ভাষা নেই। অসময়ে এভাবে আবিদের চলে যাওয়া অপূরণীয়। কোনো কিছুতে তা আর পূরণ হওয়ার নয়। কিছু বলার ভাষা নেই। শুধু দোয়া করবেন ও যেন জান্নাতবাসী হয়।
Advertisement
এভাবেই শোকাহত হৃদয় নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন সোমবার দুপুরে নেপালে ইউএস বাংলার বিধ্বস্ত বিমানের ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতানের স্ত্রী আফসানা খানম টপি (৪০)।
বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর সোমবারই ৫০ জন নিহতের খবর পাওয়া যায়। তখনও বেঁচে ছিলেন আবিদ। আবিদ সুস্থ হয়ে ফিরবেন- এমন আশাতেই ছিল তার পরিবার। কিন্তু আবিদ আর ফিরলেন না। মঙ্গলবার সকালে তার মৃত্যুর সংবাদ আসে। সে খবরে আধার নেমেছে উত্তরা পশ্চিমের ১৩ নং সেক্টরের ১৮ নং সড়কের ৩৮ নং বাসায়। ওই বাসাটিই আবিদের।
মৃত্যুর সংবাদ নিশ্চিত হওয়ার পর মঙ্গলবার দুপুরে আবিদের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে আবিদের আত্মীয়-স্বজনদের ভিড়। ছেলে তানজিব বিন সুলতানের গলা জড়িয়ে কাঁদছেন টপি। বাবাহারা সন্তানকে নিয়ে কালো মেঘের ভেলায় অনিশ্চিত ভবিষ্যত ভাবনায় ব্যাকুল টপি।
Advertisement
বলছিলেন, ‘এমন করে চলে যাওয়া কল্পনাতীত। ও খুব ইনোসেন্ট এবং দক্ষ। ওর মতো মানুষ দুর্ঘটনায় পড়ে যাবে ভাবনাতীত। দোয়া চাই ওপারে ভাল থাকুক আবিদ।’
আবিদ সুলতানের বাবা এম ও কাশেমও পাইলট ছিলেন। আবিদরা ৫ ভাই। খুরশিদ মাহমুদ, সুলতান মাহমুদ, সেলিম মাহমুদ, আমির মাহমুদ সবাই প্রতিষ্ঠিত।
আবিদের ভাড়া বাসায় কথা হয় খুরশিদ মাহমুদের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, একমাত্র সন্তান তানজিব বিন সুলতান মাহি এবার ‘ও’ লেভেল পরীক্ষা দেবে। অসময়ে ও এতিম হলো। আমরা ভাই হারালাম। ও খুব পারদর্শী, ‘এক্সট্রা অর্ডিনারি।’ এমন দুর্ঘটনা মানতে পারছি না।
ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কিছু অনলাইন গণমাধ্যম ভুল বার্তা দিয়েছে। আবিদের নামটাও শুদ্ধ লেখেনি। টিভিতেও ভুল নামে স্ক্রল গেছে। এসব কারণে আমরা আরও বেশি প্রেসারে পড়েছি। ফাইনালি ওর মৃত্যুর খবর সবাইকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। ওর মৃত্যুর কারণ, দুর্ঘটনার কারণ ইউএস বাংলা, এক্সপার্টরা ভালো বলতে পারবেন। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খবর এসেছে পাইলটের কোনো ত্রুটি ছিল না।
Advertisement
তিনি বলেন, দুর্ঘটনায় যারা মারা গেছেন, তাদের প্রত্যেকে পরিবারকে যেন ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়, তাদের শোকাহত মুহূর্তগুলোকে যেন তাচ্ছিল্য করা না হয়। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত জরুরি। এটা নিয়ে যেন টক শোতে নেতিবাচক কোনো কথা না হয়, যেন শুনতে না হয়, প্রধানমন্ত্রী দেখছেন সব। আমরা ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত চাই।
‘আমার অনুরোধ, দ্রুত যেন আবিদসহ নিহতদের মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।’
আবিদদের গ্রামের বাড়ি নওগাঁ জেলারর রাণীনগরে। শ্বশুড়বাড়ি নাটোরে।
উল্লেখ্য, কাঠমান্ডুর নরভিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আবিদ মারা যান বলে মঙ্গলবার ভোররাতে তার উত্তরার বাসায় ইউএস বাংলার পক্ষ থেকে অবহিত করা হয়। সোমবার দুর্ঘটনার পরপরই বিমানটির কো-পাইলট প্রিথুলা রশিদ ও ক্রু খাজা হোসেন মারা যান। আজ গেলেন প্রধান পাইলট আবিদ সুলতান।
