স্কোয়ার লেগে ফিল্ডার দাঁড়িয়ে, তারপরও সৌম্য সরকার ঠিক ওই জায়গায় ফ্লিক করতে গিয়ে ক্যাচ তুলে দিলেন। ভিতরের দিকে আসা খাটো লেন্থের বল তামিম নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পেরে বাতাসে ভাসিয়ে পুল খেলতে গেলেন। আকাশে ওঠা বল চলে গেল ডিপ স্কোয়ার লেগ ও ডিপ মিড উইকেটের মাঝামাঝি। ভালো সূচনার পরও মুশফিকুর রহিম অফস্ট্যাম্পের অনেক বাইরের বলকে অযথা উইকেট ছেড়ে তাড়া করে হলেন কট বিহাইন্ড। এরকম অনাবশ্যক, অপ্রয়োজনীয় ও নিয়ন্ত্রণহীন শট খেলার চরম মাশুল ১৩৯ রানের অতি দুর্বল পুঁজি।
Advertisement
একের পর এক এমন আলগা ও দায়িত্বহীন শট খেলে ১৫-১৬ ওভারে অলআউট হলে তবু একটা কথা ছিল। সান্ত্বনা খুঁজে পাওয়া যেতো- নাহ, নির্ধারিত ১২০ বলের প্রায় ১৫ থেকে ২০ বল আগেই ইনিংস শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু তাতো হয়নি।
মাহমুদউল্লাহর দল পুরো ২০ ওভারই ব্যাটিং করেছে। তারপরও ইনিংস শেষে দেখা গেল, ২০ ওভারের ম্যাচে ৮ বলে ১ রান করে আউট অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। ১১ জনের একজন ব্যাটসম্যানও হাত খুলে খেলতে পারেননি। কারও স্ট্রাইকরেট ১২০-১৩০‘র ঘরে যায়নি। শুধু মুশফিক ১২৮. ২৮ স্ট্রাইকরেটে ব্যাট করেছেন। আর তামিম (৯৩.৭৫), সৌম্য (১১৬.৬৬), লিটন (১১৩.৩৩) আর সাব্বির (১১৫.৩৮) গড়পড়তা ১২০ এর নিচের স্ট্রাইকরেটে রান করেছেন।
এই যদি হয়, একটা দলের টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের স্ট্রাইকরেট, তাহলে স্কোর লাইনের জীর্ণ দশা থাকবেই। কম বেশি সবার ব্যাটিং অ্যাপ্রোচ-অ্যাপ্লিকেশনই বলে দেয় ২০ ওভারের খেলায় স্কোরবোর্ডকে কি করে সচল রাখতে হয়, এটাই এখনও ভালো করে আত্মস্থ হয়নি বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের। জানা থাকলে ২০ ওভারে ১২০ বলের খেলায় ৫৫ টি ডট বল হতো না।
Advertisement
একটা দল চাপমুক্ত পরিবেশে শতভাগ ব্যাটিং বান্ধব উইকেটে আগে ব্যাটিংয়ে নেমেও প্রায় ৪৫ ভাগ ডেলিভারি থেকে একটি রানও করতে পারেনি, ভাবা যায়! অবিশ্বাস্য!
সোজা হিসেবে ওই ৫৫ বলের অর্ধেক ডেলিভারি থেকে একটি করে রান আসলেও আরও ২৭/২৮ রান যোগ হতো। তখন স্কোর ১৭০‘এ দাঁড়াতো। ১৪০ রান তাড়া করতে ভারতকে খেলতে হয়েছে ১৮.৪ ওভার পর্যন্ত। রানটা ১৭০ হলে, ফলটা হয়তো অন্যরকমও হতে পারতো।
কালকের ম্যাচে হারের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে টাইগার অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ ‘ডট বল’কেই মূল দায়টা দিয়েছেন। তাই তো মুখে এমন কথা, ‘টি-টোয়েন্টিতে ইনিংসের মাঝের ওভারগুলোতে আমরা ধুঁকছি। অনেক বেশি ডট বল খেলছি, তার পর উইকেটও বিলিয়ে দিয়ে আসছি। আজকেও শুরু ভালোই হয়েছিল। কিন্তু পরের দিকে নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারিয়েছি।’
রিয়াদ আরও যোগ করেন, ‘টি-টোয়েন্টিতে মাঝের ওভারগুলোতে পিছিয়ে আছি আমরা। বরাবরই এখানে খেই হারিয়ে ফেলি। সিঙ্গেল নিতে পারছি না। ডাবলসও হচ্ছে না। পাশাপাশি বাউন্ডারি হাঁকানোও সম্ভব হয়নি। উল্টো উইকেটও দিয়ে এসেছি।’
Advertisement
দলে সে অর্থে পাওয়ার হিটার নেই কেউ। ক্রিস গেইল, ব্রেন্ডন ম্যাককালাম বহদূরে। তামিম, সৌম্য, মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহরা টি-টোয়েন্টির আদর্শ স্ট্রাইকরেটও (১৩০+) বজায় রাখতে পারছেন না। এমন একজন ব্যাটসম্যানও নেই যিনি বলে ঠিক পিছনে শরীর ও পা না নিয়েও শুধু শরীরের জোরে সীমানার ওপারে পাঠাতে পারেন।
