সময়ে কত কিছুই বদলে যায়! এক সময় প্রশংসার সাগরে ভেসে বেড়িয়েছেন। প্রশংসাসূচক ‘লড়াকু ক্রিকেটারের’ তকমা এঁটেছিল গায়ে। আর এখন সেই খালেদ মাহমুদ সুজনের গায়ে সমালোচনার কাঁটা! তাকে নিয়ে অনেক কথা।
Advertisement
তিনি একা অনেক পদে আসীন- বোর্ড পরিচালক, গেম ডেভেলপমেন্ট চেয়ারম্যান, জাতীয় দলের ম্যানেজার, সেই সুবাদে দল নির্বাচনী প্রক্রিয়ারও অংশ। অলিখিত নির্বাচকও। মাঝে টেকনিক্যাল ডিরেক্টরও ছিলেন। বিপিএলে ঢাকা ডায়নামাইটসের কোচ। ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে আবাহনী আর শাইনপুকুরের উপদেষ্টা কোচ।
এতগুলো দায়িত্ব একার কাঁধে। সমালোচকরা বলছেন, সুজন এখন দায়িত্বের ভারে ন্যুব্জ। দায়িত্বের চাপে তার ক্রিকেটীয় মেধা, প্রজ্ঞা ও মনন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যে ক্রিকেট কোচিং তার সবচেয়ে পছন্দের জায়গা, সেখানেও সাফল্য কমে এসেছে।
ঘরের মাঠে ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্ট আর শ্রীলঙ্কার সঙ্গে টেস্ট এবং টি-টোয়েন্টি সিরিজে টেকনিক্যাল ডিরেক্টর পদবি গায়ে থাকলেও আসলে সব কলকাঠি ছিল তার হাতেই। কিন্তু সেই পদে সুজন নিজের মেধা ও যোগ্যতার সত্যিকার ছাপ রাখতে পারেননি। দল হয়েছে চরম ব্যর্থ।
Advertisement
ভাবা হচ্ছে, দেশের মাটিতে জাতীয় দলের ব্যর্থতার দায় অনেকটাই বর্তেছে তার কাঁধে। গুঞ্জন আছে, বোর্ডও নাকি খালেদ মাহমুদ সুজনের দল পরিচালনা ও গেম প্ল্যান নির্ধারণে অসন্তুষ্ট। তাই তাকে নিদাহাস ট্রফিতে টেকনিক্যাল ডিরেক্টর পদ থেকে সরিয়ে আবারও ম্যানেজারের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আর পেস বোলিং কোচ কোর্টনি ওয়ালশকে ভারপ্রাপ্ত হেড কোচ করা হয়েছে।
এর মধ্যে একটা খবর চাওর হয়ে গেছে যে, টেকনিক্যাল ডিরেক্টর পদ থেকে সরানোয় ভীষণ অসন্তুষ্ট সুজন শ্রীলঙ্কা যাবেন না। আবার এমনও শোনা গেছে, তিনি অাবাহনী আর শাইনপুকুরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। দুই দলের উপদেষ্টা কোচ। প্রিমিয়ার লিগ জমজমাট। তাই যেতে চাননি সুজন।
তবে সেটা নিছকই গুজব। শেষ পর্যন্ত দলের সঙ্গে কলম্বো গেছেন সুজন। যাবার আগে আজ সকালে জাগো নিউজকে ইন্টারভিউ দিয়েছেন তিনি। সে একান্ত আলাপে অনেক খোলামেলা কথাই বলেছেন বাংলাদেশ দলের সাবেক অধিনায়ক।
অবলীলায় জানিয়েছেন, নাহ, কোনো রাগ-ক্ষোভ থেকে নয়। ঘরের মাঠে শ্রীলঙ্কার সাথে পারফরম্যান্স, ফল খারাপ হয়েছে। তাই মন ভালো ছিল না। সে কারণেই প্রথমে যেতে অনীহা ছিল। পরে বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের কথায় গিয়েছেন।
Advertisement
তার ম্যানেজার হওয়া নিয়েও আছে নানা রকম গুঞ্জন। কেন তাকে বার বার ওই পদে দেখা যায়? তিনি নিজেই কি সে পদে আগ্রহী? এসব স্পর্শকাতর বিষয়েও অনেক খোলামেলা কথা-বার্তা বলেছেন সুজন। আসুন শোনা যাক কেমন ছিল সে কথোপকথন?
