মতামত

অরলান্ডোর গাউচা

মিগেলের দিকে তাকালে মনে হবে এখনি তাঁর একটা ছবি তুলে ফেলি। মিগেলকে দেখতে কাউবয় ছবির নায়কের মত লাগে। রুক্ষ চেহারা। খোঁচা খোঁচা দাড়ি। কপালে আর মুখে অল্প বয়সেই বুড়ো মানুষের মত অনেক বয়সের ভাঁজ।

Advertisement

মাথায় সব সময়ই থাকে বাহারি কাউবয় হ্যাট। মিলিশিয়াদের মত জামা। চটে যাওয়া জিন্সের প্যান্ট। নিখুঁতভাবে বানানো তাঁর জুতো জোড়া। কাউবয় বুট। ওদের রাজ্যেই বানানো হয় ওগুলো।

মিগেলের জন্ম আর্জেন্টিনাতে। সান লুইস নামের ছোট এক শহরের কাছে। মেন্দজা থেকে বেশ কাছে। বিশাল এক রাজ্যে তাঁর জন্ম। ওখানেই বড় হয়েছে সে। মাইলের পর মাইল কেবল সবুজ। নীল আকাশ। অবারিত নির্মল জীবন। ছোট বেলা থেকে সে শিখেছে কেমন করে বন্য ঘোড়াগুলোকে বাগে আনতে হয়, কিভাবে গবাদি পশুগুলোকে বড় করতে হয়। তাদের রোগ ব্যাধিতে কিভাবে তাদের সাহায্য করতে হয়।

সেই ছোট বেলা থেকে মিগেল শিখে গেছে অন্ধকার রাতে বনের মাঝে বন্ধু গাউচাদের সাথে কিভাবে আকাশের তারা গুনতে হয়। বুনো ‘মাটা’ খেতে খেতে আর তামাক চিবুতে চিবুতে কিভাবে রাতের আঁধারে মিশে যেতে হয়।

Advertisement

গাউচারা হোল আর্জেন্টিনার কাউবয়। ব্রাজিলে ওদেরকে ডাকে 'কাম্পিনু', পেরুতে 'চালান' বা 'মারচুকু', ভেনিজুয়েলা আর বলিভিয়াতে বলে 'লনেয়ু', কিউবাতে 'পানিওলা' । এরা আমাদের সাধারণ মানুষের সামাজিক রীতিনীতিতে বড় হয় না। সামাজিক প্রথা বলে তেমন কিছু এদের জানা নেই।

মিগেল অনেকটা সেভাবে বড় হয়েছে। তবে মিগেল বই পড়তে শিখেছিল ছোট বেলায়। সান লুইসে যেত কেবল বই কিনবার জন্য। সাহিত্যের প্রতি তার অসামান্য আসক্তি। গাউচাদের নারী অনাসক্তি থাকলেও মিগেল ছিল ভিন্ন।

ছোটবেলাতেই মারিয়ার প্রেমে পড়ে যায় সে। মারিয়া তাদের দূরের আত্মীয়। বয়সে খানিকটা বেশি হলেও তাঁর আকর্ষণেই বন বাদাড় ছেড়ে মাঝে মধ্যে রাজ্যে ফিরে আসতো সে।

রাজনৈতিক কারণে তাঁর পরিবার আর্জেন্টিনা ছাড়তে বাধ্য হয়। সান লুইসের এক আমেরিকান পরিব্রাজক তাঁকে ফ্লোরিডার অরলান্ডোর কাছাকাছি এক রাজ্যে আশ্রয় দেন। তা প্রায় চল্লিশ বছর আগের কথা। তখন তাঁর বয়স ছিল পনের।

Advertisement

আস্তে আস্তে ফ্লোরিডার ভ্যাপসা গরম সয়ে গেছে তাঁর। জলাভূমি, কুমির, বুনো পামের সারি, তুমুল বৃষ্টির দিন সব তাঁর সয়ে গেছে। কেবল খোলা আকাশ তাঁর বদলায়নি। বদলায়নি চির চেনা অন্ধকার রাতের তারা। এখানে বন্য ঘোড়া নেই। তবে পোষা ঘোড়ার অভাব নেই। গবাদি পশুর অভাব নেই। রাজ্য থেকে তিরিশ মাইল দূরে অরলান্ডো শহরে আসলেই বড় বড় বইয়ের দোকান মেলে।

তবে কি যেন নেই এখানে তাঁর। গাউচাদের মুক্ত জীবনটা নেই। মারিয়া নেই।

ওর বাবার জীবনের শেষ কটা দিনের ডাক্তার হবার কারণে মিগেলের সাথে আমার একটা সখ্য তৈরি হয়েছে। ও প্রায়ই আমাকে বলে তাঁর রাজ্যে একটা দিন কাটাবার জন্য। আমাকে ঘোড়ায় চড়াবার লোভ দেখায় সব সময়।

আজ ওর রাজ্যে গিয়েছিলাম। পুরো পরিবার খুব মজায় সময় কাটালাম। ঘোড়ায় চাপলাম। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল ওর মতো কাউবয় হয়ে যাই। রাতের আঁধারে বনে বাদাড়ে মিশে যাই। পরিচিত তারাদের সাথে কথা বলি।

ফেরার সময় মিগেল কে ধন্যবাদ জানালাম। মিগেল হেসে বলল, " এ জীবনে আর 'গাউচা' হতে পারবো না। সান লুকাসেও যাওয়া হবে না আর।"

ঘরে ফিরছি। সূর্য ডুবছে। আমার মনে হোল আমার সাথে মিগেলের বেশ মিল আছে। আমি বাংলাদেশে চিত্রা নদির মাঝি হতে চেয়েছিলাম।

লেখক : পরিপাকতন্ত্র ও লিভার বিভাগীয় প্রধান, ফ্লোরিডা হাসপাতাল, ফ্যাকাল্টি, কলেজ অব মেডিসিন, সেন্ট্রাল ফ্লোরিডা ইউনিভার্সিটি।

এইচআর/জেআইএম