বাংলাদেশের সিনেমায় নারীরা এসেছে কখনো নামের উপমা হয়ে, কখনো এসেছে গল্পের সৌন্দর্যে। হাজার হাজার সিনেমার ভিড়ে নারী প্রধান গল্পের ছবি হাতে গোনা। ছবিতে নারীর উপস্থাপনও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নেতিবাচক। সংসার, স্বামী কিংবা কাছের পুরুষটি যতোই ত্রুটিতে পূর্ণ থাকুক, তাকে আগলে রাখতে, তার পায়ের নিচে বেহেস্ত খুঁজতে, তার করুণায় বেঁচে থাকার শিক্ষা সত্তর দশকের অনেক সিনেমাই দিয়েছে আমাদের নারীদের। সেখানে প্রতিনিধি হয়ে এসেছেন শাবানা, ববিতা, কবরী, রোজিনারা।
Advertisement
যুগের সাথে সাথে সেই উপস্থাপনে খুব একটা পরিবর্তন আসেনি। চম্পা, দিতি, মৌসুমী, শাবনূরেরাও সেইসব চরিত্র নিয়ে হাজির হয়েছেন। তবে নব্বই দশকে নিয়মিত একটা ব্যাপার ছিলো এক নায়ক দুই নায়িকাকে নিয়ে টানাটানি করছেন সেই দৃশ্য। আবার দুই নায়কও এক নায়িকার জন্য দুনিয়া এক করে ফেলার চেষ্টা করেছেন। এইসব চলচ্চিত্রে নায়িকারা কেবলই পুরুষের আরাধ্য বা প্রেমের প্রয়োজনে হাজির হয়েছেন।
বিশ্ব চলচ্চিত্রের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের নারীরা সিনেমায় আকাশে উড়েনি, ব্যাংকে বসেনি, পুলিশ-আর্মিতে যায়নি। দেখা যায়নি কোনো নারী চরিত্র ডাক্তার হয়ে সিনেমায় এসে দেশবাসীকে কোনো আদর্শ চরিত্র বা সংলাপ উপহার দিয়েছে। এইসব হিরোইজম এখানকার নায়কদের দখলেই ছিলো বরাবর। আর নারীরা কেবলই নায়িকা হয়ে, সিনেমার সেরা বিজ্ঞাপন হয়ে প্রেম কিংবা সংসারে বসে বালিশে এঁকেছে ‘ভুলোনা আমায়’। বড়জোর, প্রতিবাদী নারীর রুপ দেখাতে অস্ত্র-গোলাবারুদ হাতে নিয়ে গল্পের গরু আকাশে উড়ানোর মতোই আমাদের নারী চরিত্ররা রোমাঞ্চ ছড়িয়েছে সিনেমার পর্দায়।
অথচ, স্বাধীনতার পর থেকেই এই দেশের নারীদের উন্নতি হয়েছে সবখানে। তারা আকাশে বিমান নিয়ে উড়ে বেড়িয়েছে, পুলিশ-আর্মিতে ঢুকে জাতিকে সেবা করেছে, ব্যবসা-ব্যাংকে প্রবেশ করে করপোরেট দুনিয়ার নেতৃত্ব দিয়েছে।
Advertisement
হাল যুগেও বদলায়নি নারীর উপস্থাপন। এখনো নারী প্রেমিকাই; যার জন্য রক্তারক্তি কান্ড ঘটে যায় সিনেমায়। বলা চলে, আগের চেয়ে অবনতি হয়েছে। আজকাল আর আমজাদ হোসেনের মতো কোনো নির্মাতার ছবিতে গোলাপির দেখা মেলেনা, কোনো সুন্দরী প্রতিবাদী হয় না সমাজের লোলুপ-রিক্ত চিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে। এখন ‘অগ্নি’ নাম নিয়ে চলে দর্শক মাতানোর গল্প, সমাজ বা চেতনাকে মাতাতে পারে না। এখন সব ছবিতেই নারী চরিত্রগুলো ফ্যাকাশে। নায়িকারা হাজির হচ্ছেন সিনেমার গ্ল্যামার আর কাটতি বাড়াতে। নায়কের কোমর ধরে নাচেন, হাঁটেন, ঘুরে বেড়ান, নাকি নাকি কান্না কাঁদেন। বাকি যা করার একাই একশো নায়কেরা করছেন।
