‘আচ্ছা, তামিম, সৌম্য, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ, সাব্বির, তাসকিন, রুবেল আর মোস্তাফিজরা কি নিজেদের হারিয়ে ফেলেছেন? আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ম্যাচ জিততে যা যা করণীয়, তা কি ভুলে গেছেন তারা? টাইগাররা কি তবে ব্যর্থতার বৃত্তে আটকে পড়ে জিততেই ভুলে গেছে? তাদের আস্থা, আত্মবিশ্বাস আর প্রয়োগ ক্ষমতা কি তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে?
Advertisement
তাই যদি না হবে, তাহলে ব্যাটিং-বোলিংয়ের এমন হতচ্ছিরি অবস্থা কেন? সবার মুখে ঘুরে ফিরে এমন প্রশ্ন। সে প্রশ্ন অমূলক নয় মোটেই। ঘরের মাঠে লঙ্কানদের কাছে খাবি খাওয়া টাইগাররা এবার শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোয় নিদাহাস ট্রফির প্রথম খেলায় বিরাট কোহলি, মহেন্দ্র সিং ধোনি, জাসপ্রিৎ বুমরা আর হারদিক পান্ডিয়াবিহীন ভারতের জাতীয় দল নামধারি ‘এ’ দলের কাছেও চরমভাবে পর্যুদস্ত।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে কলম্বোর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ বাহিনীর অনুজ্জ্বল আর বাজে পারফরম্যান্স ও চরম দুর্বল শরীরি ভাষা দেখে অতিবড় বাংলাদেশ ভক্তও হতাশ। সমর্থদের মন খারাপ। সবার মনে রাজ্যের হতাশা- এটা কোন পারফরম্যান্স হলো? তামিম , সৌম্য, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহরা কি ব্যাটিং ভুলে গেলেন?
পুরো দল ছন্নছাড়া। শরীরি অভিব্যক্তি দেখে মনে হচ্ছে, নিজেদের সামর্থ্যের প্রতি বিশ্বাস নেই একটুও। মনে হচ্ছে যেন সবাই নিজেদের হারিয়ে খুঁজছেন।
Advertisement
সবার অলক্ষ্যে একটা বিষয় কিন্তু ঘটেছে। টাইগাররা ঘরের মাঠে আর কলম্বোয় নিদাহাস ট্রফির প্রথম ম্যাচটিসহ যে টানা তিন ম্যাচ হেরেছে, তার সবকটাই টি-টোয়েন্টি ম্যাচ। বলার অপেক্ষা রাখে না, পরিসংখ্যান পরিষ্কার জানান দিচ্ছে, টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে বাংলাদেশ কখনই ভালো দল না।
পরিসংখ্যানকে মানদন্ড ধরলে ওয়ানডের তুলনায় টাইগাররা টি-টোয়েন্টি অনেক দুর্বল, জীর্ণ-শীর্ণ। আসুন, ছোট্ট একটা পরিসংখ্যান দেখে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হই। ইতিহাস ও পরিসংখ্যান সাক্ষী দিচ্ছে, ওয়ানডেতে বাংলাদেশ ক্রিকেটের সব পরাশক্তিকে হারিয়েছে। এর মধ্যে অস্ট্রেলিয়া ছাড়া ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, পাকিস্তান আর শ্রীলঙ্কাকে গড়পড়তা অন্তত তিনবার করে হারানো রেকর্ড আছে।
অস্ট্রেলিয়ার সাথে ২০ বারের ওয়ানডে মোকাবেলায় একবার (জয়ের শতকরা হিসেব (৫.২৬) জিতেছে টাইগাররা। ইংল্যান্ডকে ২০ খেলায় হারানোর রেকর্ড আছে চারবার (২০%)। ভারতকে ৩৩ ম্যাচে ৫ বার, নিউজিল্যান্ডকে ৩১ খেলায় ১০ বার, পাকিস্তানকে ৩৫ বারে ৪ বার, দক্ষিণ আফ্রিকাকে ২০ বারের মধ্যে ৩ বার, শ্রীলঙ্কাকে ৪৪ বারে ৬ বার, ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ২৮ বারে ৭ বার আর জিম্বাবুয়েকে ৬৯ বারে ৪১ বার হারিয়েছে বাংলাদেশ।
