মতামত

মশায় কামান ফেল বিমান বাতিল

পোকা সোসাইটিতে অধম-ছোট সদস্য হলেও মশা এখন দাপটে পরাক্রমশালী। গ্রাম থেকে শহর এমনকি তিলোত্তমা রাজধানী ঢাকায়ও এদের আধিপত্য। এক সময় বলা হতো, রাতে মশা দিনে মাছি এই নিয়ে বেঁচে আছি। এখন শুধু রাতে নয়, প্রকাশ্য দিবালোকেও। থাপ্পড়ে কাবু হচ্ছে না আক্রমণকারী মশারা। মানুষের ক্ষোভ-বিক্ষোভেও তাদের কিছু যায় আসে না। মশার উৎপাতে অতিষ্ঠ রাজধানীবাসী। কোনো এলাকায় দিনের বেলায়ও মশারি টাঙিয়ে নিস্তার মিলছে না। আবার তীব্র-ঝাঁঝালো কয়েলেও কেয়ার করছে না আদব-লেহাজহীন মশা।

Advertisement

আর সিটি কর্পোরেশনের ক্রাশ প্রোগ্রামের সঙ্গে বেত্তমিজি তো করেই। মশা মারতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের বাজেট বরাদ্দ বাড়ছে বছর বছর। মশক নিবারণী দফতরে জনবলও একেবারে কম নয়। যন্ত্রপাতি, কীটনাশকসহ টেন্ডার ডাকার খবরও পাওয়া যাচ্ছে মাঝেমধ্যে। এই অর্থবছরে মশা নিধনে ডিএসসিসির বাজেট বরাদ্দ হয়েছে ২৫ কোটি আর ডিএনসিসিতে ২০ কোটি। এ বাজেট ও কীটনাশক কোথায় যায় এ প্রশ্ন এখন বাসি হয়ে গেছে।

মশক নিবারণী দফতরে অভিজ্ঞ কর্মী তিন শতের মতো। ঢাকা উত্তর এবং সিটি করপোরেশনে মশক নিধন কর্মীও অন্তত ছয় শত। দুই কর্পোরেশন আরো জনবল চাচ্ছে। বলা হচ্ছে- ঢাকার জনসংখ্যা ও এলাকা অনুপাতে এই জনবল নেহায়েত কম। তারা কুলাতে পারছেন না মশার নঙ্গে। নগরবাসী তাদের দেখা-সাক্ষাৎ না পেয়ে কোথাও কোথাও বেসরকারি বিভিন্ন মশক নিধন প্রতিষ্ঠানের সেবার দিকে ঝুঁকছে। ব্যক্তিগত ঘর-বাড়ি ছাড়াও কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এই সেবায় নেমেছে। ব্যবসা হিসেবে মন্দ না।

মশা মারতে কামান দাগানোর প্রবাদ নিয়ে যারা এক সময় তাচ্ছিল্য করতেন এখন? কামানও ফেল। সিটি কর্পোরেশনের ফগাড় কামানকে ব্যর্থ করে দিয়ে বীরত্বের জানান দিচ্ছে মশারা। তারা বাসা-বাড়িতে পার্টটাইম কামড়ায়। ঢু মারে অফিস, আদালত, হাসপাতালেও। মসজিদ-মন্দিরেও কামড়ায়। ডিস্টার্ব করছে এফডিসিতে সিনেমা-নাটকের কাজকর্মের সময়। মহাশয়ের আসনে বসে মশারা বাস-ট্রেন শেষে এখন প্লেন জার্নিও করে। মশার জার্নি বাই প্লেন এবং প্লেনের সিডিউল বরবাদের খবরও এরইমধ্যে আলোচনার বিষয়। গত ২২ ফেব্রুয়ারি রাতে মশার ডিস্টার্বে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসের ফ্লাইট ছাড়তে দুই ঘণ্টা দেরি হয়। মশার উৎপাতে যাত্রীরা বসে থাকতে না পারায় ওই উড়োজাহাজ রানওয়ের দিকে এগিয়ে ফিরে আসে।