আমাদের সিনেমায় নারী চরিত্রগুলো কতোটা দরিদ্র সেটা অনুধাবন করা যায় ববিতা, কবরী, রোজিনা, সুচন্দা, সুচরিতা, শাবনূর, পপিদের অনিয়মিত হওয়া দেখলেই। এরা প্রত্যেকেই যার যার সময়ে সেরাদের তালিকায় রয়েছেন। অভিনয় বলা চলে গিলে খেয়েছেন। মানুষকে নাড়া দেয়ার মতো চরিত্র পেলে, সমাজে প্রভাব ফেলার মতো চরিত্র পেলে এনারা বাজিমাত করবেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ, ক্যামেরা হেসে উঠে এইসব অভিনেত্রীদের দেখে। কিন্তু ‘তোর বাবার প্রতিশোধ নে বাবা’ কিংবা ‘তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না সাগর’ টাইপের সংলাপ ছাড়া তেমন কোনো চরিত্র এদের হাতে পৌঁছায় না। স্বভাবতই চরিত্রের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে, সিনেমার ওজন বাড়ানোর চেষ্টা থেকে নিজেদের বিরত রেখেছেন শ্রদ্ধেয় এইসব অভিনেত্রীরা।
হলিউডে ষাট বছর বয়সেও অভিনেত্রীরা সেরা অভিনেত্রী হয়ে অস্কার পাচ্ছেন। আর আমাদের দেশের আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন অভিনেত্রী ববিতা মনের মতো চ্যালেঞ্জিং চরিত্র না পেয়ে চলচ্চিত্র থেকে দূরে থাকছেন। পার্থক্যটা এখানেই।
এই ইন্ডাস্ট্রিতে বয়স হয়ে গেলে চরিত্রে প্রমোশন হয়, অভিজ্ঞতাতে নয়। নারীদের বেলাতে সেটা অনেক বেশিই করুণ। এখানে অভিজ্ঞ হলে বেকার হতে হয়। সেই তালিকায় আগামীর নামগুলো হয়তো অপু, মাহি, বুবলী, পরীমনি, মিমেরা। আজকে যাদের ঘিরে ইন্ডাস্ট্রিতে কোটি কোটি টাকার লগ্নি, একটা সময় তারাই এখানে ঘুরে বেড়াবেন গুরুত্বের অভাবে।
Advertisement
গ্ল্যামার আর যৌবনের জৌলুশ হারালে এখানে ভাবী থেকে ক্রমান্বয়ে মা-দাদী হয়ে যেতে হয়। যেসব চরিত্র তাদের দিয়ে করানো হয় তার জন্য চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর অভিনয় করা ববিতা-কবরী লাগে না। অযথাই মেধার অপচয়। এইসব অভিনয় রোজকার সম্মানিতে পাওয়া যায় এমন বয়স্ক শিল্পীকে দিয়েই সম্ভব, এফডিসি পাড়ায় যাদেরকে ‘এক্সট্রা’ বলে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। এটা অনুধাবণ করতে পেরেই সিনিয়র অভিনেত্রীরা দূরে সরে আছেন চলচ্চিত্র থেকে।
ভাবী, মা-দাদীর চরিত্র দিয়েও যে সিনেমার প্রধান চরিত্র হওয়া যায় সেই ভাবনার ছায়া আমাদের সিনেমাতে বিরল। ‘আম্মাজান’ ছবিটি নায়ক প্রধানই। মান্নার পাগলাটে অভিনয় ছবিটিকে অনন্যতা দিয়েছে। কিন্তু সেই ছবিতে প্রায় নির্বাক চরিত্রে অভিনয় করেও দেশের দর্শকদের কাছে ‘আম্মাজান’ খ্যাতি পেয়েছিলেন নন্দিত অভিনেত্রী শবনম। এরপর..... কোথায় সেই চরিত্র যেখানে অভিনয় কিংবা গল্পের গুরুত্বে নায়িকা না হয়েও নারী প্রাধান্য পেয়েছে?
নায়ক রাজ্জাক, আলমগীর, ফারুক, সোহেল রানা, ইলিয়াস কাঞ্চনদের মতো দেশ কাঁপানো অভিনেতারাও এখন বেকার চরিত্রের অভাবে। তাদের সমকালীন নায়িকরাও তাই। শাবনূর-মৌসুমীরা নায়িকা হবার কোটা পার হবার পরই গুরুত্ব হারিয়েছেন। কিন্তু ‘মোল্লা বাড়ির বউ’, ‘খায়রুন সুন্দরী’, ‘চার সতীনের ঘর’, ‘নিরন্তর’র সিনেমায় কী টিনএজ, জিরো ফিগার, সেক্সি লুক, ছোট কাপড়ের নাচে যোগ্যতা লেগেছিলো? বা এইসব যোগ্যতাসম্পন্ন নায়িকারা কী পারছে ‘মোল্লা বাড়ির বউ’, ‘খায়রুন সুন্দরী’, ‘চার সতীনের ঘর’, ‘নিরন্তর’র মতো সিনেমা উপহার দিতে? তবে নারীদের নায়িকা ভাবার বাইরে গিয়ে অভিনেত্রী ভাবার চর্চাটা কেন ইন্ডাস্ট্রি করছে না, সেই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া কঠিন।