সেখানে টি -টোয়েন্টিতে অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে এখনো অজিদের সাথে চারবারের মোকাবিলায় জয় অধরাই আছে। ভারতের বিপক্ষে ৬ বারের মোকাবিলায় একবারও জেতা সম্ভব হয়নি। একইভাবে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষেও ৭ বারে জয় সোনার হরিণ হয়ে আছে। এছাড়া পাকিস্তানের সাথে ১০ বারে দুই বার, শ্রীলঙ্কার সাথে ৯ বারে ২ বার, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৬ বারে ২ বার আর জিম্বাবুয়ের সাথে ৯ বারে ৫ বার জয়ের দেখা মিলেছে। এই পরিসংখ্যানই জানিয়ে দিচ্ছে ক্রিকেটের সবচেয়ে ছোট ফরম্যাটে বাংলাদেশ সত্যিই দুর্বল।
Advertisement
আর তাই তো, গত বছর ছয় ম্যাচে একবার মাত্র জয়ের দেখা মিলেছে। সবশেষ ১৬ খেলায় জয় সংখ্যাও মাত্র একটি। এই না পারা আরও প্রবল হয়েছে সাকিব আল হাসান না থাকায়। গত দুই বছরে যে একটি মাত্র জয়ের কথা বলা হলো, সে ম্যাচের জয়ের নায়ক কিন্তু সাকিব।
গত বছর ৬ এপ্রিল শ্রীলঙ্কার সাথে কলম্বোয় ৪৫ রানে জিতেছিল টাইগাররা। যার রূপকার সাকিব। ৩১ বলে ৩৮ রান করার পর বল হাতে ২৪ রানে ৩ উইকেট শিকারি ছিলেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার। তার একক নৈপুণ্যেই লঙ্কানদের হারানো সম্ভব হয়েছিল।
বলার অপেক্ষা রাখে না, টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে সাকিব বাংলাদেশিদের মধ্যে সবার সেরা। সবচেয়ে বেশি রান ও উইকেট তার। সবচেয়ে বেশিবার ম্যাচ সেরা হবার কৃতিত্বও সাকিবের।
কিন্তু এবার ঘরের মাঠে শ্রীলঙ্কার সাথে শেষ দুই ম্যাচ আর ভারতের বিপক্ষে নিদাহাস ট্রফির প্রথম খেলাতেই খেলতে হয়েছে সেই অতি নির্ভরযোগ্য পারফরমার ও মূল চালিকাশক্তি সাকিবকে ছাড়া। সাকিব আসলেই ‘টু ইন ওয়ান।’ তার অভাবে ব্যাটিং দুর্বল হচ্ছে। একজন জেনুইন ব্যাটসম্যান যাচ্ছে কমে। একজন স্পেশালিস্ট বোলারের ঘাটতিও থেকে যাচ্ছে।
সাকিব থাকা মানেই একজন স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যান থাকা। আবার বোলারের কোটায়ও একজন খালি থেকে যাচ্ছে। হাত খুলে খেলার মত অতি নির্ভরযোগ্য পারফরমার কমে যাচ্ছে। আর বল হাতে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের মেজাজ, মর্জি ও গতি-প্রকৃতি এবং হাব ভাব বুঝে বল করে উইকেট শিকারের পাশাপাশি রান নিয়ন্ত্রণে রাখার কাজটিও হচ্ছেনা। আর তাতেই দল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চরমভাবে। সাকিবের অভাব পূরণ করতে গিয়ে দল সাজাতে হিমসিম খাচ্ছেন নির্বাচকরা ।
সাকিবের বিকল্প খুঁজতে গিয়ে তারা একে ওকে নিয়ে আরও জট পাকাচ্ছেন। ভারতের বিপক্ষে ম্যাচটিতেও তাই হয়েছে। সাকিব নেই তাই দুই স্পেশালিস্ট স্পিনার খেলাতে গিয়ে একজন ব্যাটসম্যান গেছে কমে, খেলাতে হয়েছে ছয় ব্যাটসম্যান। সাকিব থাকলে সাত ব্যাটসম্যান নিয়ে খেলা যেতো অনায়াসে। আর দুই স্পিনার মিরাজ ও নাজমুল অপুর যে কারো বদলে সাকিব খেলতেন। তখন দলের লাইন আপই হতো ভিন্ন।
মোদ্দা কথা, শুধু মেধাবি আর অতি কার্যকর পারফরমার বলেই নয়, ব্যাট ও বলে ‘টু ইন ওয়ান ’ সাকিব না থাকায় একজন অতি কার্যকর ব্যাটসম্যানের পাশাপাশি বোলারও গেছে কমে। তাতে শক্তির ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে। এ কারণেই টাইগারদের অনেক বেশি অনুজ্জ্বল, ম্লান ও দুর্বল মনে হচ্ছে।
এআরবি/এমএমআর/পিআর