ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে নতুন দেশ তৈরিসহ বাংলাদেশের বেশিরভাগ অর্জনই বিস্ময়ভরা। ছয় দফা, আগরতলা মামলা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধসহ ঘটনাবলীর যোগসূত্রও বিস্তর। একটি বাদ দিলে আরেকটি হয় না। হতো না। আবার সংঘাত-সহিংসতা, ঝড়-ঝঞ্ঝাসহ, প্রাকৃতিক-মানবসৃষ্ট নানা অঘটন মাড়িয়ে দেশটির এগিয়ে যাওয়াও বিস্ময়ের। অর্থনীতি, সামাজিক-সাংস্কৃতিক বাধাধরা নিয়মের বিপরীতেও বহু অর্জন বাংলাদেশের। অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তাত্বিকজ্ঞানে এসবের বিশ্লেষণ প্রায়ই অসাধ্য ।
Advertisement
একটি ভাষণে বা জমায়েতে দৃশ্যপট এভাবে পাল্টে যেতে পারে সেই নজিরও কেবল বাংলাদেশেই। তা-ও মাত্র ১৮ মিনিটে ১১৩৮ শব্দের একটি অলিখিত ভাষণ। এরমধ্যে আবার আঞ্চলিক শব্দ-উচ্চারণও প্রচুর। ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দিয়েছে এই তো সেদিন। শুধু সেই স্বীকৃতির ওপর ভর করে ভাষণটির শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করা অনুচিৎ। এ ভাষণের বহুমাত্রিকতা ও বৈশিষ্ট্য ইতিহাসের নতুন উপাদান। নতুন দৃষ্টান্ত। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ পৃথিবীর কোনো ভাষণের সাথে তুলনা হয় না। আব্রাহাম লিঙ্কন, মার্টিন লুথার কিংদের ঐতিহাসিক ভাষণ ছিল লিখিত। আর বঙ্গবন্ধুরটি অলিখিত এবং তাৎক্ষণিক। নির্দেশনামূলক হলেও ভাষণটিকে স্বাধীনতার ঘোষণা দাবি করা হয় এ কারণেই।
যুগে যুগে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বহমান ঘটনা ত্রাণকর্তার আসনে বসিয়েছে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেয়া ক্ষণজন্মাদের। তাদের মুখের কথাই পাল্টে দিয়েছে ইতিহাস। এ ভূগোলের ইতিহাস ঘুরেছে বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে। একাত্তরের ৭ মার্চ ভাষণটি বিশ্লেষণ করে মার্কিন ম্যাগাজিন নিউজ উইক শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘রাজনৈতিক কবি’ উপাধি দিয়েছিল। ঐতিহাসিক সেই ১৮ মিনিটের ভাষণের কিছু অংশ এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক।
... আজ দুঃখ-ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বুঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর ও যশোরের রাজপথ আমার ভাইয়ের রক্তে রঞ্জিত। ... আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়-বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়। কিন্তু ২৩ বছরের ইতিহাস বাংলার মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ২৩ বছরের ইতিহাস বাংলার মুমূর্ষু নরনারীর আর্তনাদের ইতিহাস। ... ১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছি, ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও ক্ষমতায় বসতে পারিনি। ১৯৫৮ সালে দেশে সামরিক শাসন জারি করে আইয়ুব খান দশ বছর আমাদের গোলাম করে রাখল।
Advertisement
১৯৬৬ সালে ৬-দফা, ১৯৬৯ সালে গণ-আন্দোলনের মুখে আইয়ুব খানের পতনের পর ইয়াহিয়া খান এলেন। তিনি বললেন, জনগণের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেবেন, শাসনতন্ত্র দেবেন, আমরা মেনে নিলাম। ... তার পরের ঘটনা সকলেই জানেন। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা হলো- আমরা তাকে ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকার অনুরোধ করলাম। আমি শুধু বাংলার নয়, সমগ্র পাকিস্তানের মেজোরিটি পার্টির নেতা হিসেবে তাকে এ অনুরোধ করেছিলাম। তিনি আমার কথা রাখলেন না, রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা।
মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে তিনি অধিবেশন ডাকলেন।... আমি বললাম, তবুও আমরা জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যাব এবং যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজনও যদি সে হয় তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব। ভুট্টো সাহেব এখানে এসেছিলেন, আলোচনা করলেন। বলে গেলেন, আলোচনার দরজা বন্ধ না, আরো আলোচনা হবে। ...কী পেলাম আমরা? আমার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরীব-দুঃখী নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে।
টেলিফোনে আমার সঙ্গে তার কথা হয়। তাকে আমি বলেছিলাম, জেনারেল ইয়াহিয়া খান সাহেব আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কীভাবে আমার গরীবের ওপর, আমার বাংলার মানুষের বুকের ওপর গুলি চালানো হয়েছে। কী করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে, কী করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন। আমি নাকি স্বীকার করেছি, ১০ তারিখে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স হবে। আমি তো অনেক আগেই বলেছি, কিসের রাউন্ড টেবিল, কার সঙ্গে বসবো? ... ২৫ তারিখে এসেম্বলি কল করছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি ১০ তারিখে বলে দিয়েছি ওই শহীদদের রক্তের ওপর পাড়া দিয়ে আরটিসিতে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না। ... আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই। তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
নিগ্রোদের অধিকার আদায়ে আপসহীন লড়াই চালিয়ে গেছেন আফ্রিকান-মার্কিন মানবাধিকারকর্মী মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র। আমেরিকায় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় অহিংস আন্দোলনের জন্য ১৯৬৪ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান। তার বিখ্যাত ভাষণ ‘আই হ্যাভ আ ড্রিম’। লুথার কিংয়ের ভাষণ ছিল এমন... আজ আমি আপনাদের সাথে এমন এক সমাবেশে মিলিত হতে পেরে অনেক খুশি হয়েছি। যা মুক্তিকামী মানুষের বৃহত্তম জমায়েত বলা যেতে পারে। এক শ বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু কালোরা আজও মুক্তি পেল না। বৈষম্য এবং বিচ্ছিন্নকরণের চক্রে পড়ে নিগ্রোদের জনজীবন আজ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
Advertisement
এক শ বছর পার হলেও আমেরিকার উন্নয়নে নিগ্রোরা আজও অথৈ মহাসাগরের মাঝে ক্ষুধার দ্বীপে বসবাস করে যাচ্ছে। তাই আমরা এখানে লজ্জাজনক পরিস্থিতির একটি নাটক মঞ্চায়ন করতে সমবেত হয়েছি। ...বিলাসিতার সময় এখন নয়। গণতন্ত্রের দাবি বাস্তবায়নের সময় এখন। এখনই সময় পতিত বিস্তীর্ণ দ্বীপ থেকে বেরিয়ে আসার। অন্ধকার ভেদ করে আলোর দিশারি হওয়ার মোক্ষম সময় এটি। ... আমরা নিশ্চুপ থাকি কী করে? যখন দেখি দীর্ঘ পথ অতিক্রমের পর এ শহরের হোটেল এবং মোটেলগুলোতে আমাদের জন্য জায়গা হয় না। তখন আমাদের ব্যক্তিত্ব ধুলোয় মিশে যায় যখন দেখি হোটেল এবং মোটেলের দেয়ালে ‘শুধুমাত্র শ্বেতাঙ্গদের জন্য। ... একদিন জর্জিয়ার লাল পাহাড়ে ক্রীতদাসের সন্তানেরা এবং তাদের মালিকেরা একত্রে ভ্রাতৃত্বের টেবিলে বসতে পারবে। প্রতিটি উপত্যকা উন্মুক্ত হবে। জানি মুক্তি আমাদের আসবেই। সেই দিন খুব বেশি দূরে নয়। সেই দিন ঈশ্বরের সকল সন্তান গেয়ে উঠবে...এ আমার দেশ...স্বাধীনতার স্বর্গভূমি।
