেনি।জাগো নিউজ : সম্রাট শাহজাহানের প্রেয়সী মমতাজ। তাজমহল প্রেমের অতুলনীয় নিদর্শন। সম্রাট শাহজাহানের মমতাজের সঙ্গে নিজের নামের সার্থকতা কখনও মিলিয়ে দেখেছেন? মমতাজ : দুটোতেই প্রেম, ভালোবাসা রয়েছে। মমতাজের প্রতি সম্রাট শাহজাহানের ছিল মধুর প্রেম। আর আমার বাবা-মাও প্রেমের মধ্য থেকেই আমার নাম রেখেছেন। আমার প্রতি বাবা-মার এই প্রেম হচ্ছে বাৎসল্য প্রেম। প্রেম হচ্ছে পাঁচ প্রকার। মমতাজের মধুর প্রেমের মর্যাদা দিয়ে শাহজাহান তাজমহল গড়েছেন। আর আমার বাবা-মা বাৎসল্য প্রেমে মগ্ন হয়ে আমার নাম রেখেছেন। বাবা-মার এই প্রেমকে আমি সম্রাট শাহজাহানের প্রেমের চেয়ে খাটো করে দেখি না। বাবা-মা বেঁচে থেকেই আমার নামের সার্থকতা দেখে গেছেন। বাংলার ১৬ কোটি মানুষ আমাকে ভালোবেসে যে তাজ পরিয়েছেন তার মর্যাদা কী সম্রাট শাহজাহানের তাজমহলের চেয়ে কম? আমার গানের প্রতি গণমানুষের এই প্রেমকে আমি আরও অনেক বড় দেখি। জাগো নিউজ : কখন, কোন স্কুলে পড়ালেখা শুরু? মমতাজ : আগে তো গ্রামের ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে স্কুলে যেত। আমার বেলাতেও তাই হয়েছে। আমি ৭ বছর বয়সে স্কুলে যাওয়া শুরু করি। অন্যের দেখাদেখি অনেকটা নিজ উদ্যোগেই স্কুলে যাওয়া শুরু করি। আগে ‘বি’ ক্লাসে পড়তে হতো। এরপর ক্লাস ওয়ানে। আমার পাশের বাড়ির এক হিন্দু ছেলে ‘বি’ ক্লাস থেকে ওয়ানে উঠল। আমি তখন তার ‘বি’ ক্লাসের বইগুলো কিনতে চাইলাম। বইয়ের দাম হলো ৭ টাকা। আমি তখন তাকে বললাম, ঠিক আছে বইগুলো আমাকে দাও, আমি স্কুলে যেতে থাকি। টাকা পরে দেব। বই নিয়ে আমি মাকে বললাম, নিকুঞ্জের কাছ থেকে বই কিনেছি। ওকে ৭ টাকা দিতে হবে। পরে মা মুরগি বিক্রি করে সেই বইয়ের দাম দেয়। এভাবেই প্রথম স্কুলে যাওয়া। জাগো নিউজ : স্কুলের শিক্ষকদের কেমন পেলেন? মমতাজ : স্কুলে যাওয়ার পরেই তো স্যারদের আমার প্রতি চোখ পড়ে গেল। স্যাররা বললেন, মধু বয়াতির মেয়ে স্কুলে ভর্তি হয়েছে। ও অবশ্যই গান গাইতে পারবে। স্কুলে অনুষ্ঠান হলেই আমার ডাক পড়ত। আমারও লজ্জা-শরম একটু কম ছিল। কেউ শুনতে চাইলেই ঝটপট শুনিয়ে দিতাম। হাটে, ঘাটে, রাস্তায় কেউ গান শুনতে চাইলেই বলে ফেলতাম। কোনো বাছ-বিচার করতাম না। আগেই বলেছি, গোসল করতে গিয়ে নৌকায় উঠে মাঝিদের গান শোনাতাম। একদিন তো মাঝিরা গান শুনে খুশি হয়ে আমাদের কয়েক বান্ধবীকে কাঁঠাল ভেঙে খাওয়ালেন। শুধু তাই নয়, মাঝিদের একজন আমাকে ৫ টাকা বকশিশও দিলেন। গান গাওয়ার প্রথম বকশিশ। জাগো নিউজ : গানে প্রথম বকশিশ পেয়ে কেমন লাগল? মমতাজ : বাপরে বাপ ৫ টাকা বকশিশ। সে আনন্দ আর ধরে না। তখন ৫ টাকা মানে বিরাট কিছু। কিন্তু টাকা নিয়ে পড়লাম আরেক বিপদে। পরনে তো কেবল একটি হাফপ্যান্ট। টাকা রাখি কোথায়। দুই মাইল উজান থেকে নদী সাঁতরায়ে ঘাটে আসতে হবে। টাকা তো ভিজে যাবে। আমার এই বিপদ দেখে আরেক মাঝি একটি পলিথিনের কাগজ বের করলেন। পরে ওই টাকা পলিথিনে পেঁচিয়ে আমার কোমরের সুতার সঙ্গে গিট্টু দিয়ে দিলেন। এভাবেই টাকা নিয়ে বিপদ থেকে রক্ষা পেলাম। জাগো নিউজ : কী করলেন সেই টাকায়? মমতাজ : বাড়িতে এসে মাকে বললাম। আমি তো মহাখুশি। এর কয়েক দিন পরেই রথের মেলা। আমার টাকার গরম আর দেখে কে। রথের মেলা এলেই আমরা বান্ধবীরা চিন্তায় পড়ে যেতাম। মেলায় খরচ করব, সেই টাকার জন্য ঢেঁকি শাক, কচুর লতি, নদী থেকে কলমি শাক কুড়িয়ে বাজারে বিক্রি করতাম। আমরা অনেক কষ্টে দুই তিন টাকা যোগাড় করতাম। এবার রথের মেলায় তো আমার আর সে চিন্তা নেই। নগদ টাকা হাতে। মেলায় গিয়ে ৫ টাকায় অনেক কিছু কিনে ফেললাম। গান গাওয়ার টাকায় মেলায় খরচ করে অনেক মজা পেলাম। জাগো নিউজ : স্যারদের নিয়ে আর কোনো স্মৃতি মনে পড়ে? মমতাজ : স্যারদের যে আদর, ভালোবাস পেয়েছি তা কখনও ভুলতে পারব না। আগেই বলেছি, আমরা যখন বড় হতে থাকলাম তখন পরিবারে খুব অভাব যাচ্ছিল। অনেক সময় ঘরে চালও থাকত না। না খেয়ে স্কুলে যেতাম। বাবা খাবারের চালই আনতে পারেনি সেখানে স্কুলে টিফিনের টাকা প্রত্যাশা করা অসম্ভব ছিল। বাবা অনেক সময় খাতা-কলমও কিনে দিতে পারেনি। আমাদের অভাব-কষ্ট স্যাররা জানতেন। টিফিন হলে আমিও লুকিয়ে থাকতাম। কিন্তু স্যাররা খুঁজে খুঁজে বের করে বলতেন, তুই আমাদের সঙ্গে টিফিন করবি। তুই কোনো লজ্জা করবি না, আমাদের সঙ্গে টিফিন করে গান শোনাবি। গান শুনিয়ে অনেকদিন স্যারদের সঙ্গে টিফিন করেছি। এ কারণেই শৈশবে স্যারদের খুব কাছাকাছি হতে পেরেছিলাম। আমি কবিতাও আবৃত্তি করতে পারতাম। একবার তো কবিতা আবৃত্তি করে প্রথম হয়েছিলাম। আর গানের তো শেষ ছিল না। এক স্যার বলতেন, তুই লালনগীতি গাইতে পারবি। আমি বলতাম, পারব। এরপর আরেক স্যার বলতেন ভাওয়াইয়া গা। গাইতাম। গানে আমার কোনো ‘না’ ছিল না। পল্লীগীতি, লালনগীতি, মুর্শিদী, বিচ্ছেদ সবই গাইতাম। জাগো নিউজ : শৈশবেই গানে বিশেষ পারদর্শিতা। প্রথম কার কাছে, কীভাবে শিখলেন?মমতাজ : বাবার কাছ থেকেই প্রথম গান শেখা। বাবা প্রচুর গান গাইতেন। তবে বাবা প্রথমে বুঝতে পারেনি যে আমি গান গাইতে পারব। বাড়িতে বৈঠকি গানের আসর বসত। সেখানে বাবা কিচ্ছা শোনাতেন। পাড়ার লোকজন কিচ্ছা শুনতে আসতেন। হারমোনিয়াম নিয়ে কিচ্ছা বলার মাঝে মাঝে অনেক গান গাইতেন। আমি বাবার পাশে বসতাম। পরে বাবাও আমাকে তার সঙ্গে সঙ্গে গান ধরতে বলতেন। বাবাই আমার গানের প্রথম ওস্তাদ। জাগো নিউজ : স্কুল জীবনের বিশেষ কোনো ঘটনা মনে পড়ে? মমতাজ : তৃতীয় শ্রেণির ফাইনাল পরীক্ষা আমার জন্য একটি স্মরণীয় ঘটনা। বাবা কুমিল্লায় প্রোগ্রাম নিয়েছেন। সন্ধ্যায় চলে গেলাম। বাবা-মেয়ে সারা রাত অনুষ্ঠানে গান করেছি। সকাল ১০টায় পরীক্ষা শুরু হবে। আমি তো চিন্তায় অস্থির। সঙ্গে বই খাতা নিয়েছি। তবে পড়ার সময় বের করতে পারিনি। ফজর আজানের আগে গান শেষ হলো। আমি বাবাকে বার বার বলছি তাড়াতাড়ি চলো, পরীক্ষা দিতে হবে। ফজর আজানের পরপরই ট্রেনে রওনা হলাম। পরীক্ষার হলে যখন প্রবেশ করলাম, তখন বেলা ১১টা বাজে। দুই ঘণ্টার পরীক্ষার মধ্যে এক ঘণ্টা হয়ে গেছে। স্যাররা জিজ্ঞেস করলেন, বিলম্ব কেন? আমি বললাম, বাবার সঙ্গে কুমিল্লায় গান করতে গিয়েছিলাম। সকালে রওনা হয়েছি। স্যাররা বললেন ঠিক আছে, তুই নিশ্চিন্তে লেখা শুরু কর। তোর জন্য এক ঘণ্টা বাড়ানো হবে। তাই হলো। স্যারদের এই আন্তরিকতা তো কোনোদিন ভুলতে পারব না। জাগো নিউজ : গানের জন্য স্কুলে বিশেষ পরিচিত পেলেন। এসময় কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নেননি?মমতাজ : স্কুলে আমার কোনো বিকল্প ছিল না। গানে আমি সবসময় প্রথম হতাম। স্কুলগুলোর বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা শেষে নির্বাচিতদের নিয়ে সিঙ্গাইর উপজেলায় একবার প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। স্কুল থেকে আমাকে সেখানে পাঠানো হয়। এরশাদের আমলের ঘটনা। আমাদের আসনের জাতীয় পার্টির এমপি গোলাম সারওয়ার মিলন তখন মন্ত্রী। অনুষ্ঠানে তিনি প্রধান অতিথি। উপজেলা চেয়ারম্যানও ছিলেন। এই প্রথম এত মানুষের সামনে গান করছি। প্রথম গান গাওয়ার পর দর্শকরা অনুরোধ জানিয়ে বললেন, যে মেয়েটি গান করছে তাকে আমরা দেখতে পাচ্ছি না। ওকে টেবিলের ওপরে উঠানো হোক। আমি একেবারেই পিচ্চি ছিলাম। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি। দর্শকদের অনুরোধে তাই হলো। টেবিলের উপরে উঠে গান গাইলাম। গানে দর্শকরা মুগ্ধ। মন্ত্রী গোলাম সারওয়ার মিলন আমাকে দুই হাজার টাকা বকশিশ দিলেন। উপজেলা চেয়ারম্যান দিলেন পাঁচ শত টাকা। ওই অনুষ্ঠানে প্রায় তিন হাজার টাকার মতো বকশিশ পাই। ওই সময় তিন হাজার টাকা আমার জন্য অনেক বড় কিছু। স্যারদের কারণেই আমার এমন প্রাপ্তি। ওই দিনও আমার সঙ্গে এক স্যার ছিলেন। জাগো নিউজ : পড়াশোনা এবং গান গাওয়া এ দুটির মধ্যে কোনটিকে গুরুত্ব দিলেন? মমতাজ : আমার তো সবসময় গান গাওয়াই ভালো লাগত। বাবা মঞ্চে গান করতেন। বাবার সঙ্গে অনেকেই গান গাইতেন। মাইকে ক্যাসেট বাজত, তা দেখে মনে মনে খুব ইচ্ছা জাগত যে, কোনো দিন যদি আমি এভাবে গান গাইতে পারতাম। মঞ্চে উঠে মাইকে উচ্চৈঃস্বরে গান করব এমন ইচ্ছা ছোট বেলা থেকেই লালন করতাম। গানের প্রতি এই মুগ্ধতা এবং ভালোবাসা থাকার কারণে হয়ত পড়ালেখার স্বপ্নটা ক্রমেই ফিকে হতে থাকে। তবে বুঝতাম যে পড়ালেখা ছাড়া জীবনে বড় কিছু হওয়া যায় না। কিন্তু এটি বোঝার পরও গানের প্রতি ভালোবাসা কমাতে পারিনি। জাগো নিউজ : শৈশবে বন্ধুদের কেমন পেয়েছিলেন? মমতাজ : সত্যি কথা বলতে কী, পরিবারে অভাব ছিল বটে কিন্তু আমি যে ভাগ্য নিয়ে জন্মেছি তা হয়ত অনেকেরই নেই। মানুষের প্রতি মানুষের যে ভালোবাসা, আমি তা নিজের জীবন দিয়ে উপলব্ধি করতে পারি। ছোটবেলা থেকেই আমি মানুষের অসাধারণ ভালোবাসা পেয়ে আসছি। জীবনে অনেক স্টেজ পার করেছি। কিন্তু সব জায়গাতেই মানুষ আমাকে অতি ভালোবাসা দিয়েছে। স্কুলের বন্ধুরা থেকে শুরু করে গানের আসর, বাউল জগৎ, রাজনৈতিক অঙ্গনসহ সমস্ত জায়গায় মানুষ আমাকে খুব কাছে থেকে মূল্যায়ন করে। মানুষের কাছাকাছি থাকার জন্য আমিও আন্তরিক। মানুষের সঙ্গে মিশতে আমার মধ্যেও কোনো জড়তা কাজ করে না। সব শ্রেণির মানুষ আমাকে যেভাবে সাড়া দেয় তার চেয়ে বড় কোনো অর্জন আছে বলে আমার জানা নেই। ছোটবেলার বন্ধুদের যে ভালোবাসা তার তো তুলনা হয় না।জাগো নিউজ : বাবার সঙ্গে প্রথম কখন গান করলেন? মমতাজ : তখন শ্যামলীতে থাকতাম। আমি একেবারেই পিচ্চি। বাবা নিয়মিত মিরপুরে খাজা বাবার মাজারে গান করতে যেতেন। প্রতি সন্ধ্যায় সেখানে বাউলদের গানের আসর বসে। একদিন আমি বাবার সঙ্গে যাওয়ার জন্য বায়না ধরি। ফিরতে অনেক রাত হবে বলে বাবা আমাকে নেবে না। পরে মায়ের অনুরোধে বাবা আমাকে শাহ আলী বাবার মাজারে নিয়ে যায়। আমার বাবা, ওস্তাদ মালেক সরকার, মাতাল রাজ্জাক দেওয়ান, ইসলাম সরকার গান করছেন। আমি ওস্তাদ ইসলাম সরকারের কাছে বসা। অনুষ্ঠানের মাঝে ওস্তাদ ইসলাম সরকারের কাছে বায়না ধরলাম, কাকা আমি গান গাইব। কাকা বলছেন তুমি গান জানো? আমি বললাম, পারব। তখন ইসলাম কাকা বাবাকে বললেন, ভাই ভাতিজি যে গান গাওয়ার বায়না ধরছে। বাবা তো ধমক। বাবা বলেন, ও গান জানে নাকি। পারবে না। আমিও নাছোড়বান্দা। পরে ইসলাম কাকা দর্শকদের উদ্দেশে বললেন, আমাদের মধু বয়াতির পাঁচ বছরের মেয়ে মমতাজ আপনাদের গান শোনাবে। দর্শকদের হাতে তালি। যন্ত্রের সঙ্গে তাল, লয় ঠিক রেখে গাইলাম। কোনো ভুল হয়নি। সবাই তো অবাক। দর্শকরা মহাখুশি। প্রচুর টাকা বকশিশ পেলাম। দু’হাত টাকায় ভরে গেল। জাগো নিউজ : বাবা কী বললেন? মমতাজ : ইসলাম কাকা বাবাকে বললেন, মেয়ের সাহস দেখেন। ও পারবে। আপনি ওকে গান শেখান। তখন বাবা বললেন, বাড়ির গরু তো পালানের ঘাস খায় না। আমি গান ভালো করতে