মতামত

বাংলা আর বাংলাদেশ নিয়ে উজানে বাওয়া তরী

ফেব্রুয়ারি এলে বাংলাদেশটা জেগে উঠে। আবেগে-উল্লাসে তারুণ্য প্রাণ পায় যেন বইয়ের মেলায়। হাজার হাজার বই, হাজারো লেখক। তাদের পাঠক কত হাজার। কবিরাই যেন কবিদের পাঠক। লেখকরা যেন লেখকদের পাঠক। বই পাঠের আগ্রহটা কি বাড়ছে ? সভায়-শ্লোগানে বার বার উচ্চারিত হয় চেতনার কথা। স্বাধীনতা আর মুক্তিযুদ্ধ শব্দগুলো বাংলাদেশের সাথেই সম্পর্কিত, এই শব্দগুলো সকলের। বাংলাদেশের যে দল ক্ষমতায় আসে, সে দলে দিনের পর দিন কর্মীর সংখ্যা বাড়তে থাকে, এই শব্দগুলো যেন এখন তাদের হাতিয়ার।

Advertisement

বিচ্ছিন্ন ঘটনা হলেও শোনতে কি ভাল লাগে যখন কোন তরুণী একুশের মিছিলে এসে বলে, মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে ফুল দিতে এসেছে তারা। তারা এই শব্দগুলো জানে, কপচায়, কেন-ই-বা উচ্চারণ করে বার বার এই শব্দগুলো, যেহেতু হৃদয়ে ধারণ করে না। চারদিকে বাড়ছে মানুষ, বাড়ছে ছাত্র-ছাত্রী। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাটা দিন দিন বৃদ্ধিই পাচ্ছে। কিন্তু সে অনুযায়ী বাড়ে না গ্রন্থাগারের সংখ্যা।

প্রযুক্তি হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে অনেক কিছুই, কিন্তু কেন জানি ইতিহাস আশ্রয়ী হয়ে উঠছে না কাঙ্খিত তারুণ্য। তবুও মেলা জমে উঠে বসন্তের রঙে। সেলফিবাজি রঙ ছড়ায় চারদিকে। এই রঙ আর জৌলুস আমাদের আনন্দ দেয়। কেন জানি মনে হয় একুশেটা কর্পোরেট হয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন? বিশ্বায়নের কাছে যেন হেরে যাচ্ছে একুশের চেতনা।

কিন্তু তারপরও আমরা যখন দেখি প্রভাত ফেরিতে মানুষের হাঁটা, চেতনায় একুশ ধারণ করে গানে গানে সকালে সূর্য গায়ে মাখে মানুষ, তখন মনে হয় যুগে যুগে এই প্রজন্মইতো নব্বই এনেছিলো, এরাই শাহবাগে জেগে উঠেছিলো। এরাই লক্ষ প্রাণে বান ডাকায়। এই বান ডাকানো প্রজন্মই পৃথিবীর দেশে দেশে ছড়িয়ে আছে। লাখো-কোটি মানুষেরাও এই প্রাণের উচ্ছ্বাসের সাথে পৃথিবীর দেশে দেশে যেন জেগে উঠে। লন্ডন থেকে নিউউয়র্ক, কানাডা থেকে দুবাই- শহিদ বেদীতে ফুল দেয় মানুষ।

Advertisement

দুই.বাংলাদেশের বাইরে একুশের প্রথম স্থায়ী শহিদ মিনার নির্মিত হয়েছে ব্রিটেনের ওল্ডহ্যাম শহরে। প্রায় দুই দশক আগে। নর্থওয়েস্ট ইংল্যান্ডের বাসিন্দা হিসেবে এই শহিদ মিনারেই ফুল দিয়েছি বছরের পর বছর। একটা আবেগ আর উচ্ছ্বাস কাজ করতো আমার মতো অনেকেরই। একুশের প্রতিটি প্রথম প্রহরই আমাদের দিয়ে যেতো নতুন আশাবাদ। মনে করতাম এবারের বিশৃঙ্খলাটাই সম্ভবত শেষ, আগামীর পথচলা হবে মসৃণ। কিন্তু মসৃণ হয় না।

প্রতি বছরের দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষে এক সময় অনেকের সাথে আমিও জায়গা পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেই, অন্য কোথাও হবে আমাদের অর্ঘ নিবেদনের মিনার। সে হিসেবেই নির্ধারিত হয় স্থান। গত চার-পাঁচ বছর থেকে একুশের প্রথম প্রহরে গ্রেটার ম্যানচেস্টার বাংলাদেশ এসোসিয়েশনে নির্মিত একটা অস্থায়ীভাবে নির্মিত শহিদ মিনারে ফুল দিচ্ছে নর্থ ওয়েন্ট ইংল্যান্ডের বাঙালি অভিবাসীদের একটা অংশ। ঠিক একইভাবে মাত্র কয়েক মাইলের মধ্যে আরও একটা অস্থায়ী মিনার তৈরি করছে হাইড বাংলাদেশ ওয়েলফেয়ার নামের একটা সেস্বচ্ছাসেবী সংস্থাও। কিন্তু কোথাও যেন স্বস্তি নেই।

