খেলাধুলা

২য় রাউন্ডেই শেষ পিএসজির ১৪ হাজার কোটি টাকা!

কাতার স্পোর্টস ইনভেস্টমেন্ট (কিউএসআই)। ২০১১ সালেই শখ করে বলতে গেলে ইউরোপিয়ান ফুটবলে বিনিয়োগ নিয়ে আসে। ইংল্যান্ড, স্পেন, ইতালি কিংবা জার্মানি নয়, তারা বিনিয়োগ করলো উপরোক্ত চারটি দেশের চেয়ে পিছিয়ে থাকা ফ্রান্স ফুটবল লিগে। দেশটির রাজধানী প্যারিস ভিত্তিক ক্লাব পিএসজিকে (প্যারিস সেন্ট জার্মেই) কিনে নেয়ার মাধ্যমে ইউরোপিয়ান ফুটবলে পথচলা শুরু হয় আরবীয় পেট্রোডলারভিত্তিক কোম্পানি কিউআইএ’র (কাতার ইনভেস্টমেন্ট অথরিটি)।

Advertisement

শুরু থেকে উচ্ছাভিলাসি কাতার স্পোর্টস ইনভেস্টমেন্ট। কোম্পানির চেয়ারম্যান নাসের আল খেলাইফি পিএসজির প্রেসিডেন্ট হিসেবেও দায়িত্বভার নিয়ে নেন। কিউএসআইয়ের হাত ধরেই বদলে যেতে শুরু করে পিএসজি। নতুন মালিক এবং প্রেসিডেন্টের ইচ্ছা, শুধুমাত্র ফ্রান্সেই সেরা থাকবে না পিএসজি। হবে ইউরোপের সেরাও।

এ জন্য তো উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিততে হবে। মালিকপক্ষের এমন উচ্ছাভিলাস বাস্তবায়নে তারকা ফুটবলার কেনা শুরু করে ক্লাব কর্তৃপক্ষ। ভাবটা এমন যেন, অর্থের কোনো সমস্যা নেই। যা লাগবে দেয়া হবে; কিন্তু পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো ফুটবলারগুলোকে চাই পিএসজির ড্রেসিংরুমে। যত ব্যায়ই হবে, হোক। তবুও তো জিততে হবে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ট্রফি!

২০১১ সালের জুন থেকে শুরু করে ২০১৮ সালের মার্চ শেষ হতে চললো, পিএসজিতে আরবীয় পেট্রোডলারের স্রোত বইয়ে দিয়েছে কাতার ইনভেস্টমেন্ট অথরিটির সিস্টার কনসার্ন কাতার স্পোর্টস ইনভেস্টমেন্ট (কিউএসআই)। নেইমার-এমবাপেকে কেনা পর্যন্ত পিএসজির মালিকপক্ষ ব্যায় করেছে প্রায় ১.৩ বিলিয়ন (১৩০ কোটি) ইউরো। বাংলাদেশি মূদ্রায় যার পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে প্রায় ১৩ হাজার ৪৩৬ কোটি ৩৩ লাখ ৫৫ হাজার ২৩০ টাকা।

Advertisement

কিন্তু শুধুমাত্র টাকা উড়ালেই যে সাফল্য আসে না সেটা আরও একবার প্রমাণ হলো। পৃথিবীর সবচেয়ে দামি ফুটবলারটির মালিক এখন পিএসজি। বার্সেলোনা থেকে ২০০ মিলিয়ন ইউরো দিয়ে ব্রাজিল তারকা নেইমারকে কিনে নিলো তারা। ১৮০ মিলিয়ন ইউরো দিয়ে ধারে আনা হলো কাইলিয়ান এমবাপেকে। এডিনসন কাভানি, অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়ারা আগে থেকেই ছিলেন। ইউরোপের অন্যতম সেরা একটি দল গড়েই পিএসজি ভেবেছিল, এবার বুঝি আর তাদের ঠেকাতে পারবে না কেউ।

