মতামত

বাংলার সোনালী পাট যোগ্যতায় করবে বিশ্বমাত

সোনালী আঁশের সোনার দেশ, পাট পণ্যের বাংলাদেশ। আজ জাতীয় পাট দিবস। পাটের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে ২০১৭ থেকে জাতীয়ভাবে ৬ মার্চ জাতীয় পাট দিবস পালন করা হচ্ছে। আমাদের ইতিহাস সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের গর্বিত বাহন বাংলার সোনালী আঁশ পাট। পাট বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল দেশের তৃতীয় বৃহত্তম বৈদেশিক মূদ্রা অর্জনকারী খাত।

Advertisement

পাটের ভূমিকা অবদান স্বীকৃত ইতিহাস। দেশের ০৮ থেকে ১০ মিলিয়ন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পাট ও আঁশ ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৮ লাখ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয় যা থেকে প্রায় ৮০ লাখ বেল পাট আঁশ উৎপন্ন হয়। বছরে উৎপাদিত পাট আঁশের শতকরা প্রায় ৫১ ভাগ ভারী পাটকল গুলোতে ব্যবহৃত হয়, প্রায় ৪৪ ভাগ কাঁচাপাট বিদেশে রফতানি হয় ও মাত্র ৫ ভাগ দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যবহারে কাজে লাগে। গত ৭০ বা ৮০ দশকের তুলনায় বাংলাদেশে পাটের আবাদের জমি কমে গেলেও গত ৫-৬ বছরে আবার তা বাড়ছে আশাতীতভাবে।

পাট বহুগুণে গুণান্বিত ফসল। মাটির উবর্রতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাড়তি জনগোষ্ঠির খাদ্য চাহিদা মেটাতে বেশি পরিমাণ উর্বর জমি খাদ্যশস্য চাষের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় পাটের উর্বর আবাদী জমির পরিমাণ কম এবং ক্রমাগত প্রান্তিক ও অনুর্বর জমিতে পাট আবাদ স্থানান্তরিত হলেও জাতীয় গড় উৎপাদন বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। এর প্রধান কারণ পাট গবেষণায় উদ্ভাবিত আধুনিক প্রযুক্তি, উচ্চ ফলনশীল জাত এবং উৎপাদন কলাকৌশল ও সার্বিক ব্যবস্থাপনা।

বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় শতকরা ১২ ভাগ পাট চাষ এবং পাটশিল্প প্রক্রিয়াকরণ, আঁশ বাঁধাই, গুদামজাতকরণ, স্থানান্তর ও বিপণনের সাথে জড়িত। এ ছাড়াও কাঁচাপাট ও পাটজাত দ্রব্য বাংলাদেশের রফতানি ক্ষেত্রে রাজস্ব আয়ের একটি উল্লেখযোগ্য উৎস। পাট ফসল দেশের কর্ম সংস্থানে গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত সহায়ক ভূমিকা রাখছে। মোট কর্মসংস্থানের শতকরা প্রায় ১০ ভাগ পাটচাষ এবং চাষ পরবর্তী বিভিন্ন প্রক্রিয়া পাট চাষ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, আঁশ বাধাই, গুদামজাতকরণ, স্থানান্তর ও বিপণন কাজের সাথে জড়িত। বিশেষ করে পাটের আঁশ পচার পর আঁশ ছাড়ানো, ধোয়া ও শুকানো কাজে কৃষক পরিবারের মহিলা সদস্যদের অন্তর্ভুক্তি দেশের মহিলা বিনিয়োগী কর্মসংস্থানের এক বিরল উদাহরণ।

Advertisement

পাটের আঁশ বিক্রির টাকা গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিরাট ভুমিকা রাখে, গ্রামীণ জনপদে সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ও পরবর্তী রবি শস্য চাষের আর্থিক মোকাবেলা করার সাহায্য করে পাট চাষ। তাছাড়া পাটের অবদানের এভিনিউতে আছে দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, কুটির শিল্প, নারী উদ্যোক্তা, নারীর ক্ষমতায়ন, গ্রামের আধুনিকায়ন, অর্থনীতি শক্তিশালীকরণ, দেশের গৌরব বিশ্ব দরবারে উজ্জলতরকরণে পাটের অবদান ব্যঞ্জরিত।