পারি বটে; কিন্তু ওস্তাদ ভালো নাও হতে পারি। আমি তো সময় দিতে পারব না। তখন ইসলাম কাকাই বাবাকে পরামর্শ দিয়ে বললেন, একমাত্র মাতাল রাজ্জাক দেওয়ানই পারে মমতাজকে গান শেখাতে। সে যেমন গায় তেমন শেখায়। মমতাজকে তার কাছে দিয়ে দেন। জাগো নিউজ : তাহলে এমন নাটকীয়তার মধ্যেই মাতাল রাজ্জাক দেওয়ানের সংস্পর্শে আসা? মমতাজ : হ্যাঁ, পরের দিন বাবা মাজারে গিয়ে দেওয়ানের সঙ্গে কথা বললেন। মাতাল রাজ্জাক দেওয়ান সবসময় নেশায় মগ্ন থাকত। সকালে ঘুম থেকে উঠেই তার নেশা করা শুরু হতো। রাজ্জাক দেওয়ান আমার বাবাকে কাকা বলে ডাকতেন। তিনি হচ্ছেন খালেক দেওয়ানের শিষ্য। আর বাবা ছিলেন খালেক দেওয়ানের আরেক শিষ্য ইউসুফ দেওয়ানের ছাত্র। ইউসুফ দেওয়ানকে বাবা চাচা বলতেন বলেই রাজ্জাক দেওয়ানও বাবাকে চাচা বলতেন। পরে আলোচনার এক পর্যায়ে বাবা রাজ্জাক দেওয়ানকে বললেন, আমি তো মমতাজকে গান শেখাতে চাই আর সে দায়িত্বটা আপনাকেই নিতে হবে। রাজ্জাক দেওয়ান বললেন, আপনার মেয়ে গান শিখবে, সে তো ভালো কথা। ওকে অবশ্যই গান শেখাব। এই তো শুরু হলো গান শেখার পালা। জাগো নিউজ : প্রাথমিক অবস্থায় শেখার ক্ষেত্রে কোন ধরনের গানে মনোযোগ দিলেন? মমতাজ : পালা গান, বিচ্ছেদ, মুর্শিদী সবই শিখতে শুরু করলাম। রাজ্জাক দেওয়ান প্রচুর গান লিখতেন। গান লেখায় তার কোনো তুলনা হয় না। তিনি কোথাও গান করতে গেলেই বাবাকে বলতেন, মমতাজকে নিয়ে আসবেন। পরে সেখানে তার লেখা পালা গান আমার ডায়েরিতে লিখে দিতেন। আমার সুবিধা ছিল, তিনি বাবাকে বুঝিয়ে দিতেন আর বাবা বাড়িতে গিয়ে আমাকে বোঝাতেন। অতি সহজেই আমি তা রপ্ত করতে পারতাম। এভাবেই পালা গানের পালা শুরু হলো। জাগো নিউজ : শাহ আলীর মাজারে কোন গানটি গাইছিলেন? মমতাজ : ‘আমি ভাবছিলাম কী এই হালে দিন যাবে রে সুজন নাইয়া, পার করো দুঃখিনী রাধারে’ এই গানটি ওইদিন মঞ্চে গাইছিলাম। তবে এই গানের আরও একটি ঘটনা আছে। গানটি বাবা নাকি কোনো একদিন বাড়িতেই প্রথম আমার কাছ থেকে শুনেছিলেন। আগেই বলেছি, অভাবেই আমাদের বেড়ে ওঠা। বৃষ্টি বাদলের দিন। বাবার প্রোগ্রামও নেই। বুঝতেই তো পারছেন বাড়ির কী হাল। ওইদিন বাবা বাড়ি ছিলেন না। দিনের বেলায় ঘরে শুয়ে শুয়ে গানটি গাইছিলাম। হঠাৎ বাবা বাড়িতে এসে শুনতে পান যে, কেউ একজন ঘরের ভেতর থেকে গান গাইছে। দুয়ারে দাঁড়িয়ে পুরো গানটাই নাকি তিনি শুনছিলেন আর মা বাইরে থেকে দেখছেন। গান শেষ হওয়ার পর বাবা আর ঘরে ঢোকেননি। তিনি আবার বাইরে চলে যান। ওইদিনই প্রথম বাবা আমার গান শুনতে পান।জাগো নিউজ : মঞ্চে প্রথম গাইলেন। কেমন লাগছিল? মমতাজ : ওই দিন তো ছিল আমার জীবনের একটি ইতিহাস। দু’হাতের মুষ্টিভর্তি টাকা। আনন্দ দেখে কে। বাবাকে বললাম, আমাকে একটি মাটির ব্যাংক কিনে দিতে হবে। টাকা দিয়ে এই করব, ওই করব কত পরিকল্পনা যে মাথায় চলে এলো তা বোঝানো যাবে না। গানের প্রতি উৎসাহও বেড়ে গেল। জাগো নিউজ : সঙ্গীত পরিবারের মেয়ে। দাদা বৈঠকি গান করতেন। বাবা বাউল ছিলেন। তখন পরিবার নিয়ে ভাবনাগুলো কেমন ছিল? মমতাজ : ছোটবেলায় তো অতসব বুঝতাম না। বাবার গান ভালো লাগত। বাবা যখন যে ঢংয়ে গান গাইতেন তখন সেটাই আমার কাছে ভালো লাগত। এলাকায় অনেক যাত্রা গান হতো। বাবাকে যাত্রা পালায় বিবেকের গান গাইতে দেয়া হতো। মেকআপ রুম থেকেই বাবা সুর ধরে মঞ্চে উঠতেন। সুর ধরলেই মানুষ বুঝতে পারতেন যে মধু বয়াতি গান গাইছেন। বাবার কণ্ঠে অসাধারণ পাওয়ার ছিল। যাত্রাপালার মাঝখানে বাবা যখন বাউলের বেশে সত্য কথা নিয়ে বিবেকের গান ধরতেন তখন নিজের মধ্যে আলাদা