মতামত

ছলছল চোখের মেয়ে, তুমি আমার একটা বাংলাদেশ ছিলে!

তার সাথে আমার পরিচয় ২০০৩ কি ২০০৪ সালে। আমি তাকে ভালোবাসতাম। কেন ভালোবাসতাম? ভালোবাসতাম, কারণ তাকে ভালো না বেসে আমার কোন উপায় ছিল না। ঠিক যে রকম নিজের দেশকে ভালোবাসে মানুষ, ভালোবাসে নিজের মা কে। তিনি ঠিক একটা মা ছিল। তুলতুলে আদুরে জ্যোৎস্না দিয়ে মোড়া মুখখানি- আমার আদরের, ভালোবাসার প্রিয়ভাষিণী।

Advertisement

তাকে আমি ডাকতাম আন্টি। কেন আন্টি ডাকতাম, মনে নেই। আবার কখনো বলতাম খালাম্মা, কখনো কখনো কী হত, ডাক দিতাম ‘আপা’। আবার বুকের ভিতরে তার নামটাও বাজতো প্রায়ই- প্রিয়ভাষিণী- সবসময় ভাবতাম, একটু সময় পেলেই দেখতে যাব প্রিয়ভাষিণীকে- আমার আন্টিকে।

আন্টিকে নিয়ে একটা টেলিভিশন প্রোগ্রাম করেছিলাম। সারাদিন তার সাথে থাকা কথা বলা তার কাজ দেখা- এটাই ছিল অনুষ্ঠান। সেই যে সারাদিন তার সাথে থাকলাম, সেই তাকে ভালোবাসলাম- আর তাকে ভুলতেই পারলাম না। তিনিও তাই। চিরসুন্দর আমার প্রিয়ভাষিণী আমাকে ভুললো না। আমাকে দেখলেই দুই বাহু বাড়িয়ে বুকে টেনে নিত। আদর করত।

বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে আমাদের একটা আবৃত্তির সংগঠন ছিল। এক আবৃত্তি অনুষ্ঠানে আন্টিকে সম্মাননা জানানো হল। একটা উত্তরীয় দিয়ে আমরা জড়িয়ে দিয়েছিলাম তাকে। অনুষ্ঠানের নাম ছিল- ‘আমি তোমার বাংলাদেশের মেয়ে।’ তো বাংলাদেশের মেয়ে, বাংলাদেশের মা প্রিয়ভাষিণী সেদিন বাংলাদেশের সব মেয়ের হয়ে সম্মান গ্রহণ করে আমাদের ধন্য করেছিলেন।

Advertisement

সেই কচি বয়সে আন্টিকে কাছ থেকে দেখেছিলাম মঞ্চের উপরে। আমার শরীর কাঁপছিল, আমার চোখ দিয়ে জল ঝরছিল। আমি নীলিমা ইব্রাহীম পড়েছিলাম- ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি।’ সেই বইটার পাতাজুড়ে যে নৃশংসতার দেখা আমি পেয়েছিলাম, আন্টিকে চোখের সামনে দেখে আমার বুক কাঁপলো, বেদনায়, ভালোবাসায়, শ্রদ্ধায়।

ধানমন্ডির তিন নম্বর রোডে আন্টি একটা বাসায় থাকতো। সেই বাসাটা খুব ছিমছাম আর সুন্দর ছিল। সেই বাসাতেই প্রথম যাই। ছায়াঘেরা গাছপালা ছাড়িয়ে ঢুকতাম, তারপর উঠোনের গেট খুলে ঢুকলেই আন্টির তৈরি ভাস্কর্যরা সম্ভাষণ জানাত। কত কী যে দেখতাম অবাক হয়ে।

একদিন গিয়েছি, দেখি হাতে করে একটা ফেলে দেয়া বাঁশের বেড়ার টুকরো নিয়ে বাসায় ঢুকেছেন। এইটা এখন কাজে লাগাবেন। বাসার উঠোনের পাশে বারান্দায় বেতের সোফা রাখা, তার সাথের দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা আন্টির গলার মালা। কী যে সুন্দর লাগতো দেখতে। পুরা বাসাটা জুড়ে শান্তি! আন্টি, ফুলেশ্বরী আপু, নাতি নাতনী, আংকেল (আমরা বলতাম বিয়ার ভাই, সবাই তাকে ভালোবেসে ডাকে বিয়ার ভাই, হাসতে হাসতে আন্টিকেও ডাকতে দেখতাম কখনো কখনো)।

