মতামত

এ কোন অসভ্য পৃথিবী দেখছি আমরা?

সারাবিশ্ব জুরে যেন এক যুদ্ধময় পরিস্থিতি চলছে। বিশ্ব রাজনীতির নতুন মেরুকরণে চালকের আসনে কে থাকবে আর কে হারবে সে হিসাব নিকাশে সবসময়েই চলে আসছে মানবিকতার বিপর্যয়। রাজনৈতিক নেতৃত্বের ক্ষমতা প্রদর্শনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে সাধারণ অসহায় মানুষ। এসব মানুষের কখনই ক্ষমতার পালাবদলে কিছু আসে যায় না। শক্তি প্রদর্শনেরও কিছু থাকে না। বরং নেতাদের শক্তির পিছনের শক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয় এই অসহায় মানুষগুলো।

Advertisement

আমরা একটি সভ্য ও আধুনিক বিশ্বের নাগরিক হিসেবে নিজেদেরকে দাবি করি। আধুনিক বিশ্বের সবকিছুই এখন অনেক বেশি অগ্রসর। পরিবর্তিত হচ্ছে রাজনৈতিক নেতাদের মানসিকতারও। আমরা একটি মানবিক পৃথিবীর কথা বলি। প্রতিনিয়ত লড়াই করে চলি একটি বাসযোগ্য পৃথিবী পাবার জন্য। কিন্তু, কোথায়, কাদের কারণে আমরা বারবার হেরে যাচ্ছি? কীসের লোভে আমাদেরকে হারিয়ে দিতে চায় তারা? কিছু মানুষের আদিম ও বর্বর সুখের জন্য অসহায় তাকিয়ে থাকে বৃহৎ অংশটি।

ভোগ দখলের রাজনীতির কারণে অনেক দেশকেই আমরা বিরান ভূমিতে পরিণত হতে দেখেছি। দেখেছি কেমন করে নিষ্ঠুর বোমার আঘাতে হাজারো মানবের প্রাণ কেড়ে নেয়া হয়েছে। এই একটা জায়গায় খুব কি এগুতে পেরেছে আমাদের বিশ্ব রাজনীতি? না, পারেনি। দখলের রাজনীতি নেশা এখনও জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিচ্ছে সভ্যতাকে।

ইরাক, আফগানিস্তান, সোমালিয়া, সুদানের মত দেশগুলো এক একটি জ্বলন্ত কঙ্কাল হয়ে সেই অসভ্যতার উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই যে ভোগ দখলের রাজনীতি সেখানে উপকার কাদের? কাদের জন্য এই রাজনৈতিক লড়াই? মানুষই যদি বেঁচে না থাকে তাহলে আপনাদের রাজনৈতিক ঝান্ডা উড়াবে কারা? দেশে দেশে আপনাদের স্তুতি গাইবে কারা? অথচ হিংসার আগুনে জ্বলতে থাকা নেতারা এসবের কিছুই গ্রাহ্য করেন না। তাঁদের কাছে কেবল দখলেই শান্তি। সিরিয়ার সেইসব বাচ্চাদের কান্না, মৃত দেহগুলো তাঁদের কাঁদায়না।

Advertisement

সিরিয়ার রাজনৈতিক সমস্যা আজকের নতুন নয়। সমাধানের কোন উদ্যোগ না দেখা গেলেও নতুন করে যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরিতে দেখা যাচ্ছে আন্তর্জাতিক মোড়লদের সব চমৎকার উদ্যোগ। প্রতিদিন আমরা সিরিয়ার অসহায় মানুষের রক্তাক্ত মুখগুলো দেখছি আর ভাবছি এ কোন পৃথিবীর দিকে এগিয়ে চলেছি আমরা? বিদ্রোহীদের দমন করার নামে সিরীয় সরকারের বাহিনী একের পর এক হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। আহত নিহত হচ্ছে শত শত বেসামরিক লোকজন।

জানিনা সিরীয় সরকারের বাহিনী ছোট্ট ফুটফুটে শিশুটিকে বোমায় আঘাত করে কোন বিদ্রোহীকে দমন করতে চাইছে বা করছে। অক্সিজেনের অভাবে মরে যাওয়া সেই শিশুটির কাছে কী জবাব দেবেন সরকার? শিশুর মৃতদেহ কোলে নিয়ে আশ্রয়ের খোঁজে দৌড়ে বেড়ানো পিতা মাতার আহাজারিতে কোন সফলতা দেখছে বিশ্ব নেতারা?

অভিযোগ উঠেছে সিরীয় বাহিনীকে রাসায়নিক অস্ত্র তৈরির সরঞ্জামাদি সরবরাহ করছে উত্তর কোরিয়া। আছে আমেরিকা ও রাশিয়ার আধিপত্যের হিসাব। উত্তর কোরিয়ার সরকার যদি সত্যি এসব মরাণাস্ত্র সরবরাহ করে থাকে তবে কেবল অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যে পরিচালিত এই মানবতাবিরোধী কর্মের জন্য ইতিহাস কী তাদের ক্ষমা করবে?