আওয়ামী লীগ বিএনপি এবং তাদের অন্তর্দ্বন্দ্ব এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, তাদের চুলোচুলিতে শেষ পেরেকটুকু মেরে দিতে চায় জামায়াতিরা ২০১৩ সালে। এরা দখল করে নেয় ওল্ডহ্যাম শহিদ মিনার, জুতা দিয়ে মাড়ায়, শেখ হাসিনার পতন চায়, চায় মৃত্যু। অথচ সেসময়ও উপস্থিত ছিলো আওয়ামী লীগের ভিন্ন গ্রুপ, হা করে তাকিয়ে থেকেছে তারা। যদিও জামায়াতিরা তাদের সেই জয়যাত্রা (!) শেষে আর মাড়ায়নি ওল্ডহ্যামের শহিদ মিনার। এবারে বিএনপি’র স্থানীয় একটা গ্রুপ চাইছিলো এবার তারা প্রথমে ফুল দেবে, আওয়ামী লীগকে দিতে দেবে না।

বাদানুবাদে পন্ড করে দেবে পুস্পার্ঘ্য অর্পণের চেতনার প্রথম প্রহর। কিন্তু ওল্ডহ্যামের স্থানীয় বিএনপি’র এক প্রভাবশালী নেতার হস্তক্ষেপে সে কাজটি শেষপর্যন্ত হয় নি। বিএনপি না করলেও বিশৃঙ্খলাটা থেমে থাকে নি। এবারও ওল্ডহ্যামের শহিদ মিনার কলংকিত হলো। এবারে একটু ভিন্ন ছিলো। আওয়ামী লীগের দুটো গ্রুপ মিনারের বেদীমূলে ফুল দেয়া নিয়ে প্রথমে বাকবিতন্ডায় ছড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে তা রুপ নেয় সংঘর্ষে। যা হবার তা-ই হয়েছে। পুলিশ এসেছে। দুপক্ষকে সরিয়ে দিয়েছে। এবং শংকার বিষয় হলো এবার তারা জানিয়ে দিয়েছে আগামীতে এ মিনারে হয়ত তারা স্থানীয় প্রশাসনের সাথে মিলে এখানে এ আয়োজন করতে দেবে না।

Advertisement

অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে এ শহিদ মিনারটি ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছিলো বিশ বছর আগে। ইতিহাসের পথ পরিক্রমায় বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায় ভাবগাম্ভীর্য থাকলেও ওল্ডহ্যাম কিংবা বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় এ নিয়ে প্রতিবছর উচ্চারিত হয় অনেক কথা, হয় আলোচনা-সমালোচনা। ওল্ডহ্যাম শহিদ মিনার নির্মানে স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা ছিলো, ছিলো আওয়ামী লীগ-যুবলীগের স্থানীয় নেতাদের উদ্যোগ, অথচ আজকের এ সময়ে ওল্ডহ্যামের শহিদ মিনার সেই চেতনার মানুষগুলোর কারনেই উপেক্ষার শিকার কিংবা বলতে গেলে অবমাননা করছে ঐ তারাই।

নিছক ক্ষমতার পরিধি বিস্তৃত করতে আওয়ামী লীগ বিএনপি’র ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপ কাজ করে এই ব্রিটেনে। যুক্তরাজ্যের কেন্দ্রীয় অর্থাৎ লন্ডন কেন্দ্রিক মূল পার্টি প্রত্যেকটা শহরেই ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপকে কাজ চালাতেও উৎসাহিত করে। সেজন্যে বিভক্তির শেষ হয় না। প্রকারান্তরে বিভক্তিটা তারাই জিইয়ে রাখে। যার ফলশ্রুতিতে আমরা দেখি ওল্ডহ্যাম শহিদ মিনারের এই অসঙ্গতি কিংবা নিজ দলের মাঝে সংঘর্ষ। বিলেতের এই প্রভাব বিস্তারের রাজনীতির কারণে গোটা কমিউনিটি সম্পর্কে একটা নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হচ্ছে।

ভিন্ন বর্ণ কিংবা গোত্রের ভিন্নভাষী মানুষের সামনে বাংলাদেশী কমিউনিটি নিজেদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করছে, বাংলাদেশের রাজনীতির এই নোংরামির কারণেই। অথচ এসব থেকে মুক্তি পাওয়া খুব একটা কঠিন ব্যাপার নয়। শুধুমাত্র লন্ডনের কেন্দ্রীয় কমিটি স্বাভাবিকভাবে কাজ করলে এই নেতিবাচক ইমেজ থেকে বেরিয়ে আসতে পারতো বাংলাদেশী কমিউনিটি। এই গ্রুপিং এবং প্রভাব বিস্তারের প্রয়োজনে এবারে আওয়ামী লীগ যে কান্ডটি ঘটালো, শোনতে ভালো না লাগলেও এটাই সঠিক যে, পাঁচ বছর আগে যে কাজটা করেছিলো প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠি, তারই যেন পুনরাবৃত্তি ঘটালো তারা নিজেরাই একই কায়দায়।