মাত্র কদিন আগে আন্টির প্রদর্শনী হল ধানমন্ডিতে। মেয়েকে নিয়ে গেলাম। উদ্দেশ্য মেয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেব এই অনন্য সুন্দর মানুষটাকে। তার কাজ দেখবে মেয়ে। দেখা হল। আন্টি বসে আছেন। হাঁটতে কষ্ট হয়। কাছে গেলাম। বুকে টেনে নিলেন। মুখে হাত বুলিয়ে দিলেন আগের মত। মেয়েকে আদর করলেন। আমার গ্রামীণ চেকের শাড়িটা দেখে বললেন, ভারি সুন্দর।

Advertisement

আমার গোপন একটা ইচ্ছে জমে গেল। ভেবে রাখলাম, আন্টির জন্য ঠিক এমন একখানা শাড়ি নিয়ে দুজনে মিলে একরকম শাড়ি পরে একদিন ছবি তুলব। হল না। ভালোবাসার মানুষের আয়ু কেন অযুত লক্ষ নিযুত বছরে হিসাব হয় না- আমি জানি না। কেন পৃথিবীর সব সুন্দর মানুষেরা এত দ্রুত চলে যায় আমাদের নিঃস্ব করে, আমি জানি না।

এত মায়া, এত কোমলতা, এক স্নিগ্ধ আভিজাত্য আমি খুব বেশি মানুষের ভেতরে দেখিনি। এত শিল্পবোধ, এত গুণী ছিলেন প্রিয়ভাষিণী! কুড়িয়ে পাওয়া পাথর, ইট কাঠ থেকে তৈরি হত তার ভাস্কর্য। তুলিতে রঙ লাগিয়ে কপালে বুলিয়ে সৃষ্টি হত অপরূপ সব টিপ। সাজে পোশাকে, কথায়, ব্যবহারে, গুণে, চিন্তায়, দেশপ্রেমে, ভালোবাসায়, আদর্শে, সততায়, নিষ্ঠায় এবং অবশ্যই সাহসে ও আত্মমর্যাদায়, প্রিয়ভাষিণীর সমতুল্য মানুষ এই দেশে খুব কম ছিলেন। আমি আমার ক্ষুদ্র তুচ্ছ জীবনে এই অসম্ভব সুন্দর মানুষটার ভালোবাসা পেয়েছিলাম। আমার সৌভাগ্য। আমি এই মানুষটাকে হারালাম, এ আমার পরম দুঃখ।

আন্টি, হাসপাতালে গিয়েছিলাম তোমাকে দেখতে। তুমি তখন আল্ট্রাসনো রুমে। বের হলে, ট্রলি বেডে শুয়ে আছো। আমি আর কিছু দেখি নাই। তোমার হাত দুটো ধরে তোমার চির ছলছলে চোখ দুটো শুধু দেখছিলাম। আর সেই মায়াময় তিল আঁকা ছোট্ট ভাঁজ পরা থুতনির সৌন্দর্য! আন্টি, খালাম্মা, আমার প্রিয়ভাষিণী, আমি তোমার সদা জল ছলছল চোখদুটো বড় ভালোবাসতাম। তুমি কি একথা জানো? একটা মানুষের চোখ কীভাবে এত সুন্দর হয়?

আমার কাছে সৌন্দর্য, রুচি, স্নিগ্ধতা, ভালোবাসা, আদর আর শিল্পের একটা প্রতীক ছিলে তুমি। ছিলে শক্তি, সাহস, আত্মবিশ্বাস আর আত্মমর্যাদার সবচেয়ে দামী উদাহরণ। তুমি আমার কাছে একটা আস্ত বাংলাদেশ ছিলে। তুমি আমার প্রিয়ভাষিণী ছিলে। জল ছলছল চির সুন্দর ওই চোখ দুটো, ওই মুখখানা- আমি তোমাকে ভালোবাসতাম। আমি তোমাকে বড় বেশি ভালোবাসতাম!

লেখক : সাংবাদিক।

এইচআর/পিআর