বিশেষ প্রতিবেদন

‘জুতা আর সিটবেল্টের মাথা দিয়ে জানালা ভাঙার চেষ্টা করি’ (অডিওসহ)

ইউএস-বাংলার বিধ্বস্ত হওয়া ফ্লাইটে স্ত্রী, ফুফাতো ভাই, ভাবি ও আড়াই বছরের ভাতিজাকে নিয়ে কাঠমান্ডু ঘুরতে যান মেহেদী হাসান। বিমানে প্রথমে বসেছিলেন ১৪-সি নম্বর সিটে। ল্যান্ডিংয়ের সময় জানালা দিয়ে দৃশ্য দেখবেন বলে স্ত্রী কামরুন্নাহার স্বর্ণাকে নিজের সিটের পাশে বাসান।

Advertisement

ফ্লাইটটি ক্র্যাশের পর নিজের পরা কেডস (জুতা) দিয়ে জানালা ভাঙার চেষ্টা করেন কিন্তু পারেননি। সিটবেল্টের ধাতব অংশ দিয়েও জানালার গ্লাস ভাঙার চেষ্টা করেন কিন্তু সে চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। পরে বিমানে ভাঙা অংশ দিয়ে স্ত্রী ও ভাবিকে বাইরে বের করে দেন, নিজেও বের হয়ে আসেন। কিন্তু ফুফাতো ভাই আর তার আড়াই বছরের সন্তানকে বাঁচাতে পারেননি মেহেদী। সে দুঃখ এখনও তাকে গ্রাস করে।

বিধ্বস্ত বিমান থেকে বের হওয়ার সময় মাথা-ঘাড়সহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত পান মেহেদী। দুবার সিটি স্ক্যান করা হয়েছে। বর্তমানে তিনি নেপালের কাঠমান্ডু মেডিকেল কলেজ (কেএমসি) হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন। জাগো নিউজের প্রতিবেদকের কাছে সেদিনের রোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা দেন তিনি।

মেহেদীর মুখে বিধ্বস্ত বিমান থেকে উদ্ধারের বর্ণনা

Advertisement

যাত্রার শুরু থেকে প্লেনে অনেক শব্দ হচ্ছিল। প্লেনটাতে আমার আন-ইজি (অস্বস্তিকর) লাগছিল। কাঠমান্ডু বিমানবন্দরে প্লেনটি ক্র্যাশ হওয়ার ১০-২০ মিনিট আগে কেবিন ক্রু’র পক্ষ থেকে আমাদের বলা হয়, ‘কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা ল্যান্ডিং করব। আমরা যাতে ভালোভাবে ল্যান্ডিং করতে পারি সেজন্য আপনারা সবাই সিট বেল্ট বেঁধে ফেলুন।’

ল্যান্ডিংয়ের (অবতরণের) আগে প্লেন একটু ঝাঁকুনি দেয়। তখনও ক্র্যাশ হয়নি। প্লেনটি প্রথমে একবার নিচে এসে আবার উপরে উঠে যায়। কিছুক্ষণ পর প্লেনটি বাম দিকে কাত হয়ে যায়। নিজ চোখে কয়েকটা প্লেন দেখেছি, সেগুলো এয়ারপোর্টে ছিল কি-না, আমি বুঝতে পারিনি। হঠাৎ প্লেনটা একটা বাউন্ডারিতে ধাক্কা খেয়ে ক্র্যাশ হয়।

ক্র্যাশের আগে কেবিন ক্রুরা কিছু বলেননি, কোনো জরুরি নির্দেশনাও দেয়নি। ক্র্যাশের সময় আমাদের সিটবেল্ট বাঁধা ছিল। ক্র্যাশ হওয়ার পর কীভাবে সিটবেল্ট খুলেছি তা বলতে পারব না। পায়ের জুতা ও সিটবেল্টের লোহার অংশ দিয়ে জানালা ভাঙার চেষ্টা করেছি, কিন্তু ভাঙছিল না। ততক্ষণে দেখি প্লেনের সামনের অংশ ভেঙে গেছে, সে অংশ দিয়ে আলো দেখা যাচ্ছে।

আমি সামনের খোলা অংশের দিকে এগিয়ে যাই, কিন্তু পর মুহূর্তে মনে পড়ে, ভেতরে আমার পরিবারের আরও চার সদস্য আছে। আমি আবার ভেতরে ঢুকি। দেখি ভাবি এগিয়ে আসছে, তাকে টেনে বাইরে বের করে দেই। এরপর আবার ভেতরে ঢুকে স্ত্রীকে ডাকি, তুমি কোথায়? সে বলে, আমাকে বের করো, জ্বলে গেলাম, পুড়ে গেলাম। তখন আমি তাকে টেনে বের করি। তৃতীয়বার ভেতরে ঢোকার মতো পরিস্থিতি ছিল না। তীব্র আগুন আর ধূসর ধোঁয়া। আমাদের তিনজনের তখনও জ্ঞান ছিল।

Advertisement

বিমানের বাইরে বের হওয়ার পর মাঠে সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্যকে দেখতে পাই। তারা আমাদের সাহায্য করে প্লেন থেকে দূরে নিয়ে যায়। বের হওয়ার ২-১ মিনিটের মধ্যে প্রচণ্ড শব্দে প্লেনটি বিস্ফোরিত হয় এবং আগুন ধরে যায়।

প্লেনের ভেতরে তেমন চিৎকার-চেঁচামেচি বা তেমন কোনো আওয়াজ পাইনি। ধোঁয়ায় চারপাশ অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। একটা সিট আরেকটা সিটের সঙ্গে আটকে গিয়েছিল। মানুষগুলো সিটে আটকে পড়েছিল। সবারই সিটবেল্ট বাঁধা ছিল। ভেতরে কোনো অক্সিজেন মাস্ক বা আগুন নেভানোর কোনোকিছু ছিল না। একটা অক্সিজেন মাস্কও দেখিনি।

প্রসঙ্গত, গত সোমবার নেপালের স্থানীয় সময় দুপুর ২টা ২০ মিনিটে চার ক্রু ও ৬৭ আরোহী নিয়ে বাংলাদেশি ইউএস-বাংলার বিএস-২২১ ফ্লাইটটি বিধ্বস্ত হয়। এতে ৫১ জনের প্রাণহানি ঘটে।

(বিশেষ দ্রষ্টব্য : ইন্টারভিউ এবং কথোপকথন রেকর্ড করার অনুমতি মেহেদী স্বাচ্ছন্দ্যে দিয়েছেন।)

এআর/আরএমএম/জেএইচ/আরআইপি