পৃথিবী এখন লাইফসাপোর্টে। অসুস্থ পৃথিবীর ভেতরে বেঁচে আছে মানুষ। অসুস্থ পৃথিবীর সব মানুষ অসুস্থ না হোক- অন্তত আতঙ্কের মধ্যে সবাই যে ঘুরপাক খাচ্ছে তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। পৃথিবীর পরতে পরতে ঘটে যাওয়া অসংখ্য ঘটনা ইতিহাস তৈরি করছে। এসব আলোড়ন তোলা ঘটনাবলী নিয়ে গল্প, উপন্যাস, সিনেমা হচ্ছে। বিষয়গুলোর দুই একটি বাদে সব ভুলে যায় মানুষ। কিছু মহান মানুষ আর কতক ঘটনা শতাব্দী থেকে শতাব্দী প্রেরণা বিলায়। সঞ্জিবনী শক্তি ও সাহস জোগায়। তেমনি বিশ্বের গুরুত্ববহ কিছু ঘটনা, জীবন, রাজনৈতিক বিশ্লেষণ, সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে লেখা হয়েছে ‘আতঙ্কের পৃথিবীতে এক চক্কর’ গ্রন্থটি। বইটির লেখক মিলু শামস। একত্রিশটি গবেষণাধর্মী অতীব প্রয়োজনীয় তথ্যসমূহকে প্রাঞ্জল শব্দশৈলীতে উপস্থাপন করেছেন লেখক।
Advertisement
‘মার্কেস এবং তাঁর লাতিন আমেরিকা’ প্রবন্ধে আমেরিকার ইতিহাস স্বল্প কথায় তুলে ধরার কৌশল লেখকের জানা-শোনার পরিধি ও চিন্তার গভীরতা প্রকাশ পেয়েছে। যা থেকে পাঠক একদিকে যেমন ইতিহাস জানবেন তেমনি নিখাদ সাহিত্যিক আনন্দ উপভোগ করার সুযোগ পাবেন। গ্রন্থটিতে মিলু শামস সাহিত্য ও রাজনীতির অন্তর্নিহিত সম্পর্ক চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘মার্কেস শুধু একশ বছরের নীরবতার গল্প শোনান না। শতকের পর শতক নীরব থাকা, ঘুমিয়ে থাকা মহাদেশটিকে প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে জাগিয়ে তোলেন। হয়তো সে জন্যেই ঘুরে দাঁড়াতে পারে আমেরিকা। মার খেতে খেতে সটান দাঁড়িয়ে আবার জানাতে পারে নিজের অস্তিত্বের কথা’। অথচ আজকের লাতিন আমেরিকাকে আমরা যেভাবে জানি তার পেছনে রয়েছে রুক্ষ্ম ইতিহাস। একটি দেশ বিনির্মাণে একজন লেখক কিভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হন এ প্রবন্ধটি তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
‘সার্ত্রে, মোদিয়ানো এবং অন্যান্য প্রবন্ধে’ প্রাবন্ধিক জানান, পুরস্কারের মাধ্যমে পাশ্চাত্যের লেখকদের নিস্ক্রিয় করে দেওয়া হবে এমন শঙ্কায় পুরস্কার গ্রহণ করেননি সার্ত্রে। স্বদেশের অগ্রগতি যেনো কোনোভাবেই স্তব্ধ হয়ে না যায়- তাই অনেক গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার গ্রহণ থেকে পুরো জীবদ্দশায় নিজেকে বিরত রেখেছেন। তাই তো সার্ত্রের মৃত্যুর পর ফরাসি প্রেসিডেন্ট জিসকা নিজেকে পাঠক দাবি করে শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর মৃত্যু একালের মহত্তম নক্ষত্রের পতন বলে বিবৃতি দেন। অন্যদিকে একই দেশের হয়েও মোদিয়ানো এর বিপরীত। দু’জনের মধ্যে চিন্তাগত আকাশ-পাতাল তফাৎ। এজন্যে লেখক বলেছেন, ‘এক প্রতিভার সাথে অন্য প্রতিভার তুলনা করা হয়তো ঠিক না। প্রত্যেকে তাঁর নিজের মতো। কেউ নোবেল পুরস্কার পেয়ে ধন্য হন; কেউ পুরস্কারকে ধন্য করেন। এটাই পার্থক্য। সার্ত্রের মতো প্রতিভার জন্ম বছর বছর হয় না।’ খুব সাবলীল ভাষায়ই লেখক এ প্রবন্ধে বিশ্লেষণী ও অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে প্রবন্ধটি সম্পূর্ণ করেছেন।