একটা অনুভূতি কাজ করত। বাবার প্রতি শ্রদ্ধা আরও বেড়ে যেত। একইভাবে দাদার গানেও উৎসাহ পেতাম। ভাবতাম এইভাবে যদি আমিও গাইতে পারতাম। জাগো নিউজ : পারিবারিকভাবে গানের জগতে বিচরণ। আপনাদের গান করা সে সময় সমাজের মানুষেরা কীভাবে দেখত। মমতাজ : যে কোনো বিষয় নিয়েই মানুষের মাঝে নেগেটিভ, পজিটিভ ধারণা কাজ করে। তখনও ছিল, এখনও আছে। মিডিয়ার এত প্রসারের পরেও মানুষ নেগেটিভ ধারণা থেকে বের হতে পারেনি। বিষয়টি এমন যে, কেউ একজন গান খুব পছন্দ করেন কিন্তু তার মেয়ে বা বোন গান করবেন তা মেনে নিতে পারেন না। সমাজের অনেকেই ভালো চোখে দেখতেন। আবার কেউ সমালোচনাও করতেন। এই বাধা যে অতিক্রম করতে পারে কেবল তারাই প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন। বাধা আসবেই। তাকে জয় করাই হচ্ছে সার্থকতা।জাগো নিউজ : বলছিলেন, বাবা অনেকটাই সংসার ছাড়া। বাউল বাবাকে নিয়ে মায়ের কী ভাবনা ছিল? মমতাজ : আমার মায়ের নাম উজালা বেগম। মা জীবনে খুবই কষ্ট করেছেন। বাবা ছিলেন উদাসীন। সংসারের সবকিছু মাকেই করতে হতো। তবে বাবার বাউল জীবন নিয়ে মা কখনও বিরক্ত হননি বরং অনেক পছন্দ করতেন। এক সময় আমিও বাউল জীবনে চলে গেলাম। আমার জন্য মায়ের কষ্টটাই ছিল সবচেয়ে বেশি। আমার এ পর্যায়ে আসার জন্য বাবার থেকে মায়ের ভূমিকা কোনো অংশেই কম নয়। জাগো নিউজ : যেমন?মমতাজ : ওস্তাদ মাতাল রাজ্জাক দেওয়ান যখন আমাকে গান শেখাতে আসতেন তখন মা-ই তার সেবা করতেন। ওস্তাদ প্রচুর পান খেতেন। আমার মাও পান খায়। কিন্তু মা খুব পরিপাটি একজন মানুষ। মা এখনও আমার চেয়ে অনেক গোছানো। বাবাও খুব পরিপাটি ছিলেন। বাবা নিজের কাপড় নিজে পরিষ্কার করতেন। একেবারে সাদা কাপড় পরতেন। ওস্তাদ রাজ্জাক দেওয়ান যখন বাড়িতে আসতেন তখন পানের পিকে পুরো বাড়ি ভরে যেত। মা পিক ফেলানোর বাসন দিলেও ওস্তাদের সেদিকে খেয়াল থাকত না। কিন্তু আমার ওস্তাদকে নিয়ে মা কোনোদিন বিরক্ত হননি। আবার অনেক সময় দেখা গেছে, বাড়ি থেকে তিন-চার কিলোমিটার দূরে কোনো গানের অনুষ্ঠান গান গাইতে হবে আর তখন আমি পায়ে হেঁটে যেতে চাইতাম না। রিকশা, ভ্যানও ছিল না। তখন মা আমাকে কোলে করে নিয়ে গানের আসরে রেখে আসতেন। আমার ওস্তাদ যখন গান শেখাতে আসতেন মা তখন তার গোসল থেকে শুরু করে সবই করতেন। শীতকালে পানি গরম করে দিতেন। গরমকালে সারাক্ষণ পাখার বাতাস করতেন। শিষ্য হিসাবে যা আমার করার কথা তা আমার মা করতেন। আমি এগুলো বুঝতামও না, অভ্যাসও ছিল না। মা নিজেই সেবাযতœ করে ওস্তাদের কাছ থেকে আমার জন্য কাজ আদায় করে নিতেন। লোকে বলত, সন্তানের জন্য মহিলা কত কষ্ট করছে। মূলত বাবার কাছ থেকে শুরু হলেও মায়ের পরিশ্রমের কারণেই শিল্পী মমতাজ হতে পারছি। জাগো নিউজ : বাউল জীবনের বাইরে বাবাকে কেমন দেখেছেন? মমতাজ : বাউলদের হিংসা থাকে না। বাবাও তাই ছিলেন। কখনও মিথ্যা কথা বলতেন না। কারও সঙ্গে ঝগড়াও করতেন না। বাবা একেবারে নিরীহ প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। বাবার কাছ থেকে কেবল ভালোবাসা আর আদরই পেয়েছি আমরা। কখনো চড়াও হতে দেখিনি। বাবা ছিলেন একজন সহজ-সরল ভালো মানুষ। বড় ধরনের কোনো চাহিদাও ছিল না তার। জাগো নিউজ : গান শেখার ধরনটা কেমন ছিল?মমতাজ : ওস্তাদ মাতাল রাজ্জাক দেওয়ান অনেক সহজভাবে আমাকে গান শেখাতেন। বাবার সঙ্গে যখন পালা গান করতাম তখনও রাজ্জাক দেওয়ানের শেখানো পদ্ধতিই অনুসরণ করতাম। যেমন, গুরু-শিষ্যের পালা যখন হতো, তখন আমি শিষ্যের পালা নিতাম। স্রষ্টা এবং জীবের মধ্যে পালা হলে আমি জীবের পালা নিতাম। একইভাবে শরিয়ত-মারফত পালার সময় আমি শরিয়ত পালা নিতাম। কারণ, মারফতের অনেক গোপন তথ্য জানতে হয়। আমি অত যুক্তি, প্রশ্ন জানতাম না। ওস্তাদ আমাকে যে প্রশ্নগুলো লিখে দিত তার মধ্য থেকেই জেরা করতে হতো। যে পালাগুলো সহজ ছিল সেই পালাগুলো আমাকে দেয়া হতো।