দেশে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বাড়ার সাথে কমছে আবাদি জমির পরিমাণ। বিপুল জনগোষ্ঠী ও প্রাকৃতিকভাবে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে খাদ্য ঘাটতি মেটানোর জন্য কৃষক ঝুকছে খাদ্য ফসল উৎপাদনের দিকে। ফলে পাট চাষের জমি চলে যাচ্ছে প্রান্তিক ও অবহেলিত জমিতে। সত্তর দশকের আগে পর্যন্ত পাট আবাদের ক্ষেত্রে দেশি ও তোষা পাটের অনুপাত ছিল ৮০:২০। গবেষণা ও আধুনিক ব্যবস্থা সুনিশ্চিতকরণে সারা দেশে উৎপাদন প্রযুক্তির সম্প্রসারণ ঘটানোর মাধ্যমে, বর্তমানে দেশি ও তোষা আবাদের অনুপাত দাঁড়িয়েছে ২০:৮০। এ কারণেই প্রভাবেই পাটের গড় ফলনশীলতা বেড়েছে। সত্তর দশকের দিকে যেখানে পাট আবাদি জমির পরিমাণ ছিল মোট আবাদি জমির প্রায় ৭/৮ শতাংশ ও জমির পরিমাণ ছিল ১০-১২ লাখ হেক্টর, কিন্তু খাদ্য ঘাটতি চহিদার জন্য দাঁড়িয়েছে মোট জমির প্রায় ৪/৫ শতাংশে। তাই নির্দিষ্ট পরিমাণ প্রান্তিক ও অবহেলিত জমিতে বেশি ফলন নিশ্চিত করাই এ অবস্থা থেকে উত্তরনের একমাত্র উপায়।

বর্তমানে পাটের গড় ফলন হেক্টর প্রতি প্রায় ২ মেট্রিক টন। তা বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা ছাড়া বিকল্প উপায় নেই। এলক্ষ্যে পাটবিজ্ঞানী ও সংশ্লিষ্টরা পাটের উৎপাদন ফলন বাড়ানোর জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। পাট নিয়ে আমরা আবারো বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবো আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য আর কারিশমা দিয়ে। পাট ও পাটজাত দ্রব্যকে ব্যবহারে আমরা অগ্রাধিকার দেবো সর্বোতভাবে এ ব্যাপারে আমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ।

পাট পরিবেশবান্ধব বহুমুখী ব্যবহারযোগ্য আঁশ। শিল্প বিপ্লবের সময় ফ্লাক্স এবং হেম্পের স্থান দখল করে পাটের যাত্রা। বস্তা তৈরির ক্ষেত্রে পাট এখনও গুরুত্বপূর্ণ। পাটের আঁশের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অন্য অনেক আঁশের সাথে মিশ্রণ করে ব্যবহার করা যায় অনায়াসে। টেক্সটাইল প্রচলিত বয়ন শিল্পে সুতা, পাকানো সুতা, বস্তা, চট, কার্পেট ব্যাকিং, পর্দার কাপড়, কুশন কভার, কার্পেট, মনোহরি দ্রব্যাদি, কুটিরশিল্প, ঘরোয়া উপকরণ এসব পাটেরই অবদান। গরম কাপড়সহ বিভিন্ন ধরনে কাপড় তৈরির জন্য উলের সাথে মিশানো হয়। কৃষিপণ্যের মোড়ক, অন্যান্য দ্রব্যাদি বস্তাবন্দি ও প্যাকিং করার জন্য ব্যাপকভাবে পাট ব্যবহার করা হয়। পাটখড়ি পাট চাষের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ আকর্ষণ। পাট আঁশের দ্বিগুণ পরিমাণ খড়ি উৎপাদিত হয়। পাটের আঁশের বহুমুখী ব্যবহারের মধ্যে রয়েছে প্রসাধনী, ওষুধ, রঙ এসব। পাটখড়ি জ্বালানি, ঘরের বেড়া, ঘরের চালের ছাউনীতে এবং জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার হয়। বাঁশ এবং কাঠের বিকল্প হিসাবে পার্টিকেল বোর্ড, কাগজের মণ্ড ও কাগজ তৈরিতেও পাট খড়ি ব্যবহৃত হয়।