সময়ের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় নিয়ে ‘ভার্চুয়াল বন্ধুত্ব বিচ্ছিন্নতার নেটওয়ার্ক’ প্রবন্ধটি একেবারে সময়োপযোগী। লেখায় সাবলীলভাবে ফুটে উঠেছে ভার্চুয়াল জগতের প্রভাব। কিভাবে দিন দিন রক্তে মাংসে গড়া মানুষ যন্ত্রে রূপ নিচ্ছে তা খুব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন লেখক। আমাদের জীবনাচরণ প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে। একজন বন্ধুর কাছে অবস্থান করে অথবা পাশে বসেই ভিনদেশি কিংবা দূরের কোনো বন্ধুর সাথে আমরা আড্ডায় মেতে উঠছি। অথচ পাশেই বসা দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ট বন্ধু। এভাবে ভার্চুয়াল বন্ধুত্ব খাঁটি বন্ধুত্বে ফাটল ধরিয়েছে। এ বিষয়ে বলতে গিয়ে লেখক প্রশ্ন ছুঁড়েছেন : ‘আসলেই একি বন্ধুত্ব নাকি বিচ্ছিন্নতা’। গত কয়েক বছরে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভার্চুয়াল বন্ধুত্বের তালিকা যত দীর্ঘ হয়েছে ততই শিথিল হয়েছে মানবিক বন্ধুতেরও আত্মিক সম্পর্কগুলো।
Advertisement
সোশ্যাল মিডিয়া কোনো কোনো ইস্যুতে জনমত গঠনে সক্ষম হলেও তা ওই বিচ্ছিন্ন জনমতই আসলে। সব স্বাভাবিকতাকে গুড়িয়ে দিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া। ভাবের দিক থেকে প্রায় কাছাকাছি ‘বিজ্ঞাপন, টেলিভিশন আর নিরন্তর ছুটে চলা’ প্রবন্ধটিও। এখানেও মানুষের সম্পর্ক নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। বিশেষ পছন্দের অনুষ্ঠানের সময় বাড়িতে অতিথি এলে বিরক্তি বাড়ে। আমাদের সময়ে-অসময়ে অতিথি আসার হারও কমেছে। কেউই নিজের প্রিয় অনুষ্ঠান ছেড়ে আত্মীয়-বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে যেতে আগ্রহী নয়। এভাবেই বাড়ানো হচ্ছে বিচ্ছিন্নতা। কৃত্রিম দৌড়ের কাছে হার মানছে মানবিকতা। লেখকের এ কথাগুলোতে মানুষে মানুষে প্রকৃত অর্থে যে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে তার সুস্পষ্ট ধরণা পাওয়া যায়। আলোচ্য গ্রন্থের একটি অনবদ্য রচনা ‘শ্লীলতার সীমা’ প্রবন্ধটি। এ রচনায় মানব-মানবীর খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিশ্লেষণ করা হয়েছে। লেখক বলেছন, ‘নিষিদ্ধ’ শব্দটিতেই রয়েছে মাদকতা। নিষেধের বেড়াজাল যত বেশি কঠোর উন্মোচনের আকাঙ্ক্ষা ততই প্রবল। নিষিদ্ধের শক্ত মোড়ক সবচেয়ে বেশি মানুষের সেক্সুয়াল লাইফ নিয়ে। এতো বেশি রহস্যের জাল বোনা হয়েছে যে, এর প্রতি নিষিদ্ধ কৌতূহল শিশু বয়স থেকে বুড়ো বয়স পর্যন্ত আবর্তিত হয়। এ প্রবন্ধে নিষিদ্ধ বিষয় নিয়ে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি তুলে ধরেছেন লেখক। অর্থাৎ নিষিদ্ধ বা আড়ালো থাকা যেকোনো বিষয়ের দিকে মানুষের তীক্ষ্ম দৃষ্টিপাত হয়। এ প্রবন্ধ থেকে নৈতিক শিক্ষার বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে।
বইটির নাম প্রবন্ধ নিয়ে দু’কথা বলতে চাই। ‘আতঙ্কের পৃথিবীতে এক চক্কর’ প্রবন্ধে মানুষের স্বদেশি স্বার্থ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। তাই লেখক বলেছেন, একশ’ বছর পৃথিবীর পরিবর্তন হয়েছে অনেক। কিন্তু দখল-আধিপত্যের পুরনো খেলা অব্যাহতই রয়েছে। শুধু এর রূপ পরিবর্তন হয়েছে। ১৯১৪ সালের পর ক্ষমতাধর দেশগুলোর মধ্যে আবার নানা প্রতিযোগিতা, দ্বন্দ্ব, তিরিশের দশকের মহামন্দা ও ফ্যাসিবাদের উত্থান আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ অনির্বায করে। অবশ্য আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনার কথা সময়ই বলে দেবে। বইটির প্রতিটি বিষয়ই গুরুত্বপূর্ণ। জানার পরিধিও সমৃদ্ধ হবে বলে বিশ্বাস করি।
বইটি প্রকাশিত হয়েছে ২০১৮ সালের বইমেলায়। প্রকাশ করেছে শ্রাবণ প্রকাশনী। প্রচ্ছদ করেছেন কামরুল আহসান। বইটির শুভেচ্ছা মূল্য ধরা হয়েছে তিনশ’ টাকা।
এসইউ/পিআর
Advertisement