জাগো নিউজ : বলা হচ্ছে, টেকনিক্যাল ডিরেক্টর পদ থেকে সরিয়ে ম্যানেজার করায় আপনি হতাশ, ক্ষুব্ধ। তাই অভিমান করে নিদাহাস ট্রফিতে যেতে চাননি? এমন কথার সত্যতা কতটুকু?
সুজন : ক্ষুব্ধ হবার কিছুই নেই। হতাশায় ডোবারও প্রশ্নই আসে না। আমি তো আর নিজে থেকে টেকনিক্যাল ডিরেক্টর হইনি। আমার দায়িত্বটা ছিল স্বল্প মেয়াদের। আমাকে একটা অন্তর্বর্তীকালীন দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। আমাকে তো আর বলা হয়নি, তুমি দশটি সিরিজ টেকনিক্যাল ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করবে। আমি খুব ভালোই জানতাম যে, কোচ চলে আসলেই আমাকে পুরনো পদে ফিরে যেতে হবে।
সত্যি বলতে কী আমার ভাবনায় ওই সিরিজটিই ছিল। কারণ আমার ধারণা ছিল, এক সিরিজ পরই হয়ত নতুন হেড কোচ চলে আসবেন। তখন আমাকে আবার ফিরে যেতে হবে ম্যানেজারের ভূমিকায়। তবে আমাকে যে ম্যানেজারের দায়িত্বটাই পালন করতে হবে, সেটাও ঠিক নয়। ওই পদও কিন্তু আমার স্থায়ী জায়গা না। সেটা আমার স্থায়ী চাকরিও না। বোর্ড আমাকে দেয় বলে করি। তাই টেকনিক্যাল ডিরেক্টর থেকে আবার ম্যানেজার করায় মন খারাপের প্রশ্নই আসে না।
জাগো নিউজ : এমন কথাও শোনা যাচ্ছে, আপনি আবাহনী শিবিরের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। নতুন দল শাইনপুকুরেরও পরামর্শক। প্রিমিয়ার লিগের প্রথম পর্বের খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ চলছে, তাই আপনি যেতে চাননি?
সুজন : কেউ যদি এমন চিন্তা করে থাকেন, তাহলে ভুল করবেন। সেটা পুরোপুরি ভুল ধারণা। আবাহনী-শাইনপুকুর কোনো ফ্যাক্টর না। হ্যাঁ, এটা সত্য ওই দুই শিবিরের সঙ্গেই আমার সম্পৃক্ততা আছে। আমি বেক্সিমকোতে চাকরি করি। কাজেই আমার একটা দায়বদ্ধতা আছে। কিন্তু তার চেয়ে আমার দেশ ও জাতীয় দলের প্রতি দায়বদ্ধতা অনেক বেশি। আমি ক্লাব স্বার্থ দেখতে গিয়ে ন্যাশনাল টিমের সঙ্গী হবো না , তা কখনো স্বপ্নেও ভাবি না। তবে আমি যেহেতু চাকুরি করি, তাই লিগ চলাকালীন আমার যাওয়ার জন্য কিন্তু বেক্সিমকো কর্তৃপক্ষের আনুষ্ঠানিক অনুমতিও প্রয়োজন।
তবে সায়ন ভাই (বেক্সিমকোর অন্যতম স্বত্বাধীকারী সালমান এফ রহমানের ছেলে সায়ন এফ রহমান ) সব সময়ই ইতিবাচক মানসিকতার মানুষ। তিনি কোনো সময় আমাকে ক্লাবের জন্য থাকতে বলেন না। সব সময় বলেন, দেশ ও জাতীয় দল অনেক বড়। সবার আগে। এবারও তিনি বলেছেন, তোমার যেতে হবে। তবে হ্যাঁ , আমি আসলেও যেতে চাইনি। তবে না যাবার পিছনে আপনি যে কারণ ব্যাখ্যা করলেন, তা নয় মোটেই। আসলে আগের সিরিজে ফল খারাপ ছিল। তাই মনও খুব ভালো ছিল না। বোর্ড থেকে আমাকে কলম্বো যেতে বলা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট পাপন ভাই (নাজমুল হাসান) আমাকে ফোন করে বলেছেন, তুমি ম্যানেজার হয়ে যাও। আমি তো আর উনার কথা ফেলতে পারি না।
জাগো নিউজ : আচ্ছা, আপনার এ ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করা নিয়েও তো মুখরোচক কথা-বার্তা শোনা যায়। এমনও বলা হয়, আপনি নাকি নিজে যেচে ম্যানেজার হতে উৎসাহী?