কিন্তু সবই যে মরিচিকা, সেটা বুঝিয়ে দিলো রিয়াল মাদ্রিদ। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের দ্বিতীয় রাউন্ডেই দেখা হয়ে গেলো তাদের রিয়াল মাদ্রিদের সঙ্গে। যারা কি না উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের গত চার মৌসুমের মধ্যে তিনটিই ঘরে তুলে নিয়েছে। সেই রিয়ালের কাছে প্রথম লেগে ৩-১ এবং দ্বিতীয় লেগে ঘরের মাঠে ২-১ গোলে হারলো পিএসজি। দুই লেগ মিলিয়ে ৫-২ ব্যবধানে হেরে দ্বিতীয় রাউন্ডেই শেষ হয়ে গেলো পিএসজির চ্যাম্পিয়ন্স লিগ দৌড়।

গত মৌসুমের দ্বিতীয় রাউন্ডে পিএসজি দেখা পেয়েছিল বার্সেলোনার। ঘরের মাঠে বার্সাকে পেয়ে ৪-০ গোলে হারিয়েছিল প্যারিসের ক্লাবটি। সবাই ধরে নিয়েছিল, পিএসজি বুঝি এবার দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলবে; কিন্তু ফিরতি লেগে বার্সার মাঠে গিয়ে হারলো ৬-১ গোলে। ব্রাজিলিয়ান তারকা নেইমার যেন একাই ওই ম্যাচে হারিয়েছিলেন পিএসজিকে।

তখন থেকেই ফরাসি ক্লাবটির লক্ষ্য নেইমার। মৌসুমের শেষেই দলবদলের ইতিহাসে অবিশ্বাস্য রেকর্ড গড়ে নেইমারকে ২২২ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে ন্যু ক্যাম্প থেকে উড়িয়ে নিলো প্যারিসের ক্লাবটি। সঙ্গে ১৮০ মিলিয়ন ইউরো দিয়ে মোনাকো থেকে ধারে নিয়ে আসলো এমবাপেকে। সব মিলিয়ে এই মৌসুমেই তারা ব্যায় করলো প্রায় ২৩৮ মিলিয়ন ইউরো। বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৪ হাজার ৩২০ কোটি ২৯ লাখ ৮৬ হাজার ৫২৭ টাকা।

Advertisement

এতবড় বিনিয়োগের দৌড় শেষ হয়ে গেলো দ্বিতীয় রাউন্ডেই! যদিও অজুহাত রয়েছে তাদের সামনে। দলটির সবচেয়ে তারকা খেলোয়াড় নেইমারের ইনজুরি। ইতিমধ্যেই পায়ে অস্ত্রোপচার করিয়েছেন তিনি। নেইমারের অনুপস্থিতিতে দলটি অনেকটাই দুর্বল হয়ে গেছে- এমন কথা বলতেই পারে পিএসজির সমর্থকরা। কিন্তু দলটিতে তো এমবাপে, কাভানি, ডি মারিয়াদের মত ফুটবলাররাও ছিল। তবুও অকালেই আরও একবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ থেকে বিদায় নিতে হলো ফরাসি ক্লাবটিকে।

কাতারি স্পোর্টস ইনভেস্টমেন্ট (কিউএসআই) দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই ২০১১-১২ মৌসুমেই শুরু হয় তারকা ফুটবলার কেনা। প্রথম আসরেই ৯৫.৮ মিলিয়ন ইউরো ব্যায় করে পিএসজি কিনেছে হ্যাভিয়ের পাস্তোরে, ব্লাইজ মাতুইদি এবং কেভিন গ্যামিরিওকে। জানুয়ারির দলবদলে ইন্টার থেকে নিয়ে আসা হলো থিয়াগো মোত্তাকে। কিন্তু লিগ চ্যাম্পিয়ন হতে পারলো না পিএসজি।

এরপরই ক্লাব কর্মকর্তাদের নিয়ে বসলেন নাসের আল খেলাইফি। জানালেন তার ইচ্ছার কথা। সুতরাং, পরের মৌসুমেই বিগ শট। জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচকে কিনে নিলো পিএসজি। মিলান থেকে ইব্রার সঙ্গে যোগ দিল ব্রাজিলিয়ান ডিফেন্ডার থিয়াগো সিলভা, এজেকুয়েল লাভেজ্জি, মার্কো ভেরাত্তি এবং গ্রেগরি ফন ডার উইয়েলকে আনা হলো প্যারিসে। কোচ নিয়ে আসা হলো কার্লো আনচেলত্তিকে। সব মিলিয়ে ১১০.৮ মিলিয়ন ইউরো ব্যায় করা হলো এই মৌসুমে। কিন্তু ফল, বার্সার কাছে হেরে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই বিদায়। তবে লিগ চ্যাম্পিয়ন হলো তারা।