ঐতিহাসিক ভাষণের তালিকায় আরেক মহানায়ক আব্রাহাম লিঙ্কন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম প্রেসিডেন্ট তিনি। ১৮৬১ সালে গৃহযুদ্ধকালে লিঙ্কনের অবদানের কারণে দ্বিখণ্ডিত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেয়ে যায় আমেরিকা। ১৮৬৩ সালের ১৮ নভেম্বর গেটিসবার্গে ভাষণ দিয়েছিলেন লিঙ্কন। যা আমেরিকানদের জন্য মূল্যবান দলিল। ভাষণে তিনি বলেন, ‘আজ থেকে ৮৭ বছর আগের কথা।
আমাদের পূর্বপুরুষেরা একটি নতুন জাতির গোড়াপত্তন করেছিলেন। বর্তমানে আমরা বিরাট এক গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছি। যে যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা পরীক্ষা করছি যে, এই নীতিতে দীক্ষিত ও উৎসর্গীকৃত ঐ জাতি বা অন্য যেকোনো জাতি দীর্ঘকাল টিকে থাকতে পারে কি না।... এই জাতি যাতে বেঁচে থাকতে পারে অনন্তকাল ধরে তার জন্য যারা এখানে জীবন বিসর্জন দিয়েছেন, তাদেরই এক অন্তিম আশ্রয়স্থলের একাংশকে উৎসর্গের উদ্দেশ্যে আমরা এখানে মিলিত হয়েছি। এই কাজ সম্পাদন করা আমাদের সকলের পক্ষে যথাযথ এবং উপযুক্ত। ... জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা পরিচালিত সরকার ও জনগণের জন্য গঠিত সরকার যেন কখনো পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত না হয়।’
সামরিক ও রাজনৈতিক জীবনে ১৯৪০ সালের ১৩ মে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথম ভাষণটি অমরত্ব দিয়েছে উইনস্টন চার্চিলকে। যেই ভাষণ পাল্টে দেয় ইংল্যান্ডের রাজনীতি। সেখানে তিনি বলেছিলেন ... যারা এই সরকারে মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন তাদের আমি বলেছি আর এই মহান সংসদকেও বলছি, দেওয়ার মতো কিছুই নেই আমার, আছে শুধু রক্ত, কষ্ট, অশ্রু আর ঘাম। আমাদের সামনে অগ্নিপরীক্ষা, আমাদের মাসের পর মাস যুদ্ধ করতে হবে আর কষ্ট সহ্য করতে হবে।
... তোমরা যদি জিজ্ঞেস কর আমাদের নীতিমালা কী, তবে জেনে রাখ আমাদের একটাই নীতি; জল, স্থল ও আকশপথে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া, আমাদের সবটুকু সামর্থ্য আর ঈশ্বর প্রদত্ত শক্তি নিয়ে আমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে এক নিষ্ঠুর দানবের বিরুদ্ধে। এটাই আমাদের নীতি । ... যদি প্রশ্ন কর আমাদের লক্ষ্য কী, তবে শুনে রাখ একমাত্র বিজয় ছাড়া আমাদের আর কোনো লক্ষ্য নেই। পথ যতই দীর্ঘ কিংবা কঠিন হোক, বিজয় ছাড়া আমরা অন্য কিছু ভাবছি না। বিজয় ছাড়া আমাদের কোনো পথ খোলা নেই।’
উপরোক্তদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর উত্থান, ভাষণ-শাসনের প্রেক্ষিত ভিন্ন। তিনি ভাষণে মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করার মহারাজ-মহানায়ক জাতির জনক বা বঙ্গবন্ধু হওয়ার আগে থেকেই। সেটা একাত্তরের ৭ই মার্চের ভাষণকে বাদ দিলেও। পাকিস্তান জমানায় তিনি যখন কারো কাছে শুধু মুজিব, কারো কাছে কেবলই শেখ সাহেব তখনও। তাই বঙ্গবন্ধুর শুধু একাত্তরের উত্তাল ৭ই মার্চের ভাষণকেই যতো গুরুত্ব-কৃতিত্ব দিয়ে বাকিগুলো ভুলে যাওয়া কাঙ্খিত নয়। এর আগে-পরে তার আরো অনেক ভাষণ রয়েছে। ৭ মার্চের ভাষণকে আর ইউনেস্কোর স্বীকৃতির পর অবস্থা যেদিকে মোড় নিচ্ছে তাতে বঙ্গবন্ধুর বাদবাকি ভাষণ আড়াল হবার একটা আলামত রয়েছে। প্রচুর তথ্য, স্বীকারোক্তি, আশা-হতাশা, ক্ষোভভরা সেইসব ভাষণে কেউ প্রীত। কেউ ভীত। ইতিহাসের সাক্ষীও। কিন্তু সুবিধা মতো প্রচার-অপপ্রচারে সেই ভাষণগুলোর দালিলিক মূল্য ও বহুমাত্রিকতা দুর্বল করা কাম্য নয়।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এইচআর/পিআর