Advertisement

সোনালি আঁশ পাট বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্য। যুগযুগ ধরে এ দেশের কৃষকের আর্থিক সচ্ছলতার মূলে ছিল পাট। অর্থকরী ফসল হিসেবে পাট বাংলার মানুষের জীবনমানে যতটা পরিবর্তন আনতে পেরেছিল অন্য কোনো ফসলের পক্ষে তা সম্ভব হয়নি। বাংলায় উৎপাদিত পাটের প্রতি ইউরোপ আমেরিকা ঝুঁকে পড়েছিল।

১৭৯৫ সাল থেকে কৃষকের হাতে বোনা পাটের ছালা এবং অন্যান্য পাটজাত দ্রব্য আমেরিকায় রফতানি শুরু হয়। ওই বছরের শেষ দিকে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথম ইউরোপে পাট রফতানি করে। ১৮২৮ সাল থেকে ইংল্যান্ডের ডান্ডিতে পাট নিয়ে ব্যাপক পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু হয়। পরে সেখানে পাটকল স্থাপিত হওয়ার মধ্য দিয়ে পাটশিল্প দ্রুত প্রসার লাভ করে। ডান্ডিতে গড়ে ওঠা পাটকলগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচাপাটের সম্পূর্ণটাই সরবরাহ হতো তদানীন্তন পূর্ববাংলা থেকে। পশ্চিম বাংলায় তখন পাটচাষ ছিল না বললেই চলে। এমনকি ১৮৫৪ সালে অবিভক্ত বাংলায় শ্রীরামপুরের কাছে প্রথম যে পাটকল স্থাপিত হয়েছিল তারও কাঁচামাল হিসেবে যে কাঁচাপাটের প্রয়োজন হতো তা যেত পূর্ব বাংলা থেকে। অথচ এখন দৃশ্যপট সম্পূর্ণ উল্টো। বাংলাদেশে পাটের যখন ঘোর দুর্দিন চলছে তখন পশ্চিম বাংলায় পাটচাষ অধিকতর জনপ্রিয় হয়েছে।

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হলে তদানীন্তন পূর্ব বাংলায় পাট নিয়ে ব্যাপক জল্পনা কল্পনা শুরু হয়। প‚র্ব বাংলার মানুষের মনে চিন্তার উন্মেষ ঘটে পাট শুধু বিদেশে রফতানি নয় বরং বিভিন্ন কলাকৌশলের প্রয়োগ ঘটিয়ে দেশের অভ্যন্তরে পাটকে কি করে শিল্পে রূপ দেয়া যায়। ফলে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছোটবড় বিভিন্ন পাটকল গড়ে উঠতে শুরু করে। বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জে এ শিল্পের স্থানীয়করণ হয়। বিশ্বের বৃহত্তম পাটকল আদমজী এখানেই গড়ে ওঠে।

নারায়ণগঞ্জ বিশ্বের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে প্রাচ্যের ডান্ডি হিসেবে। পরে পাট শুধু পূর্ব বাংলার মানুষকেই স্বয়ম্ভরতা দান করেনি বরং পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পাটের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করে নিজেদের আখের গুছিয়েছে। বলা হয় ইসলামাবাদ শহরটি আমাদের পাটের টাকায় গড়া। পশ্চিমাদের এমন লুণ্ঠনের পরিণতিস্বরূপ একাত্তরে অভ্যুদয় ঘটেছিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। দেশ স্বাধীনের পর অন্যান্য পণ্য রফতানির সুযোগ না থাকলেও শুধু পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে।

