খেলাধুলা

ঢাকা লিগ অন্যরকম ভালোবাসার জায়গা : মাশরাফি

সত্যিই অবাক হওয়ার মতো ঘটনা! তার সম বয়সী, এক সময়ের সঙ্গী ক্রিকেটার সেই যুব দল থেকে শুরু করে জাতীয় দলে- এক সাথে খেলা তালহা জুবায়ের আর আফতাব আহমেদ বেশ ক’বছর আগে খেলা ছেড়ে এখন পুরো দস্তুর প্রশিক্ষক।

Advertisement

মাশরাফি এবার যে দলের হয়ে খেলছেন, সেই দলের এবারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কোচ তালহা জুবায়ের আবাহনীর। আর নিয়মিত হেড কোচ সোহেল ইসলামের অবর্তমানে আফতাব এখন মোহামেডানের ভারপ্রাপ্ত প্রশিক্ষক; কিন্তু তাদের বন্ধু মাশরাফি এখনো খেলে যাচ্ছেন!

শুধু খেলার কারণে খেলাই নয়। ঢাকার ক্লাব ক্রিকেট এখনো অনেক উপভোগ করেন মাশরাফি। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ তার ভাললাগা, ভালোবাসা। এখনো নিজেকে উজাড় করে দিয়ে চেষ্টা করেন ভালো কিছু করতে।

পরিসংখ্যান সে সাক্ষিই দিচ্ছে। এবার আবাহনীর হয়ে পাঁচ ম্যাচে ১২ উইকেট শিকার করেছেন মাশরাফি। ঠিক আগের ম্যাচে বিকেএসপির চার নম্বর মাঠে শেখ জামালের বিপক্ষে ২৯ রানে ৫ উইকেট দখল করেছেন। তারও আগে কলাবাগানের বিপক্ষে ৪৯ রানে ৪ উইকেট নেয়ার পাশাপাশি ৬৭ রানের দায়িত্বপূর্ণ ইনিংস খেলে বিপর্যয়ের মধ্যেও দলের ত্রাণকর্তা হয়ে যান নড়াইল এক্সপ্রেস।

Advertisement

তার নেতৃত্বে এর আগে তিন-তিনবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে আবাহনী। তবে এবার আকাশী শিবিরের নেতৃত্বে নেই মাশরাফি। এবারের লিগে আবাহনীর অধিনায়ক নাসির হোসেন। এনামুল হক বিজয়, সাইফ হাসান, নাজমুল হোসেন শান্ত, নাসির, মোসাদ্দেক, মিরাজ, তাসকিন, সানজামুল, সাকলায়েন সজিবের মত পরিক্ষীত পারফরমাররা দলে। তারপরও মাশরাফিই সবচেয়ে বড় নির্ভরতা দলটির। পারফরমার হিসেবে তার রয়েছে কার্যকর অবদান। একমাত্র অপরাজিত দল হিসেবে পাঁচ ম্যাচের সবকটিতে জিতে সবার ওপরে থাকা আবাহনীর অন্যতম চালিকাশক্তিই হলেন মাশরাফি।

কাল চির প্রতিদ্বন্দ্বী মোহামেডানের বিপক্ষে শেরে বাংলায় গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের আগে আজ দুপুরে জাগো নিউজের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে ঢাকা লিগ নিয়ে অনেক কথাই বলেছেন দেশের ওয়ানডে অধিনায়ক। কথা-বার্তায় পরিষ্কার, প্রিমিয়ার লিগ তার অনেক বড় ভালোলাগা ও ভালোবাসার জায়গা। আসুন শোনা যাক জাগো নিউজের সঙ্গে মাশরাফির সে কথোপকোথন-

জাগো নিউজ : বাংলাদেশের ক্রিকেট এখন আর ক্লাব কেন্দ্রিক নয়, অনেকদূর এগিয়েছে। তারপরও প্রিমিয়ার লিগ, মোহামেডান-আবাহনী ম্যাচ ৫০ ওভারের ক্রিকেটে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাব ফেলতে পারে?

মাশরাফি : বাংলাদেশের ক্রিকেটের এ যাবতকালের ইতিহাসের দিকে যদি তাকান, তাহলে দেখবেন ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটের মানে প্রিমিয়ার লিগের অবদান সবচেয়ে বেশি। কারণ, সেই ২০০০ সাল থেকে খেলছি। আমার কাছে এ আসর অনেক বেশি ভাল লাগার। আনন্দের। সেই সঙ্গে উপভোগের। সেটা নানা কারনে। প্রথমতঃ একটা প্রতিযোগিতার বাতাবরণ থাকে। প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ পরিবেশে খেলা হয়। ক্লাবগুলোর পক্ষ থেকে অনেক বেশি ভাল খেলার তাড়া ও তাগিদ থাকে। নিজ দল ছাড়াও প্রায় প্রতিদিন অনেকের সাথে দেখা হয়। কথা হয়। ভাববিনিময় হয়। সেটা অবশ্য অন্য বিষয়। তারপরও আলাদা ও ভাল লাগার জায়গা অবশ্যই।