জাগো নিউজ : বিখ্যাত বাউল শিল্পী রশিদ সরকারের সঙ্গে পালা গানে আপনার সফল জুটি। দু’জনে একসঙ্গে সারা দেশে পালা গান করেছেন। তার সঙ্গে কখন জুটি বাঁধলেন? মমতাজ : আমি তখন একটু একটু পালা গান শিখতেছি। একদিন শুনতে পেলাম যে, আমাদের মানিকগঞ্জের পুটাইল নামের এক জায়গায় পালাগানের আসর বসবে। গাইবেন বিখ্যাত বাউল শিল্পী রশিদ সরকার এবং আলেয়া বেগম। রশিদ সরকার তখন সারাদেশের হাতেগোনা চার-পাঁচ জন পালাগান শিল্পীর মধ্যে একজন। সারা দেশেই এক নামে পরিচিত। আমি বাবাকে বললাম যে, চলো গান শুনতে যাব। দিনের বেলায় গান। গিয়ে রশিদ সরকারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। তার বাড়ি সিঙ্গাইর সদরে। বাবার সঙ্গে অনেক গান করছেন তিনি। আমাকে দেখে বাবাকে বললেন, ওকে নিয়ে এসেছেন ভালোই হয়েছে। গান শুনতে পারবে। আমরা গান শোনার জন্য অপেক্ষা করছি। মানুষে মানুষে মাঠ কানায় কানায় ভরে গেছে। বেলা বাড়ছে কিন্তু আলেয়া বেগম আসছে না। দর্শক তো গান শোনার জন্য চিৎকার চেচামেচি শুরু করে দিল। এক পর্যায়ে রশিদ সরকার মঞ্চে উঠে দর্শকরদের উদ্দেশে দু’টি গান করে বললেন, আমাদের পালাগানের আরেক শিল্পী আলেয়া বেগম এখনও আসতে পারেনি। আপনারাই বলুন, কী করা যায়। তখন তো মোবাইলও ছিল না যে ফোন করে খোঁজ নিতে পারবে। শিল্পী আসেনি এই কথা শুনে তো দর্শক আরও অস্থির। তখন রশিদ সরকার বাবাকে বললেন, আপনি মমতাজকে পালা শেখাচ্ছেন। ও কি গাইতে পারবে। বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করল। আমি বললাম, ওনাকে গুরু-শিষ্য নিতে বলো। শিষ্যের পালা হলে আমি গাইতে পারব। তখন রশিদ সরকার মঞ্চে উঠে দর্শকদের বললেন, আলেয়া যেহেতু আসেনি আর আসবে কিনা তা বলাও যাচ্ছে না, তাই বিকল্প ভাবতে হচ্ছে। আপনারা চাইলে ছোট্ট একটি মেয়েকে নিয়ে আমি গাইতে চাই। ও মধু বয়াতির মেয়ে মমতাজ। গান শিখছে। আমরা গুরু-শিষ্যের পালা করব। দর্শকরা আপাতত শান্ত হলো। জাগো নিউজ : দর্শকরা বিশেষত আপনার কোন গান পছন্দ করত? মমতাজ : দর্শকরা আমার বিচ্ছেদ গান খুব পছন্দ করত। রাজ্জাক দেওয়ান, রশিদ সরকার এবং আমার বাবার কাছ থেকে নেয়া বিচ্ছেদগুলোই আমাকে পরিপূর্ণ করে তুলেছে। জাগো নিউজ : পড়াশোনা ছেড়ে গানের দলে গেলেন। কষ্ট হয়নি? মমতাজ : সে কষ্ট ভোলার নয়। আমি তো এখনও মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখি যে বইখাতা নিয়ে স্কুলে যাচ্ছি। আবার কখনও কখনও স্বপ্ন দেখি যে, পরীক্ষা শুরু হবে। কিন্তু গানের আসরে আছি। বই ব্যাগে করে নিয়ে গেছি কিন্তু পড়তে পারিনি। পরীক্ষার হলে সবাই লিখতেছে। আমি পারছি না। এই স্বপ্নগুলো এখনও তাড়া করে বেড়ায়। সত্যি কথা বলতে কি, আমি স্কুলে ভালো ছাত্রী ছিলাম। একবার পড়লেই মনে থাকত। আসলে পড়ালেখা কপালে ছিল না। কী আর করা। জাগো নিউজ : মঞ্চের জুটি জীবন জুটিতে পরিণত হলো। ওস্তাদ রশিদ সরকারকে বিয়ে করলেন কখন? মমতাজ : অল্প বয়সেই তার সঙ্গে বিয়ে হয়। বলতে পারেন বাল্যবিয়ে। রশিদ সরকারকে যখন বিয়ে করি, তখন আমার বয়স ১৫ কি ১৬ বছর হবে। আর ওস্তাদ রশিদ সরকারের বয়স ৪৫ বছরের ওপরে। জাগো নিউজ : কোন প্রেক্ষাপটে বিয়ে। কেমন দেখেছেন সংসার জীবনে বাউল রশিদ সরকারকে? মমতাজ : রশিদ সরকারের সংসার জীবনের চেয়ে তার সঙ্গে গানের জীবনই