ভারতের মেঘালয় পর্বতের পাদদেশে অবস্থিত নৈস্বর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি হচ্ছে প্রকৃতি কন্যা জাফলং। প্রতিদিনই দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আগত পর্যটকদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠে জাফলং পর্যটন কেন্দ্র। কিন্তু পর্যটন কেন্দ্র জাফলংয়ের পিয়াইন নদীর জিরো পয়েন্ট এলাকায় সাঁতার কাটতে গিয়ে ও নৌকা ডুবে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রসহ এক যুগে মৃত্যু হয়েছে ৩১ পর্যটকের।দুঃখের বিষয় হচ্ছে পর্যটন কেন্দ্র জাফলংয়ে পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড় থাকলেও পর্যটকদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে কর্তৃপক্ষ উদাসীন। আর এ কারণে জাফলং এখন মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে।পর্যটকদের সতর্কীকরণের জন্য পর্যটন এলাকায় নামমাত্র সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি সম্বলিত সাইনবোর্ড সাটানো থাকলেও পর্যটকদের চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে। সচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারণার অভাবে পর্যটকরা নদীতে সাঁতার কাটতে নেমে প্রায়ই ঘটে প্রাণহানির মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। অকালেই ঝড়ে যাচ্ছে তরুণ প্রাণ।এদিকে, বুধবার বিকেলে পিয়াইন নদীর জিরো পয়েন্ট এলাকায় সাঁতার কাটতে গিয়ে ঢাকার কবি নজরু কলেজের একাদশ শ্রেণির দুই ছাত্র আব্দুল্লাহ অন্তর (১৮) ও একই বর্ষের ছাত্র সোহাগ ঘোষ (১৭) স্রোতের টানে পানিতে ডুবে নিখোঁজ হয়। রাত সাড়ে ৮ টা পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিস সিলেটের ডুবুরি দলের সদস্যরা অনেক চেষ্টা করেও তাদের উদ্ধার করতে পারেনি। গত বছর ঈদ পরবর্তী একদিনের ব্যবধানে একই স্থানে ৫ পর্যটকের সলিল সমাধি হয়। গত বছরের ঈদ-উল-ফিতরের পরদিন বুধবার দুপুরে পিয়াইন নদীর জিরো পয়েন্ট এলাকায় সাঁতার কাটতে গিয়ে সিলেটের শাহী ঈদগাহ এলাকার খোরশেদ আলমের ছেলে কামরুল নিখোঁজ হন। রাতভর চেষ্টা করে বৃহস্পতিবার সকালে সিলেটের ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল তার মরদেহ উদ্ধার করে। বৃহস্পতিবার সকালে অজ্ঞাত অপর আরেক ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার করে স্থানীয় লোকজন। ওইদিন সন্ধ্যায় পর্যটন এলাকার বল্লাঘাটে নৌকা ডুবে তিন স্কুলছাত্র নিখোঁজ হলে রাত ১০ টায় ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দলের সদস্যসহ স্থানীয়রা প্রায় ৪ ঘণ্টা উদ্ধার অভিযান চালিয়ে শ্রীমঙ্গল উপজেলার শিলমনি গ্রামের খুরশেদ আলমের ছেলে শাহাদাত হোসেন শাকিল (১৭), দুলুমারা গ্রামের আব্দুর রহিমের ছেলে সাদেক মিয়া (১৭) এবং বিল বড়নগর গ্রামের বাছিদ মিয়ার ছেলে মামুন আহমেদসহ তিন কিশোরের মরদেহ উদ্ধার করে। নিহত তিন কিশোর শ্রীমঙ্গল উপজেলার বিসামণি উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র ছিলো।গত এক যুগে পর্যটন কেন্দ্রে জাফলং এর পিয়াইন নদীতে সাঁতার কাটতে নেমে নৌকা ডুবিতে প্রাণহানি ঘটেছে বিভিন্ন স্কুল কলেজের ছাত্রসহ ৩১ পর্যটকের। এর মধ্যে ২০০৩ সালের ১৫ই আগষ্ট সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই মেধাবী ছাত্র রেজাউর রহমান ফয়সাল (২২) এবং রাজন আহমেদ (২৩), ২০০৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলার মুসা মিয়া (৩২), একই এলাকার ফখরুল ইসলাম (২৫), ২০০৮ সালের ৯ নভেম্বর ঢাকার পল্লবী এলাকার দিলশাদ আহমেদ (১৮) মারা যান। এছাড়া ২০০৯ সালের ২৬ জানুয়ারি হবিগঞ্জ বানিপুর এলাকার ইউনুছ মিয়া (৮), ৮ মে ঢাকার মিরপুরের ফারুক আহমদ (১৮), ২১ জুন নরসিংদী সদর এলাকার সজিব মিয়া (১২), ২০১০ সালের ২৩ মার্চ ঢাকার খিলগাঁও এলাকার তারেক আহমেদ (২৫), ২০ মে সিলেট গোয়াইনঘাট উপজেলার রফিকুল ইসলাম (৩০) এবং গৌরাঙ্গ কর্মকার (২০), ২২ মে ঢাকা জেলার শাহরিয়ার আহমেদ রাব্বি (২৩), ২ জুলাই ঢাকা জেলার তেজগাঁও এলাকার শাহরিয়ার শফিক (১৭), ৩০ জুলাই জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জ এলাকার মুস্তাকিন তালুকদার (২০), ১২ সেপ্টেম্বর ঝালকাঠি জেলার রুহুল আমিন খান রুমী (১৮) মারা যান।এদিকে ২০১২ সালের ২২ আগষ্ট ঢাকা জেলার ফাহাদ উদ্দিন (২২), ৩০ আগষ্ট মৌলভীবাজর জেলার কুলাউরা এলাকার হিমেল রাজ সঞ্জয় (১৮), ২০১৪ সালের ৩০ মে মাদারীপুর সদর উপজেলার চলকিপুর গ্রামের খালেক হাওলাদারের ছেলে মো. ইব্রাহিম (২১) সহ নাম না জানা অনেকেই চলে গেছেন না ফেরার দেশে। এ ব্যাপারে গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সালাউদ্দিন জানান, পর্যটন এলাকায় পর্যটকদের সতর্ক করার জন্য বিভিন্ন সময় সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড সাটানোসহ নানা উদ্যোগ নিলেও আসলে তা কেউ আমলে নেয়না। তিনি বলেন, পর্যটকদের সতর্ক করার জন্য পুলিশ প্রশাসন ও বিজিবি’র সদস্যরা নিয়োজিত থাকলেও তাদের নিষেধ অমান্য করে সাঁতার কাটতে জানে না এমন অনেকেই নদীতে সাঁতার কাটতে নামেন। ফলে অনাকাঙ্ক্ষিত এ দুর্ঘটনাগুলো ঘটে থাকে।ছামির মাহমুদ /এসএস/পিআর
Advertisement