Advertisement

মোট কথা, আমি বলবো- বাংলাদেশের ক্রিকেটের উত্তরণে সব মিলিয়ে প্রিমিয়ার লিগের অবদান অনেক বেশি। এ আসরের প্রতিদ্বন্দ্বীতা যথেষ্ঠ। আরও একটা কারণে ভাল লাগে, তাহলো এই লিগে স্থানীয় ক্রিকেটাররা অনেক বেশি খেলার সুযোগ পায়। পারফরমেন্স দেখারও সুযোগ অনেক বেশি থাকে।

জাগো নিউজ : জাতীয় লিগ, বিসিএলের সঙ্গে সঙ্গে প্রিমিয়ার লিগের মৌলিক পার্থক্য আছে কি, থাকলে কোথায়? মাশরাফি : পার্থক্য আছে অনেটাই। প্রিমিয়ার লিগে ক্রিকেটারদের ওপর ভাল খেলার বাড়তি চাপ আছে। প্রিমিয়ার লিগে ক্লাব কর্ম-কর্তাদের চাওয়া-পাওয়া বেশি। তারা অনেক বেশি সিরিয়াস থাকেন। তাই ক্রিকেটারদের ভাল খেলার তাগিদও দেন বেশি। প্রায় একই কথা বিপিএলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বিপিএলেও ফ্র্যাঞ্চাইজিদের কাছ থেকে ভাল করার বেশ তাড়া থাকে। আর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তূলনামুলক চাপ কম।

জাগো নিউজ : ঢাকা লিগের ভালো পারফরমাররা জাতীয় দলের হয়ে যত দ্রুত ভালো পারফর্ম করেন। ইতিহাস বলছে জাতীয় লিগ ও বিসিএলে অনেক রান করা ও ৪/৫ উইকেট পাওয়া বোলাররা জাতীয় দলের হয়ে সেভাবে জ্বলে উঠতে পারেন না। কেন?

মাশরাফি : আসলে প্রথম শেণির ক্রিকেট খেলার পর জাতীয় দলের পক্ষে নেমেই রান করা সহজ নয়। ফাস্ট ক্লাসে রান হচ্ছে অনেক; কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়। পরিপক্কতা আসতে সময় দরকার। আগে ক্রিকেটারদের নিয়মিত ও ধারাবাহিকভাবে পারফর্ম করতে হবে। জাতীয় লিগ খেলে খেলে হাত পাকাতে হবে। মাইক হাসির মত নামি ক্রিকেটারের প্রোফাইল দেখেন, প্রথম শ্রেনির ক্রিকেটে ৩০ হাজার রান করে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পারফর্ম করেছেন। আসলে কোন শর্ট-কাট রাস্তা নেই।

প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অন্তত দুই-তিন মৌসুম ধারাবাহিকভাবে ভাল পারফর্ম করতেই হবে। রান করতে হবে। তাতেই অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ হতে থাকে। অভিজ্ঞতার সাথে সাথে যেতে থাকলে পারফরমেন্সের গ্রাফ দুই তিন সিজনে ওপরে ওঠে। মনে রাখতে হবে, ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটের সাথে টেস্ট ক্রিকেটের বিস্তর ফারাক। বিসিএল ও জাতীয় লিগে যেটা একশো, সেটা জাতীয় দলের পক্ষে পঞ্চাশে নেমে আসে।

জাগো নিউজ : মোহামেডান-আবাহনী ম্যাচ আগে খুব আলোড়ন জাগাতো। এখন কি সেভাবে নাড়া দেয়? ভিতরে কতটা দোলা দেয়? মাশরাফি : প্লেয়ার হিসেবে এখনো অবশ্যই ওই জায়গাটা থাকে। থাকাটাই স্বাভাবিক। ক্রিকেটারদের মধ্যে এখনো মোহামেডান-আবাহনীর একটা হাইপ থাকে। তবে সমর্থকদের মধ্যে হয়ত আগের চেয়ে সাড়া কম। আলোড়নও হয় কম। তারও নির্দিষ্ট কারণ আছে। এখন অনেক বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচ হয়। জাতীয় দলের প্রচুর খেলা। দর্শকদের বড় অংশ তা নিয়েই মেতে থাকতে পছন্দ করেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে উৎসাহ-উদ্দীপনা তাই তুলনামুলক বেশি।

যে কারণে ঢাকা লিগ নিয়ে অনুভুতিটাই গেছে কমে। আলোড়ন ও সাড়া অনেকটাই কমে গেছে। তবে খেলোয়াড়দের জায়গা থেকে আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচের আবেদন ফুরিয়ে যায়নি। গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ- সেই কথাটা মাথায় থাকে।

জাগো নিউজ : পারফরমার মাশরাফির স্মৃতিতে আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ কতটা উজ্জ্বল? মাশরাফি : একবার আবাহনীর হয়ে মোহামেডানের বিপক্ষে ৫ উইকেট পেয়েছিলাম সেটা এখনো মনে গেঁথে আছে। মিরপুর মাঠের সেই পারফরমেন্সটাই মনে হয় এখন পর্যন্ত সেরা।