আমার মধুর ছিল। আসলে সংসার জীবনে রশিদ সরকারকে তেমন একটা সময় দেয়া হয়নি। আমি তার সঙ্গে গান করতাম। ১৫/১৬ বছর বয়সে তার সঙ্গে নানা জায়গায় গান করতে যেতাম। লোকে মন্দ বলত বলেই দু’জনের সম্মতিতে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া। আমার ইচ্ছা ছিল বড় শিল্পী হওয়ার। আর এ কারণেই হয়ত তাকে বিয়ে করা। আমার বয়স ছিল ১৬ আর তার বয়স ছিল ৪৫। ফলে স্বামী, সংসার কী তা আমার কাছে তেমন গুরুত্ব পেত না। এর চেয়ে তাকে ওস্তাদ হিসেবেই বেশি গুরুত্ব দিতাম। জাগো নিউজ : বিয়ের পর কোথায় থাকতেন? মমতাজ : আমি আমার বাবার বাড়িতেই থাকতাম। রশিদ সরকারের বাড়ি যাওয়া হয়নি। তবে বিয়ের পর রশিদ সরকারের সঙ্গেই গান করতাম। জাগো নিউজ : বাবাকে হারালেন কবে? মমতাজ : বাবার মৃত্যুর বেশি দিন হয়নি। তিনি ২০০৬ সালে ইন্তেকাল করেছেন।জাগো নিউজ : মাতাল রাজ্জাক দেওয়ান কখন মারা গেলেন? মমতাজ : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৩ সালে ওস্তাদ ইন্তেকাল করেন। জাগো নিউজ : তার মৃত্যুর পর নিজের মধ্যে কতটুকু শূন্যতা অনুভব করলেন?মমতাজ : আমার ওস্তাদের মতো জ্ঞানী মানুষ খুবই কম ছিল। গাইতেন, লিখতেন নিজের মতো করে। অত্যন্ত সহজ সরল মানুষ ছিলেন। মঞ্চে উঠে কথা বললে মানুষ অবাক হয়ে শুনত। তিনি যদি কাউকে গালিও দিতেন এরপরও মানুষ মনে করতেন যে এই গালির মধ্যে জ্ঞান আছে। মানুষ খুবই সমীহ করতেন তাকে। তিনি বাইরেও যেমন ছিলেন ভেতরেও তেমন ছিলেন। এরকম একজন ওস্তাদ হারানোর পর যে শূন্যতা দেখা দেয় তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। এখনও মনে হলে স্থির থাকতে পারি না। জাগো নিউজ : দুঃখের দিনে বাবার সঙ্গে বন্ধুর মতো গান করেছেন। সুখের দিনে হারালেন। মমতাজ : আমার বাবা সুখ দেখে গেছেন। আমার হাসপাতালগুলো দেখে গেছেন। আমার অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও তার হাত দিয়েই করা। মহাখালীর এই বাড়িতেও তিনি থেকে গেছেন। ২০০৬ সালে যখন এই বাড়িতে উঠি তখন বাবা খুবই অসুস্থ। বাবার বøাড ক্যান্সার হয়েছিল। অ্যাপোলোতে চিকিৎসা করিয়েছি। আমার এই বাড়িতে রেখে তাকে কেমো থেরাপি দেয়া হয়। কিন্তু তিনি এখানে থাকতে চাইতেন না। তিনি বলতেন, আমাকে গ্রামের বাড়ি নিয়ে চলো। সেখানে বড় একটি ড্রয়িং রুম ছিল। জীবনের শেষ বেলা পর্যন্ত বাবা সেখানে বসেই সকলের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন। বাবার প্রিয়জনরা রাতভর কাছে বসে গল্প করেছেন। গান শুনিয়েছেন। বাবা যখন একেবারেই অন্তিম শয্যায় তখন একদিন আমার কাছে গান শুনতে চাইলেন। আমি তখন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছি না। মনে হলো, সব গান ভুলে গেছি। বাবাকে বললাম, বাবা আমি গান মনে করতে পারছি না। পাথরের মতো বুক ভার হয়ে গেল। তখন বাবা বললেন, মাতাল রাজ্জাক দেওয়ানের একটি গান শোনাও। জাগো নিউজ : কোন গান শোনালেন? মমতাজ : ‘সুখ পাখিটি গেছে মারা একটি তীরের আঘাত খাইয়্যারে, আমি আজও কান্দি পাখিটির লাইগ্যারে’ এই গানটি শোনালাম। গানটি মাতাল রাজ্জাক দেওয়ানের লেখা। যখন গাইছিলাম তখন আমার কণ্ঠ ধরে আসছিল। আমি গানটি শেষ করতে পারিনি। তখন বাবা বললেন, তুমি নামের অন্তরাটি গাইলে না। গানে ওস্তাদের নাম নেয়া হচ্ছে আদব। যারা গান লেখেন, সুর করেন তাদের নাম শেষ অন্তরায় নিতে হয়। তার মানে বুঝতেই পারছেন গানের প্রতি বাবার কী মনোযোগ ছিল। এটি বাবার মৃত্যুর চার পাঁচ দিন আগের ঘটনা। জাগো নিউজ : গানে মানুষের প্রেম জাগিয়ে তোলে। আপনার ব্যক্তি জীবনে কখনও