জাতীয়

ডাক্তারদের পেশাগত সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ বিএমএ নেতারা

ডাক্তারদের পেশাগত সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) নেতারা চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সাধারণ চিকিৎসকরা এ অভিযোগ করছেন বলে জানা গেছে। সাধারণ চিকিৎসকরা অভিযোগ করে বলেন, সম্প্রতি তৃণমূল পর্যায়ের চিকিৎসকরা কর্মস্থলের কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তাজনিত নানামুখী সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়েছেন। ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুর অভিযোগে গাজীপুরে জুনিয়র একজন চিকিৎসক বর্তমানে জেলে আছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে কর্মস্থলে চিকিৎসকরা স্থানীয় মাস্তানদের কাছে অপমান অপদস্ত হচ্ছেন। অথচ কর্মস্থলে অনুপস্থিতির সঠিক কারণ খুঁজে বের না করে স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ অন্যান্যরা শুধুমাত্র চিকিৎসকদের দোষারোপ করে যাচ্ছেন। এসব বিষয়াদি নিয়ে চিকিৎসকদের পক্ষে বর্তমান বিএমএ নেতাদের জোরালো ও বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখার কথা থাকলেও তা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এদিকে সাধারণ চিকিৎসকদের এসব অভিযোগের ভিত্তি রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএমএ’র একাধিক সাবেক নেতা। সর্বশেষ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় চিকিৎসকদের কর্মস্থলে উপস্থিতি নিশ্চিত করতে ‘হ্যালো ডাক্তার’ কর্মসূচি চালু করেছে। এ কর্মসূচির আওতায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা মন্ত্রণালয়ে বসে প্রতিমাসে দুইবার চিকিৎসকদের উপস্থিতি ও কার্যক্রম মনিটরিং করবেন। চিকিৎসকরা সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া অনুপস্থিত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।  হ্যালো ডাক্তার কর্মসূচি ঘোষণায় ডাক্তারদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তৃণমূল পর্যায়ে কর্তব্যরত ডাক্তাররা সরকারি এ সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করে বলেছেন, চিকিৎসা সেবা আর দশটি পেশার মতো নয়। বাধ্য করে শাসন বা সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা গেলেও সেবা আদায় করা যায় না। সরকারি এ সিদ্ধান্তের ফলে প্রাইমারি সেকেন্ডারি শিক্ষা ব্যবস্থার মতো চিকিৎসকদের মধ্যে ঝরে পড়া (ড্রপ আউট) প্রবণতা দেখা দিতে পারে। চিকিৎসা পেশাকে নেতিবাচকভাবে প্রকাশ করে, জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে লাভ হবে না, বরং উল্টো ফল হবে বলে মন্তব্য করেন তারা।  স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন জাতীয় কমিটির সভাপতি ও সাবেক বিএমএ সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশীদ ই মাহবুব শুক্রবার সকালে জাগো নিউজকে বলেন, বিএমএ নেতারা সরকারের চামচামিতে ব্যস্ত। চিকিৎসকদের বিভিন্ন সমস্যা ও সংকট নিরসনে পেশাদার সংগঠন হিসেবে তাদের যে কার্যকর ভূমিকা রাখার কথা ছিল তা তারা রাখতে পারছে না। সুষ্ঠু স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি চালুর কর্মস্থলে চিকিৎসকদের ধরে রাখার উপায় খুঁজতে তাদের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না। হ্যালো ডাক্তার মনিটরিং কার্যক্রমের মাধ্যমে উপস্থিতি হয়তো বাড়ানো যাবে কিন্তু ডাক্তারদের দিয়ে চিকিৎসাসেবা আদায় করা যাবে না। কি সমস্যার কারণে তারা সেখানে থাকছে না তা আগে জানতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।         সুব্রত ঘোষ নামে একজন তার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘টানা ৪৮ ঘণ্টা অ্যাডমিশন, সরকারি ছুটির দিনে ডিউটি, সকাল-সন্ধ্যা রাউন্ড, তারপর এই খবর, এই রকম চলতে থাকলে বঙ্গদেশে চিকিৎসক প্রজাতি বিলুপ্ত হতে আর দেরি নেই।’ তাজফিকা উম্মে হানি নামে একজন লিখেছেন, ‘ডাক্তারদের মনিটর করবে যে কর্মকর্তারা তারা যে ফাঁকিবাজি করবে না তার কী গ্যারান্টি, বরং প্রত্যন্ত এলাকার ডাক্তারদের মতো তাদের সেখানে ২৪ ঘণ্টা ডিউটি রোস্টার করে দিয়ে তাদের দু’জনের কাজ ক্যামেরায় ধারণ করা হোক। ঢাকায় বসে টেলিফোন করে মনিটর করেই সঠিক মনিটরিং হবে?