সময়টা ১৯৮৪ সাল। ওই বছর লিপ ইয়ার ছিল। সঙ্গত কারণেই সে বছরের ফেব্রুয়ারি মাস ২৯ দিনে ছিল। ওইদিনেই স্বৈরশাসকের ছুরিকাঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র, বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলনের অগ্রদূত তাজুল ইসলাম। ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১ মার্চ নিহত হন তিনি। ১ মার্চকেই ‘তাজুল দিবস’ হিসেবে পালন করেন তার সহযোদ্ধাবৃন্দ।
Advertisement
জলপাই রঙের পোশাক আর কালো বুটের পদপৃষ্টে বাংলাদেশ। কালের চাকাকে উল্টে দিয়ে বিশ্বাসঘাতক মোশতাক চক্র জেনারেল জিয়ার সহায়তায় ক্ষমতা দখল করে। পৌনঃপুনিক সামরিক শাসনের জাঁতাকলে আটকে যায় বাংলাদেশ। বিপন্ন হয় আমাদের স্বাধীনতার চেতনা, মানবিকতা, অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রতিবাদ হয়েছে, কিন্তু তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারিনি। সামরিক শাসনের ধারাবাহিকতায় নানাবিধ ষড়যন্ত্র, হত্যা, ক্যুর মাধ্যমে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে ক্ষমতা দখল করে সামরিক শাসন জারি করেন ও নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ঘোষণা করেন ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ। সেই দিন থেকেই প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।
বাঙালি, বাংলাদেশ সামরিক শাসন মানে না। ১৯৮৩'র মধ্য-ফেব্রুয়ারিতে অপ্রতিরোধ্য ছাত্র আন্দোলনে শহীদ হন দীপালি সাহা, মোজাম্মেল, কাঞ্চন, আইয়ুবসহ অসংখ্য সাথী। পিচঢালা রাজপথ রক্তে রঞ্জিত হয় সামরিক জান্তার বুলেট ও বেয়নেটে।
Advertisement
এরশাদ ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের নামে উপজেলা পরিষদের কাঠামো তৈরি করে নির্বাচনের ঘোষণা দেন। ততদিনে দেশের রাজনীতির হাল ধরেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ১৫ দলীয় রাজনৈতিক জোট, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (স্কপ) ও অন্যান্য পেশাজীবী ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠে।
উপজেলা নির্বাচন প্রতিহত করার লক্ষ্যে ১৫ দলীয় রাজনৈতিক জোট হরতালের কর্মসূচি ঘোষণা করে। হরতাল সফল করার নিমিত্তে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ রাজপথে বিক্ষোভ মিছিল কর্মসূচি গ্রহণ করে। স্কপ শিল্প-কলকারখানায় ৪৮ ঘণ্টার ধর্মঘট আহ্বান করে।
স্কপের ধর্মঘটের সমর্থনে দেশের কল-কারখানা, শিল্পাঞ্চলে প্রস্তুতি চলছিল। দেশের সর্ববৃহৎ পাটকল 'আদমজী'তে ধর্মঘট প্রস্তুতির মিছিলে হামলা চালিয়ে খুনি এরশাদের মদদপুষ্ট ছায়াদুল্লাহ সাদুর গুণ্ডাবাহিনী ছুরিকাহত করে শ্রমিক নেতা বীর কমরেড তাজুল ইসলামকে। ঢামেক হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে ১ মার্চ হরতাল চলাকালে কমরেড তাজুল ইসলাম শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে তাজুল ন্যাপ-ছাত্র উইনিয়ন- কমিউনিস্ট পার্টির যৌথ গেরিলা বাহিনীতে যোগদান করেন। যুদ্ধ শেষে নয় মাস পর দেশে ফিরে আসেন। শ্রদ্ধেয় মুস্তারী শফীর বই ‘স্বাধীনতা আমার রক্ত ঝরা দিনগুলোতে’ পড়েছি আগরতলায় ক্রাফটস হোস্টেলে কিভাবে উনার ছেলে মেয়েদের প্রিয় মামা হয়ে উঠেছিলেন তাজুল। যুদ্ধ শেষে মতলবে ছাত্র ইউনিয়নকে দাঁড় করাতে উঠে পড়ে লেগে গেলে তাজুল।
Advertisement
শ্রমিক নেতা তাজুলের কঠিন শৈশব ও কৈশোরের যুদ্ধজীবনের কথা জানিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে লেখাপড়া করা, ছাত্র ইউনিয়নের অগ্রসর কেন্দ্রীয় নেতা তাজুল এশিয়ার বৃহত্তমে পাটকলে শ্রমিকের কাজ নিয়েছিলেন শ্রমিক আন্দোলনের স্বার্থে। বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তোলতে হবে এতে পথে যত বাধা বিপত্তিই থাক, তাজুল তার জীবন দিয়ে একটি কথাই বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন।
তাজুলের শৈশবকে হত্যা করেছে আমাদের বৈষম্যপীড়িত সমাজ। কঠিন শ্রমের একপ্রকার দাস জীবন ছিল তার। তৃণমূলের নিপীড়িত সেই তাজুল ১৯৮৪ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি গগনে উদ্ভাসিত হলে। কঠিন প্রতিকূল অবস্থায় তাজুলের স্ত্রী নাসিমা ইসলাম, তাজুলের দুটি সন্তান জীবন-সংসারে নিয়ত যুদ্ধমান। তাজুলের হত্যাকারীর বিচার হয়নি। তাজুলের হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত তদন্তও করেনি।
সাধারণ নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষাজীবন শেষ করে তাজুল ইসলাম যোগ দিয়েছিলেন আদমজীর শ্রমিক হিসেবে। হতে পারতেন এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষক, বিরাট অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার- অনেক কিছুই। মানুষের জন্য, বাংলাদেশের জন্য এই ব্যক্তিগত ত্যাগের আর ক'টা উদাহরণ আছে? শহীদ কমরেড তাজুল ইসলাম, বীরের মৃত্যু হয় না।
লেখক: স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের নেতা, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা।
এইচআর/পিআর