মতামত

মার্চ মানেই মুক্তির আনন্দ

আমাদের বাঙলির ইতিহাসে মুক্তির আনন্দ খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় আমাদের বাংলা মুলুকের সীমানা নানা সময়ে নানা খন্ডে বিভক্ত ছিলো। আর সেখানে কিছুকাল একজন রাজা থাকেন । তারপর আচমকা দড়িতে টান পড়ে। আগের রাজা ভূপাতিত হয়ে নতুন রাজার আমদানি হয়। এভাবেই আমরা বাঙালিরা নানা মাত্রায় নানা রাজা-মহারাজা-বাদশা দ্বারা নানাভাবে বিভক্ত হয়ে শাসিত হয়েছি। শোষিত হয়েছি। বেঁচে-বেড়ে উঠেছি।

Advertisement

তবে, বিভক্তির মাত্রা মোটামুটিভাবে চরমে পৌঁছে বৃটিশ আমলে। তাদের “বিভক্তি এবং শাসন” (Divide and rule) সময়ে নিজেদের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ ধরে রাখার জন্য অতি সস্তা কিন্তু দারুণ অব্যর্থ ঔষধ ; বলা যায় এন্টিবায়োটিক সমতুল্য এক বটিকা প্রস্তত হলো। বটিকার নাম ধর্মতত্ত্ব। এ তত্ত্বে তারা বেশ সফল হলো।

মোটামুটি এ বটিকা খাইয়ে ১৯০ বছর ভারতবর্ষকে তাদের গোলাম করে রাখা সহজ হলো। আমাদের সে সময়ের রাজনীতিবদিরা এ বটিকা একবারে ভালো মতো গিলে খেলেন। সেই পরিক্রমায় দেখতে পাই, ১৯৪৭ এ বৃটিশরা যখন বিদায় নিলো তখন আমাদের এ ভারতবর্ষ ইন্ডিয়া এবং পাকিস্তান নামক দুটো দেশে বিভক্ত হলো; শুধু ধর্মের ভিত্তিতে।

কিন্তু আমরা পূর্ব বাংলার মানুষ, উৎসবপ্রিয় বাঙালিরা অবাক হয়ে দেখলাম যে আমাদের চাওয়া-পাওয়ার একদমই কোনো মূল্য নেই নতুন দেশ পাকিস্তানে। অথচ এ দেশের জন্য পূর্ব বাংলার বাঙালি মুসলমানদের রয়েছে দারুণ অবদান। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ শেরেবাংলার দেয়া লাহোর প্রস্তাব-ই মূলত পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ভিত্তিভূমি। তবুও আমরা বাঙালিরা আমাদের দেয়া লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে উপেক্ষিত হতে থাকলাম চরমভাবে।

Advertisement

আর সেই পটভূমিতেই দাঁড়িয়ে বাঙালিরা প্রথম নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করতে পারলো যে, পাকিস্তান আমাদের আসল ঠিকানা নয়। ধর্ম নয়; বরং ভাষাভিত্তিক বাঙালিত্বই আমাদের আসল ঠিকানা। আমরা বাঙালিরাই আলাদা একটা জাতি এবং সেটা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে। পাকিস্তানিরাও সেটা বুঝে গিয়েছিলো। তাই ওরাও প্রথমেই আমাদের ভাষার উপরে আঘাত হানলো।

আমাদেরকে আমাদের আসল জাতিসত্তা, আমরা যে বাঙালি, সেটা ভুলিয়ে দেয়ার মিশনে নেমে পড়লো। কিন্তু তাদের সে চেষ্টা সফল হলো না। তবে, পাকিস্তানের ২৩ বছরে সে চেষ্টা সবসময় চলেছে। আরবি বা রোমান হরফে বাংলা লেখার চেষ্টা , রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করণ- তারই অপচেষ্টা ছিলো। আর তাই ভাষা আন্দোলনই প্রথম আমাদেরকে আবার স্বাধিকারবোধের চেতনায় উজ্জীবিত করে। অসাম্প্রদায়িক এক জাতিগঠনে মনোনিবেশ করতে বাধ্য করে তোলে।

এ কারণে আমরা দেখি একজন তরুণ শেখ মুজিব ১৯৬২ সালেই বাংলার স্বাধীনতা নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন। সাংবাদিক কামাল লোহানী তার লেখা “রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীন বাংলা বেতার” বইয়ে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা কমরেড মনিসিংহ এবং খোকা রায়ের সাথে বৈঠকে তরুণ শেখ মুজিবের আলোচনার সূত্রে সে তথ্য উল্লেখ করেছেন।

