মতামত

ব্রথেল নয়, চাই পুনর্বাসন কেন্দ্র

 

সাব্রিনারা তিন ভাই বোন। যতদূর মনে পড়ে, বাবা, মা, পরিবার ঘিরে ওর কোন সুখ স্মৃতি নেই। ছোট বেলার স্মৃতি মানেই ভয়ঙ্কর সব স্মৃতি। বাবা রোজ মদ খেয়ে মাকে বেধড়ক মারত, মা ভয়ে, ব্যথায় আর্তনাদ করতো। আর প্রচণ্ড ভয়ে ওরা ছোট ছোট তিন ভাই বোন বাসা থেকে পালিয়ে বাসার বাইরে একটা মুরগির ঘরে লুকিয়ে থাকতো।

Advertisement

রাগলে বাবার কোন হুশ থাকে না। তাই যতক্ষণ এই মারামারি চলতো ওরা ছোট ছোট তিন অবুঝ শিশু পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে অসহায় অবলা প্রাণির মত ঠকঠক করে কাঁপত। ওরা যে এলাকায় থাকে, সেটি গরিব, অশিক্ষিত মানুষের এলাকা। এখানে এসব ঘটনা নিত্য নৈমিত্তিক লেগেই আছে। তাই প্রতিবেশীরা কেউ মাথা ঘামায় না।

এভাবেই চলছিল। ওর বয়স যখন ছয়, তখন সেই বদরাগী বাবা নামের মানুষটা ওদেরকে আর ওদের মাকে রেখে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। মারামারি, গালাগালি, ভাঙ্গাভাঙ্গি বন্ধ হল ঠিকই। কিন্তু সেই সাথে যোগ হল অনাহার। আগে হয়তো মাঝে মাঝে না খেয়ে থাকতে হত, এখন প্রায় প্রতিদিনই আধপেটা বা উপোস। মা নিয়মিত কাজ পায় না। ড্রাগ আসক্ত মহিলাকে কেই বা কাজ দেবে? কাজ পেলেও তাড়িয়ে দেয় দুদিন পরেই।

বাবা চলে যাওয়ার পরে, মায়ের ড্রাগসের মাত্রা দিন দিন বাড়ছে। সাব্রিনার বয়স যখন মাত্র দশ, ওর মাই ওর হাতে তুলে দিয়েছিল ড্রাগস। হেরে যাওয়া জীবন থেকে পালিয়ে বেড়ানোর পথ। সেই থেকে ড্রাগস হয়েছে ওর সঙ্গী। চৌদ্দ বছর বয়স হতে হতে সে নিজেই ড্রাগস কেনা বেচা শুরু করল। সেই সাথে ছেলেদের সাথে অবাধ শারীরিক সম্পর্ক। পরিবার নেই, অভিভাবক নেই, জীবনের ন্যূনতম নিরাপত্তা নেই, যে পথে জীবন ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সে পথেই চলছে সে দিশেহারা কিশোরী।

Advertisement

ষোল হতে হতেই কোলে এল প্রথম সন্তান। ততদিনে সে গৃহহীন। আরও দুবছরের মাথায় এলো আরেকটি সন্তান। নামেই মানুষ। অথচ জীবন কুকুর বেড়ালের। ওদের মতই পথেই থাকে, কুড়িয়ে খায়। পার্থক্য সন্তান দুটিও সঙ্গে আছে, ওদেরকে ফেলে হেঁটে চলে যেতে পারে নি আঠার বছরের এই মা। একদিন পুলিশ এসে কেড়ে নিয়ে গেলো ওর বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বন দুই সন্তান, কারণ তাদেরকে মানুষ করার ক্ষমতা তার নেই। সেদিন সাব্রিনার জীবনে সবচেয়ে বড় আঘাত সে পেয়েছিল।