আশিষ কুমার দাস নামে একজন লিখেছেন, সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ যে আমি কখনো ওই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চাকরি করিনি। এ ধরণের সিদ্ধান্ত নেয়া মানে চিকিৎসকদের অপমানিত করা ও লজ্জাজনক। বে-নজির আহমেদ নামে একজন লিখেন, চিকিৎসা ব্যবস্থার রোগ হলো ম্যানেনজাইটিস, তাতে অ্যান্টিবায়োটিক না দিয়ে প্যারাসিটামল দিলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উদ্ধার হয় না, আরো অবণতি হয়, মারাও যেতে পারে, এই ধরণের উদ্যোগে চিকিৎসকদের হেয় করে যখন তখন মার খাওয়ানো হবে! অনুপস্থিতির কারণ চিকিৎসকরা নয়, আমাদের করুণ ব্যবস্থাপনা, ব্যবস্থাপনার সামগ্রিক উন্নয়ন হলে শুধু অনুপস্থিতিই নয়, অনিয়ম ও দুর্নীতি দূর হবে। সমস্যা হলো ভাল ব্যবস্থাপক খুঁজে পাওয়া যায় না।নাবিউল ইসলাম সোহেল নামে একজন লিখেছেন- বাহ, ভাল তো। ভাল না? প্রাইমারি, সেকেন্ডারি শিক্ষা ব্যবস্থায় ‘ঝরে পড়া’ এইবার তাহলে চিকিৎসকদের মাঝে দেখা যাবে। বাধ্য করে শাসন বা সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা গেলেও সেবা কি আদায় করা যায়? সেবা মানে তো স্ব-উদগারিত/স্বেচ্ছা এই জাতীয় কিছু। রাষ্ট্র/গণমাধ্যম চিকিৎসা পেশার মতো (যারা জনগণের মৌলিক একটি চাহিদা পূরণ করে) একটি পেশাগোষ্ঠীকে নেতিবাচক রূপে প্রকাশ করে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে জনগণের কি স্বার্থ আদায় হবে তা বোধগম্য নয়।বিএমএর সাবেক মহাসচিব অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ শুক্রবার জাগো নিউজকে বলেন, গায়ের জোরে চিকিৎসকদের কর্মস্থলে উপস্থিত রাখা যাবে কিন্তু কাজ আদায় করা যাবে না। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে বিএমএসহ চিকিৎসকদের বিভিন্ন সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা উচিত।তিনি বলেন, সম্প্রতি চিকিৎসকদের ওপর নানামুখী দমন নিপীড়ন চললেও বিএমএ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। তাদের দুর্বল অবস্থানের কারণে গাজীপুরে এক চিকিৎসক জেল খাটছে। কর্ম পরিবেশ, নিরাপত্তা ও যাতায়াতের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত না করেই চিকিৎসকরা কর্মস্থলে থাকছে না বলে দায়ী করা হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, নানা সমস্যার কারণে হয়তো কিছু চিকিৎসক কর্মস্থলে থাকছে না, তবে বেশিরভাগ চিকিৎসকই কর্মস্থলে থেকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।বিএমএ বর্তমান মহাসচিব যা বললেন :সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিএমএ বর্তমান মহাসচিব অধ্যাপক এম ইকবাল আর্সলান চিকিৎসকদের সমস্যা নিরসনে ব্যর্থতার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, বর্তমান বিএমএ কমিটির প্রতিটি নেতাকর্মী চিকিৎসকদের সুখে-দুঃখে পাশে রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে যেখানে যখন চিকিৎসকদের ওপর হামলা হয়েছে সেখানে বিএমএ নেতারা উদ্যোগী হয়ে আসামিদের গ্রেফতার করিয়েছে। কর্তব্যপালনকালে চিকিৎসকদের মধ্যে যারা বিভিন্ন অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন তাদের প্রতিটি মামলায় জামিন করানো হয়েছে।তিনি জানান, স্বাধীনতা পরবর্তীকালে গত ৪০ বছরে যত চিকিৎসকের পদোন্নতি হয়েছিল তার চেয়ে বেশি পদোন্নতি বর্তমান বিএমএ’র আমলে হয়েছে। ২০১১ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ১৬ হাজার ৬শ’৯৪ জন  ডাক্তার পদোন্নতি পেয়েছেন। চিকিৎসকের উন্নয়নে বিএমএ নেতাদের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হ্যালো ডাক্তার কর্মসূচি সম্পর্কে তিনি ভাল করে জানেন না উল্লেখ করে ইকবাল আর্সলান জানান, বিষয়টি তিনি দেখবেন। গাজীপুরে এক ডাক্তারের জেলে থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ঘটনাটি শোনার পর থেকেই তারা জামিনের জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।বিএমএ মহাসচিব বলেন, একটি মহল ঈর্ষান্বিত হয়ে কিংবা না জেনে, না বুঝেই বিএমএ নেতাদের প্রতি অভিযোগের আঙ্গুল তুলছেন। তিনি এ প্রতিবেদককেও সব জেনেশুনে বুঝে প্রতিবেদন লেখার পরামর্শ দেন। এমইউ/এসএইচএস/একে/পিআর

Advertisement