মতামত

পর নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসুক আজকের নারী

সভ্যতার বিবর্তনে নারী পুরুষের দায়িত্ব ভাগ হয়েছে এভাবে যে পুরুষ বাইরের কাজ করবে আর নারী ঘরের। কিন্তু এই দায়িত্ব ভাগে নারী নানা ভাবে শোষিত হয়েছে। তাকে অর্থনৈতিক ভাবে পুরুষের মুখাপেক্ষী হতে হয়। তাই যেকোন সিদ্ধান্ত, হোক তার নিজের জীবনের, তাকে পুরুষের সিদ্ধান্ত মেনে চলতে হয়। পড়াশোনা, কাজ, সখ, বন্ধু, প্রেম, বিয়ে, সন্তান- মেয়েদের কোন বিষয়টির সিদ্ধান্তে পুরুষের হস্তক্ষেপ থাকে না বলুন তো? ভাত দেয় তাই নাম ভাতার, আপনার মালিক, তাই তার নাম স্বামী, বাড়ির কর্তা, সাহেব, কত নামেই তো ডাকেন, তাই না?

Advertisement

কখনও ভেবে দেখেছেন, আপনার অবস্থানটা কোথায়? আপনার পরিচয় কি? শুধুই মিসেস অমুক? অমুকের মা? অমুকের আত্মীয়? অমুকের মেয়ে? আপনি কে আপু। আপনি বাসার রান্নাটা, সাহেবে’র পাতে মাছের মাথা দিয়ে যখন পাতিল খুঁটে খান, যখন বাইরে কাজ করে এসে বেতনটা, ব্যাংকের হিসাবটা বাড়ির কর্তাকে মাথা নিচু করে বুঝিয়ে দেন, তখন কি সেটা সুখী দাম্পত্য সম্পর্কের চিহ্ন বহন করে?

আপনার ইচ্ছেতে যখন কেউ কোপ বসায়, হোক সেটা পড়াশোনা, চাকরি, কিংবা সন্তান ধারণ বিষয়ক, তখন কি কারণে মেনে নেন অনাকাঙ্খিত সিদ্ধান্তগুলো? সংসার বাঁচাতে? আপনার স্বামী রেগে আপনাকে মারবে? নাকি তার নিশ্চিত আশ্রয়ে আর্থিক স্বচ্ছন্দে আপনি আরাম প্রিয় হয়ে নিজের আত্মসম্মান জলাঞ্জলি দিচ্ছেন প্রতিনিয়ত। আপনি কি একবার ভেবেছেন, আপনার সন্তানদের কাছে আপনার ব্যক্তিত্ব কি দাঁড়াচ্ছে?

আপনি পড়াশোনা জানেন না। কিছু শেখেন নি। কিন্তু, কিছু তো নিশ্চয়ই পারেন। সেলাই, রান্না, সাজগোজ, বাচ্চা দেখাশোনা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অথবা ছোট করে মানুষকে জানালেও এখন এসব করে আপনিও অর্থনৈতিক ভাবে কিছুটা স্বাবলম্বী হতে পারেন। একটা সত্যি কথা কি, টাকা যার হাতে বল তার।মনের জোর বাড়ান, গলার আওয়াজ বাড়ান। যেটা ন্যায্য, সেটা থেকে পিছিয়ে, মানিয়ে নেওয়ার অভ্যাস বাদ দেন। মনে রাখবেন, আপনি যা চর্চা করবেন, যা সহ্য করবেন তা দেখে আপনার মেয়ে শিখবে। অন্যায়ের প্রতিবাদ না করা, সহ্য করা, তিলে তিলে মরা যদি শেখাতে চান আপনার নিজের মেয়েকে তাহলে কিছুই বলার নেই। আর যদি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুস্থ সমতাপূর্ণ সমাজ চান তাহলে এই মুহূর্ত থেকে জেগে উঠুন।