Advertisement

শাহজালার ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের বোর্ডিং ব্রিজ, অ্যাপ্রোন এরিয়া ও সংলগ্ন এলাকায় মশার উপদ্রব অনেকদিনেরই। এয়ারক্রাফটের দরজা খুলতেই ঝাঁকে ঝাঁকে তারা ঢুকে পড়ে। পাখা থাকায় মশাও বৈমানিক শক্তির অধিকারী। এরপর আবার তারা বিনা টিকিটে বিমানে ওঠে। এগুলোকে তাড়াতে লেগে যায় পাক্কা দুই ঘণ্টা। ফলে বিমান ছাড়তে দুই ঘণ্টা বিলম্ব।

এ মশাদের পরাস্ত করার বিষয়ে সিটি কর্পোরেশন, বিমানবন্দরসহ কয়েকটি কর্তৃপক্ষ জরুরি বৈঠক করেছে। এয়ারপোর্টের মশা নিয়ে দেশের সবচেয়ে বড় রফতানি শিল্প গার্মেন্টস মালিকের সংগঠন উদ্বেগ জানিয়েছে অনেক আগেই। তাদের প্রশ্ন ছিল- যে দেশের এয়ারপোর্টে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মশার কামড় খেতে হয়, সে দেশে বিনিয়োগ করতে আসবে কে? তারা প্রশ্নের জবাব পাননি। এছাড়া তাদের ওই বক্তব্য সরকারিমহলকে তেমন নাড়া দিতে পারেনি। নিউজভ্যালু পায়নি গণমাধ্যমেও।

বাস্তবে মশা কালক্রমে আমাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। কোনো দেশের এয়ারপোর্টে ঢোকামাত্র কারো স্বাগত জানানো ঐতিহ্যের রেশের মতোই। কামড়ে-চুম্বনে মশাকুল সেই কাজটিই তো করছে। বাণিজ্যের জগতেও মশাদের অবদান রয়েছে। তাদের টার্গেট করে ঘুরছে অর্থনীতির চাকা। মশা হত্যার কয়েল, স্প্রে কিংবা মেশিনকে ঘিরে গড়ে উঠেছে কত ধরনের শিল্প।

এই শিল্পের পণ্যের প্রচারে যুক্ত হয়েছে কত অ্যাড ফার্ম। তাতে যুক্ত মডেল। বিজ্ঞাপণ ব্যবসা। পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশন ও ফেসবুকে গত কদিন মশা হট আইটেম। ছোট সাইজের পোকাটি জাতিকে আলোড়িত করছে। এর আগে অবশ্য জাতীয় সংসদ ভবনেও কামড়াকামড়িতে তারা আলোচনায় এসেছে। মশা নিয়ে সংসদে সরস আলোচনা হয়েছে। এবার বিমানের সিডিউলে বিপর্যয়ের মাধ্যমে একটু বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। যুগ যুগ ধরে ক্ষুদ্রাকারেই মশা তার শক্তিতে মানবজাতিকে তাড়িত করেছে।

Advertisement

নমরুদের তথাকথিত খোদায়িত্ব ধ্বংসের ইতিহাসও মশারই গড়া। তা-ও এক ল্যাংড়া মশা সেই ইতিহাসের নায়ক। খোদাদ্রোহী, অত্যাচারী নমরুদ-ফেরাউনের খোদাদ্রোহিতার কাহিনীগুলোর মধ্যে হযরত ইবরাহিম (আ.) এর সাথে নমরুদের নকল খোদা সাজার কথা বেশ প্রচলিত। অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করে হযরত ইবরাহিম (আ.)-কে হত্যার আয়োজনকে ব্যর্থ করে আল্লাহ অগ্নিকুণ্ডকে ফুলবাগানে পরিণত করেন। ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত ইতিহাসে বলা হয়েছে, সে যুগের মহাপ্রতাপশালী বাদশাহ নমরুদ প্রতাপে এক সময় নিজেকে খোদা দাবি করেন। মিথ্যা খোদায়িত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আসল খোদার সাথে আকাশে ওঠার উন্মাদনা পায় তাকে। তৈরি করে তাবুত নামের আকাশযান বা বিমান। অতি ক্ষুদ্র ল্যাংড়া মশা চুরমার করে দেয় সেই বিমানসহ নমরুদকে।