সুজন : হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমিও বুঝি। সত্যি কথা বলতে কি, আমি যাই বলেই কথা হয়। লোকজন কানাঘুষো করে। তীর্যক চোখে তাকায়। আমি না গেলে কোনোই কথা হতো না। তাও বুঝি। জানি। কিন্তু যারা আমার ম্যানেজার হওয়া নিয়ে সমালোচনা করেন, তারা খুঁটিয়ে দেখেন না। ম্যানেজার পদ তো আর আমার স্থায়ী চাকরি বা দায়িত্ব না। তারা জানেন না যে, বোর্ড আমাকে যেতে বলে, তাই আমি যাই। আমি চাইলেই কি আমাকে বার বার ম্যানেজার করে পাঠানো হবে? আমার ইচ্ছে ও চাওয়াই কি সব? ইনারা (বোর্ড কর্তারা) সব সময় চায়, আমি ম্যানেজার হয়ে যাই। জানি না কেন আমাকেই বারবার ম্যানেজার করা হয়, হয়তো আমার প্রতি আস্থা বেশি তাই।
জাগো নিউজ : এবার নিদাহাস ট্রফিতে আপনার দায়িত্ব-কর্তব্য ও ভূমিকা কি থাকবে?
সুজন : ম্যানেজার হিসেবে আগে যে রোলটা ছিল, যেমন দায়িত্ব পালন করেছি, সেটাই থাকবে। তাই করবো। ম্যানেজার হিসেবে আমি তো এমনিতেই টিম সিলেকশনের অংশ। দল সাজানোর কাজে সম্পৃক্ততা থাকবে। সেই কাজটি করবো। এছাড়া প্রয়োজনীয় বুদ্ধি-পরামর্শ দেয়ার কাজটি অতীতেও করেছি, এবারও হয়তো করবো। আগে অনেক সময়ই টিম খারাপ করেছে, তখনও আমরা ক্রিকেটারদের সঙ্গে থেকে তাদের সাহস জোগানোর পাশাপাশি অনুপ্রাণিত করেছি। এবারও তাই করার চেষ্টা থাকবে।
জাগো নিউজ : সাকিবের ইনজুরিজনিত অনুপস্থিতি দলের জন্য কতটা ক্ষতির কারণ? এবারও তাকে ছাড়া খেলতে হবে।
সুজন : সাকিবের অনুপস্থিতি অনেক বড় ফ্যাক্টর। এক কথায় সাকিবের রিপ্লেসমেন্ট বাংলাদেশে নেই। যেই হোক না কেন, একজন ব্যাটসম্যান কিংবা একজন বোলারের বিকল্প কিন্তু আছে আমাদের। কিন্তু সাকিবের বিকল্প নেই। তাকে রিপ্লেস করতে পারে, এমন কেউ নেই বাংলাদেশে। সাকিব আমাদের এক নম্বর বড় ম্যাচ উইনার। যখন জোড়াতালি দিয়ে খেলাতে হয়। একজন ব্যাটসম্যান খেলাতে হয়। আবার একজন বোলার খেলানোর চিন্তা-ভাবনাও করতে হয়। তাতে দলের স্বাভাবিক গঠনশৈলি বিঘ্নিত হয় দারুণভাবে। মোদ্দা কথা, সাকিবকে ছাড়া খেলতে নামার অর্থ- ব্যাটিং ও বোলিংয়ের সেরা পারফরমার, সেরা অস্ত্র ছাড়া যুদ্ধে নামা। সাকিব না থাকলে বোঝা যায়, দলের জন্য সাকিব কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
