বিশেষ প্রতিবেদন

পরম মমতায় বন্যপ্রাণিদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তিনি

মধ্যরাতে স্থানীয় এক সংবাদকর্মীর ফোন, ‘তানিয়া আপু এখন কি রাজনগর আসতে পারবেন? একটা মেছোবাঘ জনতার হাতে ধরা পড়েছে। এখন না উদ্ধার করলে এলাকাবাসী মেরে ফেলবে।’ তানিয়া খান আসছি বলে মধ্যরাতে সিএনজি নিয়ে ছুটে গেলেন রাজনগর। গিয়ে বুঝতে পারলেন আরেকটু দেরি হলে মেছোবাঘটিকে মেরে ফেলা হতো।

Advertisement

উত্তেজিত জনতা বাঘটিকে মারতে না পেরে সব রাগ তানিয়ার ওপর মেটাতে চাইলেন, কিন্তু পুলিশ উপস্থিত থাকায় সেটি হলো না। মেছোবাঘটিকে নিরাপদে নিজ আশ্রয়ে নিয়ে আসলেন তানিয়া। এভাবেই ১০ বছর ধরে মৌলভীবাজার জেলাজুড়ে বন্যপ্রাণি রক্ষায় বনবিভাগের পাশাপাশি স্বেচ্ছায় কাজ করে যাচ্ছেন বন্যপ্রাণি সংরক্ষক ও সেবক তানিয়া খান।

বনবিভাগ থেকে যখনই কোনো প্রাণি উদ্ধারের বা সুস্থ করে তোলার খবর আসে নির্দ্বিধায় তানিয়া খান ছুটে যান বন-জঙ্গলে, সেটা হোক দিন কিংবা রাতে। অসুস্থ বন্যপ্রাণিদের উদ্ধারের পাশাপাশি নিজ ঘরে রেখে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তোলা এবং পরে তাকে নিজ আবাসে ফিরিয়ে দেয়ার দায়িত্ব যেন নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছেন এ নারী।

কোনো কোনো প্রাণির ক্ষেত্রে ৪/৫ মাস চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে। ধৈর্য ধরে নিজ আশ্রয়ে তাকে সেবা দিয়ে যান তিনি। এখন পর্যন্ত ৩০/৩৫ প্রজাতির পাঁচ হাজারের অধিক পাখি এবং ৮/৯ প্রজাতির চার শতাধিক বন্যপ্রাণিকে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তুলেছেন মহিয়সী এ নারী।

Advertisement

পশুদের প্রতি কেন এই ভালোবাসা- এমন প্রশ্নের জবাবে তানিয়া খান জাগো নিউজকে বলেন, আমি তখনও স্কুলে ভর্তি হইনি। বাবা মো. ওয়াজেদুল ইসলাম বাড়ি ফেরার সময় প্রায়ই অসুস্থ কুকুর-বিড়ালের বাচ্চা নিয়ে আসতেন। আমার দায়িত্ব পড়তো তাকে সুস্থ করে তোলা। ওই বয়সেই মায়ের মতো পরম মমতায় কোলে করে প্রাণিদের সুস্থ করে আবার মুক্ত করে দিতাম। সেই থেকে বন্যপ্রাণিদের প্রতি অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করে।

স্বামীর বাড়ি সুনামগঞ্জে হলেও স্বামী ফরেস্ট রেঞ্জ অফিসার এ কে এম মুনির আহমেদ খানের চাকরিস্থল মৌলভীবাজার হওয়ায় ২০০৯ সাল থেকে সেখানেই বসবাস শুরু করেন। স্থানীয় বর্ষিজোড়া ইকোপার্ক ও লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের মতো বিশাল এলাকায় শুরু হয় তার বিচরণ।

২০১৫ সালে স্বামী মারা গেলেও তিনি বন্যপ্রাণির প্রেমে মৌলভীবাজারে থেকে যান। তানিয়া খানের তিন মেয়ে এবং এক ছেলে। বড় দুই মেয়ে নিজেদের সংসার ও চাকরি নিয়ে ব্যস্ত। ছোট মেয়ে এবং একমাত্র ছেলে সুনামগঞ্জে শাশুড়ির কাছে থেকে লেখাপড়া করে। মাঝে মাঝে মাকে দেখতে আসে। সন্তানরা চান মাকে তাদের সঙ্গে রাখতে। তাদের অভিযোগ, শুধু শুধু নিজের খেয়ে বন্যপ্রাণির সেবা করার কী দরকার? সন্তানরা বিরক্ত হলেও শাশুড়ি উৎসাহ দিয়ে যান তার কাজে। শাশুড়িই তার সংসারের চালিকাশক্তি।