এই ডিজিটাল যুগে কাকে টার্গেট করে মাঠে নেমেছে মশারা? কী এদের মতলব? নমরুদের কাহিনী বাদ দিলেও মশাদের দুর্বল ভাবার দিন নেই। হেলাফেলার কোনো অবকাশ নেই। আকারে ক্ষুদ হলেও অ্যাকশনে তারা বিশাল। দুর্দমনীয়। বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার যেন তারা মানুষের চেয়েও বেশি আয়ত্ব করেছে। তাদের সামর্থবান করে বাঁচিয়ে রাখায় অবদানও রয়েছে অনেকের। সেই তুলনায় মারার প্রচেষ্টা দুর্বল। পারলে এখন চাষাবাদের কথা ভাবা যায়। এদের বাঁচিয়ে রাখলে অর্থনীতি-রাজনীতিতে লাভ প্রচুর।

হাজারো ইস্যুর সঙ্গে মশাও টিকে থাকলে রাজনীতির খোরাক হতে পারবে। এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে কথামালার বাজার তৈরি হবে। মশকদমনের ওয়াদায় নির্বাচনে জেতার সুযোগটা বন্ধ হবে না। কেউ হারলেই বা কী? পরাজয় সব সময় ক্ষতিকর নয়। মশকদমনে ব্যর্থতার অভিযোগ এনে বিজয়ীকে ঘায়েল করা যাবে। আবার সরকার ও বিরোধীপক্ষের মধ্যে চলমান তিক্ততা ভুলে মশা ইস্যুতে ঐকমত্যও আসতে পারে। এতে গণতন্ত্রের সৌন্দর্য্য বাড়বে। এসব বিবেচনায় মশা রাজনৈতিকভাবে উপকারী কীট।

মশার অর্থনৈতিক ভ্যালু আগেই বলা হয়েছে। মশার প্রবেশ নিষিদ্ধ করে বাতাস সচল রাখতে অ্যান্টি মসকুইটো নেট আবিস্কার হয়েছে অনেক আগেই। ব্যবসাটা বেশ জমজমাট। সেটার আপডেট এসেছে হলুদ বিজলি বাতি। এখন হুট করে মশাগুলো মেরে ফেললে কী অবস্থা হবে? মশক দমনের নামে ব্যয়-বরাদ্দ বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে ভাগে-জোগে অনেকের পকেটেই কিছু যাবে। মোটকথা মশাকেন্দ্রীক অর্থনীতি চাঙ্গা থাকবে। কয়েল, অভিজাত সুগন্ধী স্প্রের ব্যবসা বা মশারীর কারখানাগুলোর সাফল্য অব্যাহত না থাকলে অনেক কিছু বরবাদ হবে।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, সিটি কর্পোরেশনসহ বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের মশক নিধন প্রকল্পের টাকা বরাদ্দ না থাকলে জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে বিশাল ধাক্কা পড়তে পারে। ঠিকাদাররা কর্মহীনতায় একপর্যায়ে শোকে-দুঃখে ধর্মহীনও হয়ে পড়েন কি-না কে জানে! মশামারি কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আয়-রোজগারে গোলমাল ভিন্ন সমস্যা তৈরি করতে পারে। মশা মারার উছিলায় তারা নানান জায়গায় চড় মারা শুরু করলে তা মশার কামড়ের যন্ত্রণার চেয়ে আরো বেশি হবে।

পেশাদার চোরদেরও সমস্যা হবে মশা না থাকলে। মশার যন্ত্রণায় মানুষ যেভাবে দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘুমাচ্ছে তা চলতে থাকলে চোর কমিউনিটিও খরায় পড়ে যাবে। ক্ষমতাধর মশা সম্প্রদায় তা বুঝেশুনেই এগুচ্ছে জনকল্যাণমূলক চেতনায়। কোনো বদদোয়া, অভিশাপ বা মারণাস্ত্রে ভীত-কাপুরুষ না হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ঈমানের সঙ্গে সাহসে-আত্মবিশ্বাসে। লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

এইচঅার/আরআইপি