সর্বশেষ জনপ্রিয় কয়টি সিনেমার নাম ‘আয়নাবাজি’, ‘ঢাকা অ্যাটাক’, ‘শিকারী’, ‘নবাব’, ‘রাজনীতি’, ‘বসগিরি’। মনে দাগ কেটেছে কোন সিনেমার কোন নারী চরিত্রটি? বুকে হাত দিয়ে এর সদুত্তর হয়তো ছবিগুলোর নির্মাতরাও দিতে পারবেন না। নায়িকারা এইসব ছবিতে এসেছেন নায়ককে বিকশিত করতে, গল্পকে উপভোগ্য করতেই। তবে ‘ঢাকা অ্যাটক’ ছবিতে মাহিয়া মাহিকে তৎপর সাংবাদিক হিসেবে আলাদা লেগেছে দর্শকের। যদিও চরিত্রটির প্রয়োজনীয়তা ও এর বিকাশ নিয়ে আলাপ করার অনেক সুযোগ রয়েছে।
কিন্তু ধুমধাম ব্যবসা ব্যবসা না করলেও তৌকীর আহমেদের ‘হালদা’ ছবিতে জাহিদ হাসান, মোশাররফ করিম, ফজলুর রহমান বাবুদের মতো শক্তিমান অভিনেতাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়েছে তিশা, দিলারা জামান, রুনা খানের চরিত্রগুলো। এই ছবিটা প্রমাণ দেয়, চরিত্র নিয়ে ভাবলেই নারীদের গুরুত্ব বাড়ানো যায় সিনেমায়। সংগ্রামী জীবন তো কেবল পুরুষের নয়, পুরুষের জীবনের পেছনেও নারীর অনেক সংগ্রাম থাকে।
সিনেমা সবচেয়ে বড় গণমাধ্যম। সিনেমা সমাজ বদলায়। কিন্তু ষাট বছরের চলচ্চিত্রে সমাজে প্রভাব ফেলার মতো নারী চরিত্র খুব বেশি নেই। গ্ল্যামারটাই বেচে খাওয়া হয়েছে। সহজ ভাষায়, সিনেমা নামক পণ্যের আকর্ষণীয় মোড়ক হয়েছেন নারীরা। একটা ‘সারেং বউ’ আজকাল চোখে পড়ে না। ‘ভাত দে’ সিনেমার শাবানার সেই চরিত্রের মতো আজকাল কোনো অভিনেত্রীর চরিত্র চোখে পড়ে না। সমাজ কেবল পুরুষের? তবে সবেচেয় বড় গণমাধ্যমটিতে সমাজ সংস্কারক পুরুষকেই ভাবা হচ্ছে কেন? আর নারীরা গৃহবধু হিসেবেই থাক, সেই প্রচারণা চালানো হচ্ছে কেন?
চলচ্চিত্রে উপস্থাপনের পাশাপাশি নারীরা এখানে পিছিয়ে আছে চলচ্চিত্র নির্মাণ, চিত্রগ্রহণ, শব্দগ্রহণ, রুফসজ্জাকারীসহ অন্যান্য পেশাগুলোতেও। খুব বেশি নারী প্রযোজকও নেই আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে। যে ক’জন আছেন নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয় তাদের। দুহাত ভরে অর্থযোগ হয় বলে নায়িকা হওয়া নিয়ে হয়তো আগের মতো আমাদের পরিবারগুলো আর অনীহা দেখায় না। তবে ক্যামেরার পেছনে কাজ করতে আসা নারীদের এখনো অনুমতি মেলে না পরিবার থেকে। সেখানে ঝুঁকির চেয়ে অর্থযোগ যে অনেক কম!
প্রযুক্তির বিকাশ আর একবিংশ শতাব্দীর উন্নতির এই বিশ্বে বাংলাদেশও ডিজিটাল, উন্নতির স্লোগান নিয়ে এগিয়ে চলেছে। সেই স্লোগানকে ধারণ করা উচিত সিনেমাতেও। নারীরা কেবলমাত্র পুরুষের আরাধ্য, মনযোগকারী, দর্শক ধরার টোপ হিসেবে ব্যবহৃত না হয়ে মানুষ হিসেবে উপস্থাপিত হোক। সিনেমায় আসুক সংসারে নিভৃতে কাজ করে যাওয়া মায়েদের জীবনের গল্প, স্যাক্রিফাইসের দৃশ্যগুলো। আসুক ভাবীদের মমতামাখা সংগ্রামী গল্পগুলো, আসুক ভাইদের জীবনের উত্থানের পেছনে মহতি বোনদের গল্পগুলো। নায়িকার জৌলুস হারালেও পর্দায় ভাসুক সেই নায়িকার অভিজ্ঞতার জৌলুস।
সিনেমায় নতুন ভাবনার দিন নিয়ে আসুক আমাদের অভিজ্ঞ-তরুণ মেধাবী নির্মাতারা। যেখানে দেশ, সমাজ ও পরিবার হবে সাম্যের। নারী-পুরুষ নয়; উঠে আসবে মানুষের গল্প, জীবনের অভাব-চাহিদা-বোধ ও মার্জিত বিনোদনের ব্যাঞ্জনা।
এলএ/এমএবি/জেআইএম