জাগো নিউজ : আর অসুস্থ্ শরীর নিয়ে জয়সুরিয়াকে আউট করার ঘটনা? মাশরাফি : (মৃদু হেসে) হ্যাঁ। সেটাও মোহামেডানের বিপক্ষে। ওইদিনও আমরা ম্যাচ জিতেছিলাম। আমাদের প্রায় সব পেস বোলারের পানি সংক্রমনে টাইফোয়েড হয়েছিল। পেস বোলার ছিল না। আমার শরীর ভাল ছিল না। ওই মৌসুমের প্রায় পুরোটা আমার ব্যাক পেইন (পিঠে ব্যাথা) ছিল। যে কারণে আমি পেস বোলিং করতে পারিনি। শর্ট রানআপেও বল করা সম্ভব হয়নি। তাই বাধ্য হয়ে অফস্পিন বোলিং করেছিলাম। জয়সুরিয়াকে আউটও করেছিলাম।

জাগো নিউজ : ঢাকা লিগকে আরও আকর্ষণীয়, উপভোগ্য ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে আপনার প্রেসক্রিপশন কি? মাশরাফি : আমি আগেও বললাম, ঢাকা লিগ আমার কাছে শুধুই লিগ নয় বা খেলা নয়। মনের আনন্দেরও একটা অনুপম ক্ষেত্র। ছোট বেলা থেকে ঢাকা লিগের উত্তেজনা আর আকর্ষণ দেখে বড় হয়েছি। ঢাকা লিগ সারা বছরের দূর্বলতা। এখন পেশাদার যুগ। ক্রিকেটাররা আরও অনেক আসর দেখছে। খেলছে। তবে আমার মত যারা পুরনো ক্রিকেটার তাদের কাছে ঢাকা লিগ একটা অন্যরকম ভাল লাগার জায়গা।

জাগো নিউজ : কালকের ম্যাচে কে ফেবারিট? মাশরাফি : স্বাভাবিকভাবে আবাহনী ক্লিয়ারলি ফেবারিট। লাইনআপে ৭/৮ জন জাতীয় দলের ক্রিকেটার আছে। একটা দলে বর্তমান জাতীয় দলের এতগুলো ক্রিকেটার থাকা মানেই সেই দল অনেক শক্তিশালী। তাই আবাহনীকে ফেবারিট ধরতেই হবে; কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়। আরও হিসেব নিকেশ আছে। খেলায় তো অনেক কিছুই হয়। এই যেমন আমরা কলাবাগানের সাথে ১০০ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে ফেলেছিলাম।

এ রকম ঘটনা যে কালও ঘটবে না, তার গ্যারান্টি নেই। আসলে খেলায় ভাল কোন কিছুরই নিশ্চয়তা নেই। একটা বাজেদিন আসতেই পারে। তবে ওটা বিবেচনায় তো আর ফেবারিট ধরা হয় না। মোহামেডানেও ভাল প্লেয়ার আছে। সামগ্রিক বিচার বিবেচনায় আবাহনী এগিয়ে আছে। টেবিলেও আবাহনী এগিয়ে আছে। অন্যরকম কনফিডেন্স থাকাটাও খুব স্বাভাবিক।

জাগো নিউজ : মাশরাফির কাছে এ প্রিমিয়ার লিগের আবেদন ও গুরুত্ব কতটা?

মাশরাফি : আমিতো সব ক্রিকেট খেলছি না। কাজেই এই প্রিমিয়ার লিগই আমার ফিট থাকার ও পারফরমেন্স ঠিক রাখার একটা জায়গা। গুরুত্বের সাথে খেলারও ক্ষেত্র। সে আলোকে এটা আমার জন্যও সুযোগ। চেষ্টা করছি নিজেকে চাঙ্গা ও তৈরি রাখার। পারফরমেন্স তো আর বলে কয়ে হয় না। চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, যতটুকু পারা যায় ভাল খেলতে।

জাগো নিউজ : কেমন উইকেটে খেলা হচ্ছে? মাশরাফি : বিকেএসপির উইকেটগুলো ভালো। বাংলাদেশ ছাড়া অন্য দেশগুলোয় যেমন ব্যাটিং উইকেটে খেলা হয়, মানে গড়পড়তা ৩০০ রান ওঠে- বিকেএসপির পিচগুলো মোটামুটি তেমনই। এই ফ্ল্যাট উইকেটে খেলা বোলারদের জন্য অন্যরকম একটা চ্যালেঞ্জ। যেহেতু দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এখন আর সিমিং কন্ডিশন বা স্পিনিং ট্র্যাকে ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি হয় না- তাই এমন ব্যাটিং সহায়ক উইকেটে বোলারদের ওপর চাপ থাকছে। এটা বোলারদের জন্য চ্যালেঞ্জ। আমাদের পরবর্তী বিদেশ সফরগুলোর জন্য উপকারি।

এআরবি/আইএইচএস/আরআইপি