তানিয়া খানের কাছে সন্তানের মতো প্রিয় বন্যপ্রাণিরা। বাসায় একজন কাজের মানুষ আর তিনি থাকেন। প্রতিটি রুম, বারান্দায় শুধু প্রাণি আর প্রাণি। তাদের কারও কারও সুস্থতার জন্য চলছে চিকিৎসা, কোনটিকে আবার ২/৩ দিনের মধ্যে অবমুক্ত করা হবে। আবার কিছু প্রাণি আছে, ২/৩ মাস ধরে চিকিৎসা চলছে। কবে তারা সুস্থ হবে- এ আশায় আছেন তানিয়া।

Advertisement

বনবিভাগ থেকে শুরু করে সাধারণ শিশু, সবার কাছে প্রিয় নাম তানিয়া খান। প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগে অসুস্থ বা আহত কোনো পশুপাখি পেলে স্থানীয় শিশুরা সেটিকে দু’হাতের তালুতে করে নিয়ে আসে তানিয়া খানের কাছে। তিনি তাদের সুস্থ করে তোলেন সন্তানের মমতায়। প্রায়ই শিশুরা অসুস্থ কুকুর, বিড়ালের বাচ্চাও তার কাছে নিয়ে আসে।

শুধু মৌলভীবাজার নয়। এর বাইরেও তানিয়া ছুটে যান বিভিন্ন এলাকায়। ২০১৩ সালে খবর পান সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের দুর্গম এলাকায় একটি বড় প্রজাতির পাখি আহত হয়েছে। পরে জানা যায়, এটি বিরল প্রজাতির কালো শকুন। উৎসাহী জনতা ও বাচ্চারা টেনে তার পালক ছিড়ে ফেলেছে। সিদ্ধান্ত হয় পাখিটির চিকিৎসার জন্য ঢাকা পাঠিয়ে দেয়া হবে। কিন্তু তখনকার বাংলাদেশ বার্ডক্লাবের সভাপতি জানান, এত দূর অসুস্থ পাখিটি নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। তাকে তানিয়া খানের তত্ত্বাবধানে দেয়া হোক। পরে পাখিটি তানিয়ার কাছে দেয়া হয়। তিনি নিজ বাসায় রেখে নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে প্রায় চার মাসে কালো শকুনটিকে সুস্থ করে তোলেন। পাখিটির নতুন পাখা গজায়, পরে দেওড়াছড়ায় বনবিভাগের সহযোগিতায় অবমুক্ত করা হয়।

সিলেটের ওসমানীনগর থেকে গত বছর উদ্ধার করা হয় একটি মেছোবাঘ। কিছুদিন আগে হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান থেকে আহত বিরল প্রজাতির একটি শকুন উদ্ধার করে মৌলভীবাজার বনবিভাগের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। মেছোবাঘ ও শুকুনটিকে সুস্থ করে তোলার দায়িত্ব দেয়া হয় তানিয়া খানকে। নিজ বাসায় অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি তাদের কিছুটা সুস্থ করে তোলেন। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাদের পাঠিয়ে দেয়া হয় গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে। তানিয়া খান জানান, বন্যপ্রাণি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেশি-বিদেশি, সরকারি ও বেসরকারি অনেক সংস্থা থেকে বিভিন্ন বিষয়ে আন্তরিক সহযোগিতা পেয়েছেন। স্থানীয় বনবিভাগ এত কম জনবল নিয়েও যেভাবে মৌলভীবাজারের বিশাল এলাকায় কাজ করছে এবং তাকে সবদিক দিয়ে সহযোগিতা করছে সে জন্য তিনি কৃতজ্ঞ।

নিষ্ঠুরতা নয় বন্যপ্রাণিদের প্রতি সহানুভূতি, একটু ভালোবাসা দেখানোর আহ্বান জানিয়ে তানিয়া খান বলেন, ‘বন্যপ্রাণি ধ্বংস হয়ে গেলে হুমকিতে পড়বে মানবজাতি। বন্যপ্রাণিরা আমাদের ক্ষতি করে না বরং আমরাই তাদের বসবাসের জায়গায় বসতি গড়ে ক্ষতি করছি।’

বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মিহির কুমার জাগো নিউজকে বলেন, বনবিভাগের জনবল সংকট আছে। সেভাবে বন্যপ্রাণিদের সেবা দেয়া সম্ভব হয় না। তবে তানিয়া খান যেভাবে আন্তরিকতার সঙ্গে বন্যপ্রাণিদের নিয়ে কাজ করছেন এবং মাতৃস্নেহে প্রাণিদের সেবা-সুশ্রসা দিচ্ছেন তা পেশাদার কর্মীদের থেকে অনেক বেশি।

এমএএস/এমএআর/আরআইপি