এরকম অবস্থায় সবচেয়ে কার্যকর ও লাগসই অ্যাপ্রোচ হলো পাওয়ার প্লে‘র ছয় ওভারে ৩০ গজের মধ্যে থাকা ফিল্ডারদের মাথার ওপর দিয়ে যতটা সম্ভব বেশি শট খেলে তারপর মাঝখানে গিয়ে ঠান্ডা মাথায় সিঙ্গেলস-ডাবলসে রান চাকা সচল রাখার চেষ্টা করা। কিন্তু সেই কাজটিই হচ্ছে না। হচ্ছে না না বলে করা সম্ভব হচ্ছে না বলাই হয়তো অধিক যুক্তিযুক্ত হবে।
অথচ একটু বুদ্ধি খাটিয়ে ব্যাট করলেই কিন্তু ৪০ থেকে ৫০টি ডট বল দেয়ার পরও ১৬০ থেকে ১৭০ কিংবা তার বেশি রান করা সম্ভব।
কিভাবে? লক্ষ্য করুন। কালকের ম্যাচে বাংলাদেশের একজন ব্যাটসম্যানও ১২০ স্ট্রাইকরেট ব্যাট করতে পারেননি। কেউ একা তিন-চারটি ছক্কাও হাঁকাতে পারেননি। সাকুল্যে ইনিংসেই ছক্কা হয়েছে তিনটি। আর বাউন্ডারি মোটে এক ডজন। তার মানে ১৫টি বল সীমানার ওপারে গেছে। যার যোগফল ৪৮+১৮ = ৬৬। মোট রান হয়েছে ১৩৯। বাংলাদেশ যেহেতু ৫৫ বলে রান করতে পারেনি, তার মানে স্কোরিং ডেলিভারি ছিল ৬৫ টি।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, বাকি ৭৩ রান এসেছে ৫০ বল থেকে। ওই ৫০ বলের মধ্যে বেশি না, বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা যদি আর পাঁচটি টি বাউন্ডারি আর পাঁচটি ছক্কা হাঁকাতে পারতেন তাহলে শুধু বাউন্ডারি আর ওভার বাউন্ডারি দিয়ে আরও ২০+৩০ = ৫০ রান বেশি আসতো। তার মানে তখন রান গিয়ে দাঁড়াতো ১৭০ ‘র ঘরে। তাতে স্কোরিং ডেলিভারি বাড়াতে হতো মাত্র ১০ টি। আবার এই ১০ ডেলিভারির সবগুলো বাউন্ডারি ও ছক্কা হাঁকাতে না পারলেও যদি সমান সংখ্যক ডাবলস নেয়া যেতো, তবে ২০ রান বেশি আসতো। তাতেও রান দাঁড়াতো ১৩৯ + ২০ = ১৫৯।
আবার চার ও ছক্কা না বাড়াতে পারলেও শুধু সিঙ্গেলস ও ডাবলসে খেলে খেলেও আরও ৩০ থেকে ৪০ রান বেশি করা সম্ভব ছিল। ১৫ টি ডাবল যোগ হলে আরও ৩০ রান হতো। তাহলে রান গিয়ে দাঁড়াতো ১২০। এর সাথে ৪০ টি সিঙ্গেলস। মানে আরও ৪০ রান। তাহলেই স্কোর দাঁড়াতো ১৬০ ‘এ। এজন্য অসাধ্য সাধনের দরকার ছিল না। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা যে ৫৫ বলে রান করতে পারেননি। তা থেকে আর বড় জোর ১৫ থেকে ২০টি ডেলিভারিতে রান করলেই হয়ে যেত।
যেহেতু দলে বিগ হিটার নেই। শেষ দিকে থিসারা পেরেরা আর হার্দিক পান্ডিয়ার মত উত্তাল উইলোবাজির কেউ নেই। তাই পাওয়ার প্লে‘র পর ৭ থেকে ১৫ ওভার- এই আট ওভারে গড়পড়তা প্রতি ওভারে দুটি করে ডাবলস আর একজোড়া সিঙ্গেলস বের করার চেষ্টা থাকতেই হবে। তাহলেই কিন্তু ১৬০ থেকে ১৭০ রান করা যায়।
কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা তা করতে পারছেন না। করার চিন্তা- ভাবনাও নেই। চেষ্টাও নেই। আছে বলের মেধা ও গুন বিচার না করে, বলের পিছনে শরীর ও পা না এনে দূর থেকে শট কিংবা রিভার্স সুইপ আর স্কুপ মার্কা শট। তাতেই বল নষ্ট হচ্ছে। এর চেয়ে সোজা ব্যাটে খেললেও রান গতি বাড়ানো সম্ভব। তাতে সিঙ্গেলস বাড়বে। বেশি দরকার নেই। ক্রস ও অতিমাত্রায় ইম্প্রোভাইজ করার চেষ্টা বাদ দিয়ে প্রতি ওভারে দুটি সিঙ্গেলস বেশি নিতে পারলে কিংবা একটি ডাবলস নিলেই তো ৩০ থেকে ৪০ রান বেশি আসবে। এ উপলব্ধি খুব জরুরি।
এআরবি/এমএমআর/পিআর