মতামত

রাজনীতিকদের দুর্নীতি

ঋতু বদলেছে। শীত গিয়ে বসন্তের মাতাল হাওয়া এখন। তবে বাংলাদেশে দুর্নীতির ঋতু অপরিবর্তিত থাকে। বিএনপি চেযারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দুর্নীতিতে দন্ডিত হয়ে এখন কারাগারে। এখন উচ্চ আদালতে লড়ছেন তার আইনজীবীরা। এবং একে কেন্দ্র করে রাজনীতিতেও মাতাল হাওয়া বইছে।

Advertisement

বিতর্ক চলছে, পথে ঘাটে, প্রান্তরে। টেলিভিশন টকশোতে উচ্চকিত সব কণ্ঠ। অভিযোগ উঠা এবং তা প্রমাণিত হওয়া দুটি ভিন্ন ঘটনা। নিম্ন আদালতে রায় হয়েছে, এখনো অনেক পথ বাকি আছে। অভিযুক্তকে দোষ দেওয়া না দেওয়ার বিতর্কের চেয়েও বড় বিষয় নৈতিকতার প্রশ্ন। রাজনীতিকদের নিকট নৈতিকতার একটি দাবি আছে। আবার একথাও সত্য যে, জনগণের অতি ক্ষুদ্র অংশই ভাবতে চাইবে যে রাজনীতিকরা দুর্নীতিবাজ নয়।

এই মামলাটির রায় নিম্ন আদালতে হতেই দশ বছর গেছে। সামনে আরও কত সময় যায় বলা মুশকিল। বিচারবিভাগের দীর্ঘসূত্রতা বিষয়ে বহু বার বহু আলোচনা হয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগ বিচারের ক্ষেত্রে, বোধ হয়, এই রোগ আরও প্রবল। ফলে এদেশের রাজনীতিকরা জানেন, দুর্নীতির যে অভিযোগই তাদের বিরুদ্ধে উঠুক না কেন, শেষ পর্যন্ত তারা যেমন আছেন, তেমনটিই থাকবেন। বড় জোর কিছু দিন লোকলজ্জা সইতে হবে। লোকলজ্জায় তাদের কম্পিত হতে অবশ্য জনগণ দেখেনি কখনও।

দেরিতে হলেও একটি রায় হয়েছে। তবে একথা সত্য যে, দেশের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থায় অসৎ রাজনীতিকদের শাস্তিবিধানের আশা জনগণ করেনা। এবং এভাবেই প্রতিষ্ঠানগুলোর ভিত নষ্ট হয়েছে, রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের বিশ্বাস ভেঙেছে। বেগম খালেদা জিয়ার দুর্নীতির চেয়েও বড় সব দুর্নীতি এখন হচ্ছে। অনেকেই এ নিয়ে যুক্তি দিচ্ছেন। বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম ও দুর্নীতি বিশেষভাবে আলোচিত। কিন্তু একটা কথা সত্য যে, বড় আর খুচরো দুর্নীতিকে আলাদা করা মুশকিল। দুর্নীতি দুর্নীতিই তার পরিমাণ যাই থাকুক। তবে তার চেয়ে বড় বিষয় কোন অবস্থানে থেকে দুর্নীতি করা হচ্ছে বা হয়েছে সেটি বিবেচনায় নিয়ে বিতর্ক করা।

Advertisement

২০০৮ সালে Corruption and Development : A primer শীর্ষক একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনডিপি। সেই রিপোর্টে দুর্নীতির নানা ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। ‘ঘুষ’ মানে কাউকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়ার জন্য তাকে টাকা, সেবা বা অন্য কোনও সুবিধা পাইয়ে দেওয়া। ‘জালিয়াতি’ মানে কোনও অন্যায্য সুবিধা পাওয়ার জন্য ভ্রান্ত বা মিথ্যা তথ্য পেশ করা। ‘মানি লন্ডারিং’ মানে কালো টাকা সাদা করা- অন্যায় পথে অর্জিত অর্থকে এক খাত থেকে অন্য খাতে পাচার করে তাকে আইনি করে তোলা।

‘এক্সটর্শন’ মানে ভয় দেখিয়ে বা জুলুম করে অন্যায্য ভাবে টাকা, সম্পত্তি বা কোনও গোপন তথ্য আদায় করা। ‘কিকব্যাক’ হল কমিশন, অন্যায় ভাবে কিছু টাকা পাইয়ে দেওয়ার জন্য সেই টাকার একটা হিস্যা পাওয়া। ‘প্রভাব খাটানো’ মানে নিজের অবস্থানগত প্রতিপত্তির সুযোগ নিয়ে কাউকে কোনও অন্যায় সুবিধা পাইয়ে দেওয়া। ‘ক্রোনিজম’ বলতে বোঝায় নিজের বন্ধুবান্ধবদের, তাদের যোগ্যতার কথা বিবেচনা না করেই বিভিন্ন সম্পদ বা কাজ বণ্টনের সময় বাড়তি সুবিধা করে দেওয়া।