১৯৮০র দশকে এসে এ খাত বিরাট ধাক্কা খায়। এর পেছনে মূলত দুটি কারণ কৃত্রিম তন্তু এবং কারো কারো উদাসীনতা। কৃত্রিম তন্তু আবিষ্কারের ফলে পাট ও পাটজাত দ্রব্যের কদর শুধু বিশ্ববাজারে নয় দেশের বাজারেও কমে যায়। পাটের চাহিদা কমে যাওয়ায় এর মূল্য সাংঘাতিকভাবে পড়ে যায়। ফলে কৃষক পাট চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। অপরদিক পাটকে কেন্দ্র করে দেশে যে শিল্প গড়ে উঠেছিল তা সংকটের মুখে পড়ে। বেকার হয়ে পড়ে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রায় দেড় লাখ শ্রমিক। বিজেএমসির যে পাটক্রয় কেন্দ্রগুলো ক্রেতা-বিক্রেতা ও ফড়িয়া-দালালদের পদচারণায় মুখরিত ছিল সেগুলোতে বিরাজ করতে থাকে সুনসান নিরবতা, যা দেখে দেশপ্রেমিক মানুষের বুকে ঐতিহ্যের হাহাকার বেজে ওঠে। পাটকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য সরকার সম্প্রতি বহুমুখী বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে। গ্রহণ করেছে বিভিন্ন যৌক্তিক পদক্ষেপ। পাট চাষীদের সহায়তা করার জন্য একটি তহবিল গঠন করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ১৬টি বাণিজ্যিক বাংকের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।

এ ছাড়া সরকার এ শিল্পের সুরক্ষায় প্রণীত পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন-২০১০ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। গত ২০১০ সালে সরকার পাটের মোড়কীকরণ আইন ২০১০ বাধ্যতামূলক করেছে। যার ফলে বর্তমানে দেশে পাট আঁশের চাহিদা আরো অতিরিক্তভাবে ২০ থেকে ২৫ লাখ বেল বেড়েছে। ২০১৬ তে পাটকে কৃষিজাত পণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। প্রণয়ন করা হয়েছে পাট আইন ২০১৭।

বর্তমানে ১৭টি পণ্যে পাটজাত মোড়ক ব্যবহৃত হচ্ছে। বন্ধ পাটকলগুলো চালু হয়েছে। আবাদি জমির পরিমাণ কমে যাওয়ায় এ অতিরিক্ত পাটের উৎপাদন সম্ভব করার জন্য পুরো বাংলাদেশে বিশেষ পরিকল্পনা আর যত্নের সাথে অনাবাদি, পতিত ও এক বা দুই ফসলি জতিতে পাট চাষের বিস্তার ঘটানো দরকার। এ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে বিজেআরআই কর্তৃক উদ্ভাবিত বিভিন্ন জাত প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনাপত্র ব্যবহার করতে হবে। তাছাড়া যেকোন দেশীপাট ও কেনাফ আঁশ ফসলের জাতসমূহ যে কোন প্রতিকূলতা বিশেষ করে লবণাক্ততাসহ্য শক্তি সম্পন্ন হওয়ায় বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত দেশীপাটের উন্নত জাতসমূহ বাংলাদেশের উপযোগী এলাকায় চাষ করা যায়। যা অদূর ভবিষ্যতে আঁশের চাহিদা পূরণে সহায়ক হবে।

মানবের অযাচিত হস্তক্ষেপ পরিবেশকে করেছে শংকিত। বিশ্ব আজ নিরাপত্তা খোঁজে। পরিবর্তিত জলবায়ু ও জৈব জ্বালানির উৎপাদন ধকলে বিশ্ব আজ ঝিমুচ্ছে। সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, কিয়োটো প্রটোকলের বাস্তবায়নে নিরন্তর নিমগ্ন। বিগত দু’দশকে বিশ্বব্যাপী পরিবেশ আন্দোলন জোরদার হয়েছে। পলিথিন ও সিনথেটিক পণ্য পচনশীল নয়। এটি পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করে। পাটের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী পলিথিন যে পরিবেশবান্ধব না সেটি আজ প্রমাণিত। পাটের মূল প্রতিদ্বন্দ্বীর পরাজয় প্রায় দু’ দশক আগে শুরু হয়। তবুও পাট উৎপাদনে প্রথম বাংলাদেশ অবারিত এ সুযোগকে কাজে লাগাতে পারেনি। স্বাধীনতার পর দেশে পাটের উৎপাদন হতো প্রায় এক কোটি বেল, সেখানে এখন উৎপাদিত হচ্ছে ৮০ লাখ বেল। পাকিস্তান ও মায়ানমার সাধ্যমত চেষ্টা করছে পাটের উর্ধ্বমুখী বাজার ধরতে।

আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে পাট পণ্যের চাহিদা প্রায় ৭.৫০ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে বাংলাদেশ রপ্তানি করে ৪.৬০ লাখ মেট্রিক টন। ভারত রপ্তানি করে ২.৮৫ লাখ মেট্রিক টন। আন্তর্জাতিক পাট বাজারের মোট ৬২% বাংলাদেশ পূরণ করত। বাংলাদেশ ৫০-৬০ লাখ বেল কাঁচা পাট উৎপাদন করে। এর মধ্যে শিল্পে ব্যবহৃত হয় ৩২ লাখ বেল এবং রপ্তানি হয় ২৪ লাখ বেল। বর্তমানে বাংলাদেশ মোট সাড়ে ৫ লাখ মেট্রিক টন পাটজাত পণ্য উৎপন্ন করে। যা আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা থেকে দুই লাখ মেট্রিক টন কম। দেশে উৎপাদিত পাটজাত পণ্যের মধ্যে অভ্যন্তরীণ ব্যবহার মাত্র ৮৩ হাজার ৫২৩ মেট্রিক টন। বাংলাদেশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত বছরে প্রায় ১৬ লাখ মেট্রিক টন পাটজাত পণ্য উৎপাদন করে। এর মধ্যে ১৩.৭২ লাখ মেট্রিক টন পাটজাত পণ্য নিজস্ব বাজারে বিক্রি করে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ বাজারে বিক্রয় হচ্ছে মাত্র ১৫-১৬ ভাগ। ভারতে অভ্যন্তরীণ বাজারে পাটের বাজার বাড়াতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে। সেখানে পরিবেশবান্ধব পাটের ব্যাগ ব্যবহারে বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

সুতরাং পাটের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে আমাদের দরকার সময় ও পরিমাণ মতো মানসম্মত পাট বীজ প্রাপ্তি নিশ্চিত করা; পাটচাষি ও মাঠকর্মীগণকে পাট উৎপাদন প্রযুক্তি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ প্রদান; পাটের কাটা পরবর্তী ব্যবস্থাপনা পাট পচানো, শুকানো ও গুদামজাতকরনের ব্যবস্থাদি গ্রহণ করতে হবে; পাট বীজ ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি সার, বালাইনাশক সহজলভ্য ও সরবরাহ নিশ্চিত করা; পাট চাষে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রচার প্রচারণা; উৎপাদন এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি; সে এলাকায় পাট আঁশ কেনাবেচার জন্য বাজার সৃষ্টি এবং আঁশ ও বীজ সংরক্ষণের জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্দোগে গুদাম তৈরি করতে হবে।

পাট থেকে উন্নতমানের ভিসকস সুতা তৈরিও বাজারজাতকরার প্রযুক্তি কৌশল প্রক্রিয়াধীন। এটি চূড়ান্ত হলে প্রতিবছর ৩০ থেকে ৩৫ হাজার মেট্রিক টন ভিসকস আমদানি করা লাগবে না। তখন আমাদের সাশ্রয় হবে ৭শ’ থেকে ৯শ কোটি টাকা। ১৯৯৬ সালে চীন পাট থেকে প্রথম ভিসকস সুতা উদ্ভাবন করে। বিশ্বব্যাপী কাঠ থেকে ভিসকস সুতা তৈরি হয়। ভিসকস অত্যন্ত উন্নত মানের সুতা। এ সুতা থেকে তৈরি পোশাক বেশ আরামদায়ক। বাজারমূল্যও সুতি কাপড়ের চেয়ে অনেক বেশি। পাট থেকে ভিসকস তৈরি করতে পারলে বাংলাদেশের আশানুরূপ সফলতা পাবে। গেল অর্থবছরে ৯২ লাখ বেল বা ২২/২৩ লাখ মেট্রিক টন পাট উৎপাদন হয়েছে।