২০১২-১৩ মৌসুমে আরও একধাপ এগিয়ে পিএসজি। এই মৌসুমে এসে তখনও পর্যন্ত রেকর্ড গড়লো ফরাসিরা। ন্যাপোলি থেকে ৬৩ মিলিয়ন ইউরো দিয়ে নিয়ে আসলো এডিনসন কাভানিকে। রোমা থেকে উড়িয়ে আনলো ডিফেন্ডার মার্কুইনহোসকে। সব মিলিয়ে এই মৌসুমে ব্যায় ১০৯.৪ মিলিয়ন ইউরো। ২০১৩-১৪ মৌসুমে খরচের লাগামে কিছুটা রাশ টেনেছে পিএসজি। কোচ লরা ব্লাঁ মাত্র একজন খেলোয়াড়কেই কিনেছেন এই মৌসুমে। চেলসি থেকে তিনি নিয়ে এসেছেন ডিফেন্ডার ডেভিড লুইজকে। যদিও তিনি ক্লাবের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারেননি। এবারও কোয়ার্টার ফাইনালে বিদায় নিতে হয়েছে পিএসজিকে, চেলসির কাছে হেরে।

২০১৫-১৬ মৌসুমে আরও একবার বড় ড্রাইভ দিয়েছে পিএসজি। এবার তারা ব্যায় করেছে ১১৪ মিলিয়ন ইউরো। লরা ব্লাঁ এবার হলেন উদার হস্ত। ম্যানইউ থেকে নিজেদের ট্রান্সফারের রেকর্ড ভঙ্গ করে উড়িয়ে আনলেন অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়াকে। মোনাকোর লেভিন কুরজাওয়া, তুলুজ ডিফেন্ডার সার্জি অরিয়েরকে নিয়ে আসেন ক্লাবে। এবার ৩১ পয়েন্টের ব্যবধানে লিগ শিরোপা জিতলেও চ্যাম্পিয়ন্স লিগে সেই কোয়ার্টার ফাইনালেই থমকে যেতে হলো পিএসজিকে।

পরের মৌসুমেই লরা ব্লাঁ-এর জায়গায় এলেন উনাই এমেরি। সেভিয়া থেকে এসেই পিএসজিকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেন তিনি। এ কারণে আরও বেশি উদার হস্ত হলেন তিনি। খরচ করলেন ১১৬ মিলিয়ন ইউরো। নিয়ে আসলেন জার্মান তারকা হুলিয়ান ড্রাক্সলার, জিওভানি লো সেলসোসহ বেশ কয়েকজন ফুটবলারকে।

কিন্তু উনাই এমেরির প্রথম মৌসুম কাটলো পুরো ব্যর্থতায়। লিগে হারলো মোনাকোর কাছে। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে অবিশ্বাস্যভাবে বিদায় নিতে হলো বার্সার কাছে হেরে। এবার আরও বেশি উচ্ছাভিলাসি। খরচের পর খরচ করেও যখন তৃষ্ণা মিটছে না পিএসজি ক্লাব কর্তৃপক্ষের, তখন তারা হাত দিলো খোদ বার্সেলোনায়। ২২২ মিলিয়ন ইউরোয় কিনে আনলো বার্সার ব্রাজিলিয়ান তারকা নেইমারকে। ধার নিলো মোনাকো তারকা কাইলিয়ান এমবাপেকে।

কিন্তু এবারও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো পিএসজির স্বপ্নযাত্রা। যারা ক্লাবের দায়িত্ব নিয়েই বলেছিল, ৫ বছরে ভাগ্য বদলে দেবেন, ইউরোপের সেরা বানাবেন- তাদের লক্ষ্যের চেয়েও ২ বছর পার হয়েছে বেশি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ট্রফিটার কাছাকাছি আর যাওয়া হলো না ব্যায়ের দিক থেকে বর্তমানে পৃথিবীর সেরা ক্লাবটির।

আইএইচএস/জেআইএম