অবশেষে জীবনের সব আশা নিভে যাওয়ার পর সাব্রিনার আশ্রয় হল এক পুনর্বাসন কেন্দ্রে। পুনর্বাসন কেন্দ্রে এই মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত এবং ড্রাগে আসক্ত নারীকে প্রথমে বিভিন্ন কাউন্সেলিং এবং রিহ্যাবের মাধ্যমে প্রথমে আসক্তি মুক্ত এবং মানসিক ভারসাম্য পূর্ণ জীবনে ফিরিয়ে আনে। কেন্দ্রটি তারপরে সরকারের কাছে আবেদন করে যেহেতু সে এখন সুস্থ, তার সন্তানদেরকে ফিরিয়ে দিতে তার কাছে।

এই কেন্দ্রেই মা ফিরে পায় তার হারিয়ে যাওয়া দুই সন্তানকে। পুনর্বাসন কেন্দ্র, সাব্রিনাকে স্কুলে পাঠায়। যে ক্লাস পর্যন্ত পড়েছিল, তার পরের হাই স্কুলের ক্লাস গুলি শেষ করার জন্য। মা যতক্ষণ স্কুলে থাকে, ছোট বাচ্চা গুলি কেন্দ্রের ডে কেয়ার এর তত্ত্বাবধানে থাকে। এভাবে করে সাব্রিনার হাই স্কুল শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওখানেই ওরা আশ্রয় পায়, খাদ্য, চিকিৎসা, বস্ত্র সব।

যেদিন স্কুল শেষ করে সাব্রিনা সংসার চালানর মত একটা কাজ পেয়ে যায়, তার পরেই শুধুমাত্র এই পরিবারটি পুনর্বাসন কেন্দ্র ত্যাগ করে। কিছুদিন আগে এই পুনর্বাসন কেন্দ্রটি দেখার আর সাব্রিনাদের সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল এই প্রবাসে। সেখানেই জানতে পারি ওর ইতিহাস।

Advertisement

আমাদের দেশে সাব্রিনার মত অসংখ্য মেয়ে আছে। অল্প বয়সে যাদের নাম কা ওয়াস্তে একটা বিয়ে হয়। একটা, দুটা বাচ্চা হয়ে যাওয়ার পর স্বামী আর খোঁজও নেয় না। আছে প্রেমের ফাঁদে পা দিয়ে বিয়ের আগেই মা হয়ে যাওয়া অসহায় মেয়ে, আছে সমাজে মুখ দেখাতে না পারা ধর্ষিতা মেয়ে। স্বামী থেকেও প্রতিদিন শারীরিক নির্যাতনের শিকার আধমরা অসংখ্য স্ত্রী, মা। এদের কেউ কেউ হয়তো উপায় না দেখে পতিতা বৃত্তিও বেছে নেয়। সেদিনই কোথায় যেন, এক পতিতার সাক্ষাৎকারে পড়ছিলাম পুরো পরিবারকে লুকিয়ে সে এই কাজ করছে মেয়েকে পড়া লেখা শিখিয়ে মানুষ করবে বলে।

আমাদের দেশে কী এমন একটা চমৎকার পুনর্বাসন কেন্দ্র গড়ে উঠতে পারে না যেখানে যে কোন ধরনের নির্যাতিত নারী, স্ত্রী, মা আশ্রয় পাবে, নিজের পায়ে নিজের সন্তানদেরকে নিয়ে দাঁড়াতে শিখবে? বিশ্বাস করুন এই মেয়েগুলোকে দেখলে, এই শিশুগুলোকে দেখলে আপনিও চোখের পানি আটকাতে পারবেন না, যেমন আমি পারিনি সেদিন। সরকারের আশায় বসে না থেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে, মানুষের দানে, মমতায় গড়ে উঠবে এমনি সব পুনর্বাসন কেন্দ্র, কোন নির্যাতিত অসহায় মেয়েকে বেছে নিতে হবে না আর পতিতাবৃত্তি।

লেখক : প্রবাসী লেখক।

এইচআর/এমএস