বর্তমানে পাট উৎপাদনে ভারতের পর বাংলাদেশের অবস্থান। তবে ভিসকস উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ ভারত থেকে এগিয়ে এটা সুখের খবর। আমাদের বস্ত্র উৎপাদনে ৩১% তুলা থেকে, ৬৭% ভিসকস থেকে আসে। দেশে উৎপাদিত পাটের ১০% দিয়েই বাণিজ্যিকভাবে ভিসকস সুতা তৈরি করা সম্ভব। ২০১৪-১৫ তে ৬৩৭ কোটি ৮২ লাখ টাকার ৩৩ হাজার ৭৩৭ মেট্রিক টন ভিসকস আমদানি করা হয়েছে। এটি বছরে বছরে কেবলই বাড়ছে। আমরা যদি ভিসকস তৈরিতে সক্ষমতা অর্জন করি তাহলে দেশের হাজার কোটি টাকা অনায়াসে সাশ্রয় হবে।

বর্তমানে পাটপাতা থেকে পানীয় চা, পারে আশ থেকে ভিসকস, পচনশীল পরিবেশবান্ধব সোনালী ব্যাগ, জিওজুট টেক্সটাইল, পাটকাঠি থেকে চারকোলসহ ২৩৫ প্রকারের পাটজাত পণ্য তৈরি করে পাটের বহুমুখী ব্যবহার সুনিশ্চিত করা যাচ্ছে। পাট থেকে চা তৈরি হচ্ছে যা আমাদের জন্য অতি সুখের খবর। পাটখড়ি জ্বালানির প্রধান উৎস হলে গত কয়েক বছর ধরে পাটখড়ির চারকোল বিদেশে রফতানি হচ্ছে আয় হচ্ছে হাজার কোটি টাকা। কাচাপাট দিয়ে কতশত ব্যঞ্জরণী বহুমুখী পণ্য উৎপাদন তৈরি সম্ভব আমাদের দেশেই।

পাট বিষয়ে আমাদের আছে সুদক্ষ পাটচাষী, আছে আধুনিক উপযোগী জাত, উন্নত উৎপাদন প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনা, আর আছে বহুমুখী ব্যবহারের বিভিন্ন পাটপণ্য এবং ব্যবহারের বিভিন্ন উপযোগী ক্ষেত্র। শুধু প্রয়োজন একটু প্রয়াস, একটু দেশাত্ববোধ, একটু কার্যকর আন্তরিকতা। আমাদের দেশ এক সময় দেশী পাটের দেশ ছিল। গত ৭০-৮০ দশকে এ দেশে বহুল পরিমাণ দেশী পাট উৎপাদিত হতো। তা দিয়েই বাংলাদেশ হয়েছিল সোনার বাংলা। দেশীপাট তোষা পাটের তুলনায় অধিক প্রতিকূলতা সহ্য ক্ষমতা সম্পন্ন। তাই বাংলাদেশের অদূর ভবিষ্যতের অতিরিক্ত পাট আঁশের চাহিদা পূরণের জন্য পুরো বাংলাদেশের উপযোগী এলাকায় বিশাল নতুন সম্ভাবনাময় এলাকায় দেশী পাটের বিস্তার ঘটানোর মাধ্যমে দেশকে আঁশ চাহিদায় স্বয়ংসম্পন্ন করে গড়ে তোলার এখনই সময়।

বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় ৩% পাট থেকে আসে এবং দেশের জিডিপি’তে এর অবদান পাায় শতকরা ৩ ভাগ। প্রতি বছর প্রায় ২৫০০ কোটি টাকা কৃষক পেয়ে থাকে পাটআঁশ ও পাটখড়ি বিক্রি করে। এ দেশের প্রায় ৪০ লাখ কৃষক পাটের ফসল উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত থাকে। এ ছাড়াও কাঁচাপাট ও পাটজাত দ্রব্য বাংলাদেশের রপ্তানি ক্ষেত্রে রাজস্ব আয়ের একটি বড় উৎস হিসেবে পরিগণিত হচেছ। পাট দেশের কর্ম সংস্থানে বিরাট সহায়ক ভূমিকা পালন করছে গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত বিস্তৃতভাবে।

মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০% ভাগ পাট চাষ এবং চাষ পরবর্তী বিভিন্ন প্রক্রিয়া প্রক্রিয়াজাতকরণ, আঁশ বাধাই, গুদামজাতকরণ, পরিবহন/স্থানান্তর ও বিপণনের সাথে জড়িত। বর্তমানে বাংলাদেশে পাটচাষীর সংখ্যা ৪০ লাখ। জিডিপিতে পাটখাতের অবদান ০.২৬ শতাংশ এবং কৃষি জিডিপিতে ১.৪ শতাংশ। মোট শ্রমশক্তির ১২.৫ শতাংশ নিয়োজিত রয়েছে পাট উৎপাদনের কাজে। পাট শিল্পে জড়িত আছে ১ লাখ ৬৫ হাজার ৫ শত শ্রমিক। এর মধ্যে সরকারি সংস্থা বিজেএমসি শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ এবং বেসরকারি সংস্থা বিজেএসএ ও বিজেএমএ সংস্থা মিলে শতকরা ৬০ ভাগ শ্রমিকের কর্মসংস্থান করছে। মোট রপ্তানি আয়ের শতকরা প্রায় সাড়ে ৪ শতাংশ উপর্জন করা হয় পাট রপ্তানি থেকে। তৈরি পোশাকশিল্পের পর এটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম উপার্জন করা হয় পাট রপ্তানি থেকে, তৈরি পোশাক শিল্পের পর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাত। পাট থেকে আহরিত মোট বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় এক চতুর্থাংশ আসে কাঁচা পাট রপ্তানি থেকে।

পাট বাংলাদেশের ঐতিহ্য। একটি বাঙালি সংস্কৃতিরই একটি অপরিহার্য অংশ। এ দেশের কৃষকদের নগদ অর্থ উপার্জনে, কর্মসংস্থানে, দারিদ্র্য বিমোচনে, বৈদেশিক অর্থ আহরণে ও সর্বোপরি জাতীয় অর্থনীতিকে শক্তভাবে বিনির্মাণে পাটের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে বিশ্ববাজারে পাটের চাহিদার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে পাটের উৎপাদন বাড়ানোর যে অমিত সম্ভবনার দখিনা দুয়ার উন্মেচিত হয়েছে তাকে কাজে লাগাতে হবে পুরোপুরি পরিকল্পিতভাবে যৌক্তিকভাবে কৌশলে।

বিকাশ ঘটাতে হবে পাটভিত্তিক কলকারখানার। সেজন্য দরকার হৃদ্দিক পৃষ্ঠপোষকতা। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে ঐতিহ্যবাহী পাটের ক্ষেত্রে সে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে বর্তমান সরকার পুরোপুরি প্রস্তুত। বাংলার সোনালি আঁশ অদূর অভিষ্যতে তার হারানো গৌরব ফিরে পাবে এ প্রত্যাশা সকলের। পাটের টোটাল উন্নয়নে পাট গবেষক ও বিজ্ঞানী, পাট সম্প্রসারণবিদ, পাটচাষী, পাট ব্যবসায়ী, পাট প্রক্রিয়াজাতকরণকারীসহ সব গর্বিত সহযোগী যোদ্ধা বন্ধুদের নিরন্তর শুভেচ্ছা ও কৃতজ্ঞতা। পাট হোক আমাদের নিত্য সঙ্গী যুক্তিতে শক্তিতে কারিশমায় ঐতিহ্যে।

লেখক : কৃষিবিদ, অতিরিক্ত পরিচালক, ক্রপস উইং, কৃষি সম্প্রসারণঅধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা।

এইচঅার/পিআর