প্রেম আসেনি? মমতাজ : জীবনে প্রেম আসেনি, তা বলা ঠিক হবে না। প্রতিটি মানুষের জীবনেই প্রেম আসে। কিন্তু আমার জীবনে প্রেম ছিল গৌণ। আমার গানের জগতের সামনে প্রেমের ভাবনা কখনও দাঁড়াতে পারেনি। জীবনে প্রেম যতটুকু উপলব্ধি করতে পেরেছি সেটুকু নিয়েই থাকার চেষ্টা করেছি। বাড়তি কিছু ভাবি না। আমার প্রেম গানের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। ব্যক্তি জীবনের প্রেমের চেয়ে গানের সঙ্গে প্রেম করেই বেশি আনন্দ পেয়েছি। এ জন্য আমি মনে করি, অন্যের প্রেম আর আমার প্রেমের ধরন আলাদা। জাগো নিউজ : এই পরিণতি বয়সে এখন প্রেমকে কেমন উপলব্ধি করছেন? মমতাজ : আমি আমাকে নিয়ে থাকতেই বেশি পছন্দ করি। আমার স্বামী, সন্তান বা মাকে ভালোবাসার চেয়ে নিজেকে বেশি ভালোবাসি। নিজের সঙ্গেই নিজে প্রতিনিয়ত প্রেম করে যাচ্ছি। আমার এই প্রেম, ভালোবাসার জগৎ থেকে যে যতটুকু নিতে পারে সেটা তার ব্যাপার। যার সঙ্গে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই বিনিময় হয়ে থাকে। না পাইলে আপত্তি থাকে না। আমি তো মানুষের মাঝেই আছি। জাগো নিউজ : রাজনীতিতে কখন জড়ালেন? মমতাজ : আমার বাবা বাদে বংশের অনেকেই ভালো অবস্থায় ছিলেন। আমার এক দাদা দীর্ঘদিন যাবৎ আমাদের ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি এবং আত্মীয়স্বজন আগে থেকেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ লালন করতেন। আর রশিদ সরকারও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ’৯৬-এর নির্বাচনে আমি আওয়ামী লীগের নির্বাচনের পক্ষে প্রচুর গান করি। এভাবেই এই দলটির প্রতি বিশেষ আকর্ষণ তৈরি হয়। পরে ’৯৫-’৯৬-এর দিকে সিঙ্গাইর থানা আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা নির্বাচিত হই। আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে আমাকে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাংসদ নির্বাচিত করা হয়। আমি সংস্কৃতি বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। জাগোনিউজ : একজন তরুণ সাংসদ হিসেবে কেমন দেখলেন রাজনীতি? মমতাজ : আমি যদি দল এবং মঞ্চের বাইরে গিয়ে মন্তব্য করি তাহলে বলব, অভিজ্ঞতা খুব ভালো নয়। আমরা মানুষের জন্য রাজনীতি করি বলে ভোট নিয়ে ক্ষমতায় আসি, কিন্তু মানুষকে দেয়া কথা রাখি না। সাধারণ মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে কোনো কমিটমেন্ট রাখতে পারি না। আমার কাছে এটিই সব চেয়ে কষ্টের। আওয়ামী লীগ-বিএনপির কাছে মানুষের অনেক প্রত্যাশা। কিন্তু সে প্রত্যাশা অপূর্ণই থেকে যায়। বলে আমি মনে করি। জাগোনিউজ : এখন সংসার জীবনে কেমন আছেন? মমতাজ : সবকিছু মিলে আমি খুব ভালো আছি। আমার তিনটি সন্তান নিয়ে অনেক সুখে আছি। বাউল মানুষ। ভালো মন্দ নিয়েই আছি। বেশি সুখও ভালো না আবার বেশি দুঃখও ভালো না। দুটোতেই বাউল জীবনের ব্যাঘাত ঘটে। জাগোনিউজ : এখন কি স্বপ্ন দেখছেন? মমতাজ : আমি আমার নিজ গ্রাম ভাকুমে একটি জায়গা কিনেছি। যে জায়গাটি বাবা অভাবের তাড়নায় বিক্রি করেছিলেন। সেখানে বাউল কমপ্লেক্স নির্মাণ করার পরিকল্পনা রয়েছে। এই উদ্দেশ্যেই অবশ্য মমতাজ ফাউন্ডেশন করেছি। আমার শেষ ইচ্ছা হচ্ছে, মৃত্যুর পর যেন এই কমপ্লেক্স চত্বরেই আমাকে শায়িত করা হয়। আমার কবরের দু’পাশে বাবা-মায়ের কবর থাকবে। এটিই হবে আমাদের পারিবারিক মাজার। এই কমপ্লেক্স ভবনেই বাউল তত্ত¡ সংগ্রহশালা, বাউল একাডেমি এবং বাউল কলোনি তৈরি করব। মৃত্যুর পরেও যেন বাউলদের নিয়েই থাকতে পারি। এইচআর/এমএস
Advertisement