Advertisement

বাইরে গেলেই পুরুষ লাগে না, আপনি নিজেই নিজের রক্ষা করতে পারবেন। শিক্ষকতা ছাড়া মেয়েদের অন্য চাকরি ভাল না এই জাতীয় কথা বিশ্বাস করাতে চাইলে তা বিশ্বাস করার বাস্তবতা দেখি না। যে মানুষটির সাথে আপনি থাকবেন বা বিয়ে করবেন তাকে সবার আগে আপনার পছন্দ হতে হবে। আরেকজনের বোঝার কথা না ঐ মানুষটির সাথে আপনার অন্তরঙ্গ মুহূর্ত কতটা আনন্দময় হবে। আরেকজনের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত কেন আপনাকে মানতে হবে। মানতে হবে, কারণ, আপনি স্বাবলম্বী নন। আপনি আরেক পুরুষের ঘাড়ে বসে খান। আপনার নিজের কোন শক্ত ব্যক্তিত্ব নেই।

সৃষ্টির শুরু থেকে মেয়েদের মধ্যে মাতৃত্বের মহত্ব প্রচারের মাধ্যমে হোক বা আদম হাওয়ার গল্পের রেশ ধরে অপরাধবোধ ছড়িয়ে দিয়েই হোক, তাকে অধিনস্ত রাখার প্রক্রিয়া চলমান। লজ্জা নারীর ভূষণ? হ্যা, তবে নিজের লজ্জাবোধ বাড়ান নারী, মান-অপমানবোধ কে আর কবর দিয়ে থাকবেন না। আপনার হাত আছে, পা আছে, গলায় স্বর আর মাথায় বিবেক আছে। সেগুলো কাজে লাগান।

মনে রাখবেন, এ সমাজ পুরুষতান্ত্রিক, সে চোখ রাঙাবেই। উচিৎ কথা বলার সময় আপনার মনোযোগ হটাতে আপনার পোশাক, চাল চলন নিয়ে আঙ্গুল তুলবে। বেশ্যা, নষ্টা আরও নোংরা নোংরা গালি দেবে, আবার নিজেরাই নিজেদের ঢেকে পর্ণ ছবি তৈরি করবে, যেখানে সেখানে গোপনাঙ্গ বের করে জল বিয়োগ করবে, আপনার দৃষ্টি আকর্ষণে শব্দ করে কফ ফেলবে। এরা কি বলল, তাই ভেবে আপনি কপাট তুলবেন, ফ্যানে ঝুলবেন?

শিক্ষা অনেক বড় শক্তি। শিক্ষা শুরুর কোন বয়স নেই। আপনার শিক্ষা, সেলফ কনফিডেন্স, আর নৈতিকতা আপনাকে বহুদূর নিয়ে যেতে পারে যদি সমতা ও ন্যায়ের প্রশ্নে আপনি অটল থাকেন। নিজের নিজের জায়গা থেকে পায়ের নিচের মাটিটা শক্ত করুন বোনেরা। এখন বলবেন, আমার সংসার, মাটি তো শক্তই আছে। আমি বলব, মাটিটা আপনার তো?

Advertisement

মেয়েদের জন্য এখন অনেক সুবিধা জনক ও সম্মানজনক ভাবে অর্থ উপার্জনের সুযোগ রয়েছে। শুধু, আপনার সদিচ্ছা আর সাহস প্রয়োজন। বাংলাদেশের মেয়েরা এখন কি নয়! এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ক্রিকেট,ফুটবল, শুটিং খেলে সম্মান বয়ে আনে। আর আপনি আপনার জায়গায় দাঁড়িয়ে নিজের সম্মানটুকু আদায় করে আনতে পারবেন না?

মেয়েরা বাঁচে বাপের, স্বামীর, ছেলের ছায়ায়, এই সব মান্ধাতা আমলের পরনির্ভরতার মন্ত্র ভুলে বাংলার মেয়েরা জেগে উঠুক আপন বিশ্বাসে, আপন শক্তিতে। নারী দিবসে এই শুভ কামনা।

লেখক : কলামিস্ট।

এইচআর/আরআইপি