‘নেপোটিজম’-ও অন্যায্য সুবিধা পাইয়ে দেওয়া, কিন্তু পরিবারের লোককে। ‘প্যাট্রোনেজ’ বা পৃষ্ঠপোষকতা হল কোনও ধনী বা প্রভাবশালী মানুষের ছত্রচ্ছায়ায় থাকতে পারা। কোনও দায়িত্ব পালনের সময় কোনও গোপন তথ্য জানতে পেরে পরে সেই তথ্যকে ব্যক্তিগত লাভে ব্যবহার করা মানে হলো ‘ইনসাইডার ট্রেডিং’। আমলাতন্ত্রের জটিলতা কাটাতে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক দ্রুত কাজ করিয়ে নেওয়ার জন্য যে টাকা দেওয়া হয়, তার নাম ‘স্পিড মানি’। বাংলাদেশে এইসব অন্যায় পথে অর্থ আয়ের সবগুলো পথই বিরাজমান এবং সবগুলোতেই রাজনীতিকদের সংযোগ আছে।

বড় ছোট সব রাজনীতিকই দুর্নীতিতে যুক্ত এমন একটি সাধারণ ধারণা আছে মানুষের মাঝে। এটি হয়তো সবার বেলায় সত্য নয়। এখনও অনেক রাজনীতিক আছেন যারা আতি সাধারণ জীবন যাপন করেন। এমন দু’একজনের কথা উঠেও আসে নানা সময়ে। কিন্তু একটা কথা সত্য যে, রাজনীতির যোগসাজশেই এদেশের জমি, ভূমি, জলাধার, প্রাকৃতিক সম্পদ লুট করছে একটি শ্রেণি। রাজনীতি তথা রাজনীতিকদের এই যোগসাজশের কারণেই আমলাতন্ত্র থেকে দুর্নীতি বিদায় করা সম্ভব হচ্ছেনা। ফলে দেখা যায়, সামান্য সরকারি সেবা, যা তার অধিকার, সেটা পেতেও একজন নাগরিককে ঘুষ বা ‘স্পিড মানি’ দিতে হচ্ছে।

Advertisement

এটি আসলে একটি অদ্ভুত সিস্টেম। গায়ের জোরে জমি-বাড়ি দখল করে, টেন্ডার ছিনিয়ে নিয়ে যারা অর্থ কামাচ্ছে তারাই রাজনীতিতে আসছে। রাজনীতিতে এসে আবার সে পথেই আরও অর্থের মালিক হচ্ছে। আর তার পকেটে থাকা বিপুল এই অনার্জিত অর্থকে সুরক্ষা দিতে রাজনীতিকরা সখ্য গড়ে তোলে আমলাদের সাথে। ফলে কাঠামোগতভাবে গণবিরোধী আমলাতন্ত্র শেষ পর্যন্ত জনতার সাথে শত্রুতার আচরণকেই সংস্কৃতি মনে করছে।

বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, আর্থিক অনিয়ম, সরকারি উচ্চপদ ব্যবহার করে নিজের ও পরিবারের কাছের মানুষদের আর্থিক মুনাফা দেওয়ার অভিযোগে আদালত একটি রায় হয়েছে। এই ঘটনার তীব্র প্রতিক্রিয়ায় আমাদের রাজনীতিতে শোরগোল পড়েছে। রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি একরকম বলছে, ক্ষমসতাসীন আওয়ামী লীগ আরেক রকম করে তর্ক করছে। কিন্তু উভয় দল সাহসের সাথে একথা বলতে পারছেনা যে, রাজনীতিকরা দুর্নীতিমুক্ত।

আসলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামী সংগঠন হিসেবে কোন রাজনৈতিক দলেরই কোনও বিশ্বাসযোগ্যতাই গড়ে উঠেনি। তাই রাজনীতিকদের দুর্নীতি বা আর্থিক অনিয়মের ব্যাপারে রাজনীতিকরা যখন রাজনীতি খোঁজেন তখন জনগণ কেবল অবাক হয়ে দেখে।

লেখক : বার্তা পরিচালক, একাত্তর টিভি।

এইচআর/এমএস