তিন.এবারে একটা অত্যন্ত ইতিবাচক দিক হলো, ব্রিটেনে আওয়ামী লীগ-বিএনপি দ্বন্দ্ব প্রকট থাকলেও লন্ডনের আলতাব আলী পার্কের কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে কোনপ্রকার ক্লেশ-সংঘাত হয় নি পুস্পার্ঘ অর্পণ নিয়ে। আশা জাগানিয়া এই শান্ত পরিবেশে এবারেও শিশু-কিশোরদের একটা অংশকে নিয়ে দুদিন পর প্রভাত ফেরির আয়োজন করেছে স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠন। গত তিন বছর থেকে লন্ডনে এ প্রভাত ফেরি হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ইতিমধ্যে বিভিন্ন দেশও এ দিবসটাকে এখন গুরুত্বের চোখে দেখে। সেজন্যে ব্রিটেনের কোন কোন স্কুলও এতে অংশ নিচ্ছে। ওল্ডহ্যামে এবারই প্রথম একটা প্রাইমারি স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী এ প্রভাত ফেরিতে অংশ নিয়েছে।

ওল্ডহ্যামের বার্নলি ব্র প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক হেলেন আটকিনসন এবং তার আরও দুজন শিক্ষকসহ শিক্ষার্থীদের একটা গ্রুপ নিয়ে প্রভাত ফেরিতে অংশ নেন একুশের প্রভাতে। প্রধান শিক্ষক তাঁর অত্যন্ত ব্যস্ত সময়ের মাঝেও এ দিনটাকে উৎসবমুখর করতে ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে কাজ করেছেন এবং শহিদ বেদীমূলে একুশের তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা করেছেন। ছাত্র-ছাত্রীরাও ছিলো আবেগপ্রবণ। প্রধান শিক্ষক ইতিমধ্যে আগামী বছর বিপুলসংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে এতে অংশ নেবেন বলে জানিয়েছেন।

মাতৃভাষা উদযাপন পরিষদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে তারা আগামী বছর আরও স্কুল এতে সংযুক্ত করবেন। মাঝখান দিয়ে একটা কথা না বললেই নয়, রাজনৈতিক সংগঠনের কর্মীরা এতে সংযুক্ত ছিলেন, কিন্তু কোন রাজনৈতিক সংগঠনের সাংগঠনিক হস্তক্ষেপ না থাকায় এ প্রভাত ফেরি অত্যন্ত সুন্দর এবং দ্বন্দ্ব মুক্ত হয়েছে বলে মনে করছেন নর্থওয়েস্টের সকল সংস্কৃতি কর্মীরা। ‘মাতৃভাষা উদযাপন পরিষদ ওল্ডহ্যাম’ আগামীতেও যদি সাংগঠনিক রাজনীতির বলয় থেকে এবারের মতোই দূরে থাকতে পারে, তাহলে তা আরও ব্যাপক উৎসবমুখর হয়ে উঠতে পারবে এ প্রাণবন্ত আয়োজন,এ বিশ্বাস আমরা রাখি।

চার.

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই বাংলা পড়ানো হয় না, সেখানে ব্রিটেনে বাংলাকে পাঠ্য হিসেবে শিক্ষার্থীদের কাছে নিয়ে যাওয়া রীতিমত সংগ্রামের। বন্ধুর এ পথ, তবুও বাংলা ভাষাকে প্রাতিষ্ঠানিক ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রামে আছে মানুষ নিজেদের ঘরে সন্তানদের মাঝে, চেষ্টা চলছে বাংলাকে টিকিয়ে রাখতে বাঙালি অধ্যুষিত এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে।

তবে যে বিষয়টা এখন বিবেচনায় নিতে হবে, আমরা আমাদের সংগ্রাম-ঐতিহ্য-সংস্কৃতির ইতিহাস যদি এখানে বেড়ে ওঠা ব্রিটিশ-বাঙালিদের মাঝে বইয়ে দিতে পারি, তবেই হয়তো বাংলা-বাঙালিত্ব-বাংলাদেশ-একুশেকে আমরা জাগরুক রাখতে পারবো,পৃথিবীর দেশে দেশে, বাঙালিদের মাঝে। অভিবাসী মানুষগুলোর এই প্রচেষ্টাই চলছে- প্রতিকূলতার মাঝেও তারা উজানে বাইছে তরী।

লেখক : লন্ডনপ্রবাসী কলামিস্ট, সাংবাদিক।

এইচআর/পিআর