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যখন সিরিয়াকে যুদ্ধবিরতির জন্য দাবি জানাচ্ছে তখন রাশিয়া হিসাব করছে তার স্বার্থ। তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে, রাশিয়ার কাছে কোনটা বড়? মানবতাকে রক্ষা, মানুষের জানের নিরাপত্তা না রাজনৈতিক ক্ষমতা?

Advertisement

মানুষ হিসেবে আমাদের কাছে কি সেসব নিষ্পাপ শিশুগুলোর জীবনের কোন অর্থ নেই? বিদ্রোহ দমনের নামে যে একটি দেশকে ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে এ কেমন মানবতা? এ কেমন রাজনীতি? এই ক্ষমতা দিয়ে কী হবে? বোমার আঘাত না থাকলেও মানবতার বিচারে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা অবস্থাও কোন অংশে কম নয়। ভোগ দখলের রাজনীতি শিকার সেই অসহায় মানুষেরাই। বছরের পর বছর ধরে চলে আসা মিয়ানমার সরকারের রোহিঙ্গা নির্যাতনের চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটেছে ২০১৭ সালের অাগস্টের ঘটনায়।

প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা জীবন নিয়ে পালিয়ে এসেছে বাংলাদেশে। যাদের বেশিরভাগই শিশু ও নারী। মানবেতর জীবন যাপনের চূড়ান্ত অবস্থা চলছে তাদের। ৬ মাস কেটে গেলেও এখনও কেউ জানেনা এসব রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ কী? জাতিসংঘের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে জানা গেছে ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শিশু মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হবার হুমকিতে আছে। যেসব শিশুরা এসেছে তাদের বেশিরভাগই পিতাকে হারিয়েছে মিয়ানমার সেনাদের হাতে। অনেক শিশুর জন্ম হয়েছে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিবিরে। পিতৃ পরিচয়ের সংকটে থাকা এসব শিশুকে কে দিবে জাতীয়তার পরিচয়? কে নিবে এদের ভরণপোষণের দায়িত্ব?

একজন মানুষের স্বাভাবিক বেড়ে উঠার যেসব শর্ত সেসবের একটিও কি আছে এদের? কেবল জীবন বাঁচিয়ে বেড়ে উঠাকেই কী মানবজীবন বলা যায়? শিক্ষা, খাদ্য, বস্ত্রসহ মৌলিক প্রাপ্যগুলো কে দিবে এসব শিশুদের? জাতিসংঘ সামনের দিনের মৌসুমী আবহাওয়াকে মাথায় রেখেই এই হুমকির কথা বলেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এদের সাহায্যে এগিয়ে আসার আহবান জানিয়েছে। কিন্তু এভাবে পরাশ্রয়ে বেড়ে উঠাকে কী জন্ম বলে? যে শিশু জানতেই পারছে না তার পিতা কে, কী তার নাগরিক পরিচয়, কী তার ভবিষ্যতের পরণতি, সে শিশুর কাছে এই পৃথিবী কী আশা করতে পারে? এরা কী দিবে এই বিশ্বকে? অথচ এদেরও ভূমিকার থাকার কথা ছিলো একটি মানব সমাজকে এগিয়ে নেবার কাজে।

মাঝেমাঝে নিজেকে বড় অসহায় লাগে এসব শিশুদের রক্তাক্ত চেহারাকে দেখে। ভাবতে বসি, বিশ্ব বিবেক আজ কী নিয়ে ব্যস্ত তবে? কেন এসব শিশুদেরকে আমরা একটি নিরাপদ পৃথিবী, নিশ্চিত ভবিষ্যৎ দিতে পারছি না। কোথায় আমাদের কুণ্ঠা, কী সেই দ্বিধা যা বিশ্ব নেতৃত্বকে এক হতে দিচ্ছে না। সবাই কেন একই কণ্ঠে চিৎকার করে উঠতে পারছে না যে এই পৃথিবী আর রক্ত চায় না, আর কান্না চায় না।

আমরা একটি শান্তির দুনিয়া চাই। মানবের জন্য দুনিয়া যেখানে ক্ষমতার জন্য রাজনীতি নয়, মানুষের রাজনীতি হবে ক্ষমতার হাতিয়ার। আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য আর হানাহানি, খুনোখুনি নয় সকলের জন্য বাসযোগ্য একটি স্থান গড়াই হবে আমাদের ধর্ম।

জানিনা সে পৃথিবী আদৌ পাবো কি না। জানিনা এই রক্তাক্ত শিশুগুলোর মুখে আর কখনও হাসি ফুটবে কি না। বোমায় পঙ্গু হয়ে বেড়ে উঠা শিশুটি নিজেকে আর কখনও সক্ষম ভাবতে পারবে কিনা। হে সিরীয় সন্তান আমার, হে রোহিঙ্গা সন্তান, তোমাদের কাছে বড় অপরাধী আমরা। অনেক কিছুই করার ছিলো কিন্তু কিছুই করতে পারছি না। তোমরা শক্ত হয়ে উঠো। একদিন তোমাদের হাতেই হোক তবে মানুষের পৃথিবীর উত্থান।

লেখক : কলামিস্ট।

এইচআর/এমএস