মাওলানা ভাসানী ১৯৬৫ সালের জুনে ১৪ দফা দিলেন। আর তরুণ শেখ মুজিব ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ৬ দফা দাবি পেশ করেন।

Advertisement

তবে, আনুষ্ঠানিকভাবে ছয় দফা উত্থাপন করা হয় লাহোর প্রস্তাবের সাথে মিল রেখে ২৩ মার্চ ।(সূত্র: উইকিপিডয়া) । অথচ, একসময় দেখা গেলো ১৪ দফাকে টপকে ৬ দফাই বাঙালির মুক্তির সনদ হিসেবে বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে গেলো। আর ১৯৭১ এ এসে ৬ দফা স্বাধীনতার পথে সেতুবন্ধ হিসেবে ১ দফায় রূপান্তিরিত হলো।

অবাক করা ব্যাপার, যে মার্চে পাকিস্তানের জন্ম প্রস্তাব সে মার্চেই উত্থাপিত হলো পূর্ব বাংলার স্বায়ত্বশাসনের দাবি ৬ দফা। এর ঠিক ৫ বছরের মাথায় ২৬ মার্চ, ১৯৭১ এ ঘোষিত হলো বাংলার স্বাধীনতা। ব্যক্তি কিন্তু একজনই। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। অর্থাৎ,পাকিস্তানের সৃষ্টি লগ্নের মাসেই (২৩ মার্চ,১৯৪০ লাহোর প্রস্তাবের দিন) রচিত হয়েছিল তার মৃত্যুমাসও। তাই দেখা যায়, স্বায়ত্তশাসন থেকে বাংলার স্বাধীনতা- দুটোই রচিত হয়েছিলো ১৯৬৬ আর ১৯৭১ এর মার্চ মাসেই। পাকিস্তানের জন্ম এবং মৃত্যুর কি এক অপ্রত্যাশিত নিবিড় যোগসূত্র এই মার্চ মাস, তাই না?

এ মাসের ৭ তারিখে রেসকোর্স ময়দানে দেয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণ আজ বিশ্বের সম্পদ। বাঙালি হিসেবে এটাও দারুণ এক গর্বের ব্যাপার। এমন কৌশলী ভাষণ বিশ্বে আর দ্বিতীয়টি নেই। বিচ্ছিন্নতার ডাক দিয়েও বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে চিত্রিত করা গেলো না। পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা চুপচাপ তাকিয়ে দেখলো। কানে শুনে গেলো। কিন্তু বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া তাদের আর করার কিছুই রইলো না।

মার্চ যখন প্রতি বছর ঘুরে ঘুরে আসে তখন তা আমাদের কাছে মুক্তির আনন্দ বার্তা নিয়ে আসে। আজ যদি পাকিস্তানের দিকে তাকাই তাহলে মুক্তির এ আনন্দ শতগুণ বেড়ে যায়। পাকিস্তানে আজ কথায় কথায় বোমা ফোটে। ঈদের জামাত, মসজিদ, জানাজা কোথাও বাদ যায় না। তাদের অর্থনীতি আজ ভঙ্গুর দশায়। বলা যায় সে তুলনায় আমরা অনেক ভালো আছি।

যদিও আমাদেরকে আরো অনেক দূর যেতে হবে। কারণ প্রকৃত মুক্তি এখনও আসেনি। মানুষের সত্যিকারের ভাগ্য উন্নয়ন ছাড়া স্বাধীনতা অর্থবহ হয় না। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক পরিমন্ডলে এখনও নানা হতাশা বিরাজ করছে। সেগুলো থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে হবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিরাপদ করার লক্ষ্যে। বাঙালির যে উদার চরিত্র সেটাকে কালিমালিপ্ত করার অপচেষ্টা চলছে বহু বছর ধরে। তরুণ প্রজন্মকে দেশের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলা হচ্ছে ধর্মের নামে। পাকিস্তানেও দীর্ঘসময় ধরে এটা করা হয়েছে। তার ফলেই পাকিস্তান আজ এক অনিরাপদ দেশে পরিণত হয়েছে।

সহিংসতা , হিংসা এবং বিদ্বেষ-কখনই যে ভালো কিছু দিতে পারে না তার বড় উদাহরণ আজ পাকিস্তান। এখন পাকিস্তান চাইলেও আর সেপথ থেকে সহজে বের হতে পারছে না। সেটা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদেরকেও উদার সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।তরুণদেরকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে হবে। আর রাষ্ট্রকেই এ ব্যাপারে উদ্যোগী ভূমিকা নিতে হবে সবার আগে। তবেই, মুক্তির আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হবে।

লেখক : চিকিৎসক। সহযোগী অধ্যাপক, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগএনাম মেডিকেল কলেজ।

এইচআর/জেআইএম