সোমবার দুপুর ১২টা ৫১ মিনিটে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ইউএস বাংলার বোম্বার্ডিয়ার ড্যাশ ৮ কিউ৪০০ মডেলের এস২-এজিইউ বিমানে ৭১ জন আরোহী নিয়ে কাঠমান্ডুর উদ্দেশে রওনা করেন পাইলট আবিদ। বিমানটি কাঠমান্ডুর ত্রিভূবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামার সময় রানওয়ে থেকে ছিটকে পড়ে এবং আগুন ধরে যায়।
ইউএস বাংলার বিধ্বস্ত বিমানের ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতান
ঠিক কী কারণে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছে সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে ইউএস বাংলার দাবি পাইলট আবিদের কোনো দোষ ছিল না। বরং ত্রিভূবন বিমানবন্দরের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল রুম (এটিসি) থেকে পাইলট আবিদকে বিভ্রান্তিমূলক নির্দেশনা দেয়া হয়।
ইউএস বাংলার কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম বলেন, ‘কন্ট্রোল টাওয়ারের সঙ্গে পাইলটের কথোপকথনের যে অডিও বের হয়েছে, সেখানে কন্ট্রোল টাওয়ারের কিছু মিস গাইডেন্স দেখেছি আমরা। আমরা তদন্তের পর সঠিক কারণ পুরোপুরি বলতে পারবো। প্রাথমিকভাবে আমরা বুঝতে পেরেছি ক্যাপ্টেনের এখানে কোনও দোষ নেই। কারণ, তার ৭০০ ঘণ্টারও বেশি ফ্লাইট পরিচালনা এবং এই এয়ারপোর্টে শতাধিক ল্যান্ডিং এর নজির আছে।’
নেপালের ইংরেজি দৈনিক নেপালি টাইমস কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে পাইলটের সর্বশেষ কথোপকথনের একটি অডিও রেকর্ড হাতে পেয়েছে। নেপালি এ দৈনিক বলছে, কন্ট্রোল রুম থেকে ভুল বার্তা দেয়ার কারণেই ককপিটে দ্বিধায় পড়েন পাইলট।
অডিও রেকর্ডের শুরুতে শোনা যায়, কন্ট্রোল রুম থেকে বিমানের পাইলটকে বিমানবন্দরের ডানদিকের দুই নাম্বার রানওয়েতে অবতরণের নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। পরে পাইলট বলেন, ঠিক আছে স্যার। নির্দেশনা অনুযায়ী পাইলট বিমানটি বিমানবন্দরের ডানদিকে নিয়ে যাওয়ার কথা জানান কন্ট্রোল রুমে।
কিন্তু ডানদিকে রানওয়ে ফ্রি না থাকায় তিনি আবারো কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এ সময় তাকে ভিন্ন বার্তা দেয়া হয়। এবারে প্রশ্ন করা হয়, আপনি কি বর্তমান অবস্থানে থাকতে পারবেন?
এ সময় পাইলট দুই নাম্বার রানওয়ে ফ্রি করার জন্য কন্ট্রোল রুমের কাছে অনুরোধ জানান। কিন্তু তাকে আবারো ভিন্ন বার্তা দেয়া হয়। এর কিছুক্ষণ পর পাইলট বলেন, স্যার আমি আবারো অনুরোধ করছি রানওয়ে ফ্রি করুন। এর পরপরই বিমানটি বিকট শব্দ করতে শুরু করে। কিছুক্ষণ পরই বিমানটি ত্রিভুবণ বিমানবন্দরের পাশের একটি ফুটবল মাঠে আছড়ে পড়ে।
এদিকে, বিধ্বস্ত বিমানটির নেপালি এক যাত্রী বলেছেন, ঢাকা থেকে স্বাভাবিকভাবেই বিমানটি উড্ডয়ন করে। কিন্তু কাঠমান্ডুতে অবতরণের সময় এটি অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করে।
‘হঠাৎ বিমানটি ঝাঁকুনি দিতে শুরু করে এবং এরপরই উচ্চ শব্দ হয়। আমি জানালার পাশেই বসে ছিলাম। জানালার কাঁচ ভেঙে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হই।’
জেইউ/আরএম/এইচএস/আরআইপি