আমি কখনই কোন অজুহাত দাঁড় করাই না। আমার ক্যারিয়ারে কোনো সময় না পারার পিছনে কোনো কারণ চিহ্নিত করে অজুহাত দাঁড় করাইনি। এখনও করতে চাই না। তবে এটা সত্য যে, তিন জাতি আসরের ফাইনাল এবং টেস্ট-টি টোয়েন্টি সিরিজে সাকিবের না থাকাটা অনেক বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ওই সিরিজ দুটি খারাপ কাটার একটা বড় কারণই ছিল সাকিবের অনুপস্থিতি। সাকিবের ঘাটতি কোনোভাবেই পূরণ হয়নি। আশা করি, সাকিব সুস্থ হয়ে ফিরবে। দলে তার থাকাটা যে খুব জরুরী।
জাগো নিউজ : ভারপ্রাপ্ত কোচ কোর্টনি ওয়ালশ সম্পর্কে কিছু বলুন। দায়িত্ব প্রাপ্তির পর তার সঙ্গে কি কথা-বার্তা হয়েছে?
সুজন : হ্যাঁ। তার সঙ্গে আমার অনেক আলাপ হয়। খুব ভালো মানুষ। প্রাণখুলে কথাও বলেন প্রচুর। তার সাথে আমার দল নিয়ে আগেও কথা হতো। এখনো হয়েছে। ক্রিকেটারদের সাপোর্ট করেন। উৎসাহও জোগান।
জাগো নিউজ : নিদাহাস ট্রফিতে আপনার প্রত্যাশা কি? সাকিবকে ছাড়া দল কতটা কি করতে পারবে?
সুজন : কঠিন হবে। বলছি না কাজটা সহজ হবে। তারপরও বিশ্বাস আছে। সাকিব ছাড়াও দলে ভালো পারফরমার আছে। ম্যাচ উইনারও আছে, যারা ভালো করতে পারে, ভালো করার সামর্থ্য আছে। সৌম্য, সাব্বির ঠিকমত পারফরম করছে না। তাসকিনও নতুন করে দলে ফিরেছে। তারা যদি জ্বলে উঠতে পারে, তাহলে অবশ্যই ভালো কিছু হতে পারে। আমি বিশ্বাস করি, সামর্থ্য আছে।
জাগো নিউজ : প্রতিপক্ষ সম্পর্কে কিছু বলুন।
সুজন : সন্দেহ নেই, দুটি দলই যথেষ্ট শক্তিশালি। ভারত এখন প্রায় দুদর্মনীয়। যেই আসুক আর না আসুক, ভারত এখন অন্যরকম এক শক্তি। ভারতীয়রা দারুণ ক্রিকেট খেলছে। আর শ্রীলঙ্কা ঘরের মাঠে সব সময়ই কঠিন প্রতিপক্ষ। তারপরও গত বছর লঙ্কানদের মাটিতে আমরা তাদের হারিয়ে এসেছি। সেটা একটা অনুপ্রেরণা।
আমি আশাবাদি। আমার আশাবাদি হবার একটা কারণও আছে। আমরা কিন্তু কখনো কখনো দেশের বাইরেও ভালো খেলি। দেশে কোনো কোনো সময় আমাদের ওপর বাড়তি চাপ থাকে। সেটা অবশ্যই প্রত্যাশার চাপ। সবাই তাকিয়ে থাকে। গ্যালারি ভর্তি দর্শক, অকুণ্ঠ সমর্থন যেমন ভালো খেলার অনেক বড় রসদ, আবার একটু মানসিক চাপও। দেশের বাইরে সে চাপ কিছু হলেও কম থাকে। সেজন্য আমরা মাঝে মধ্যে দেশের বাইরে গিয়েও ভালো খেলি। এবার চাপমুক্ত পরিবেশে সেই ভালো খেলার আশায়ই আছি।
এআরবি/এমএমআর/আরআইপি