১১ বছর আগে ২০০৭ সালে ইমরান হাশমি ও শায়লি ভগত অভিনীত ‘দ্য ট্রেইন’ সিনেমাটি অনেকেই নিশ্চয় দেখেছেন। সিনেমার একপর্যায়ে স্ত্রীকে রেখে ইমরান হাশমি যখন নতুন বান্ধবীর সঙ্গে রাত কাটাতে যান তখনই হানা দেয় এক সন্ত্রাসী। অস্ত্র ঠেকিয়ে বান্ধবীর সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি তুলতে বাধ্য করা হয়। সেসব ছবি দেখিয়ে পরবর্তী কয়েকবার ইমরান হাশমিকে ব্ল্যাকমেইল করে টাকা হাতিয়ে নেয় ওই সন্ত্রাসী। সিনেমাটির শেষে দেখানো হয়, ওই সন্ত্রাসী ও ইমরানের বান্ধবী একসঙ্গে ফাঁদ পেতে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এমন প্রতারণা করে।
Advertisement
ইমরান হাশমি’র দ্য ট্রেইনের মতো প্রতারণার ঘটনা ঘটছে বাংলাদেশেও। ধরনটা একটু ভিন্ন। সন্ত্রাসী নয় এখানে রেইড দেয় মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের ভুয়া সদস্যরা। তাদের টার্গেট বাংলাদেশের বড় বড় শিল্পপতি। এখানেও একজন বান্ধবী আছেন। যার প্রলোভনে ১১ জন ব্যবসায়ী বিছানা পর্যন্ত গিয়ে ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয়েছেন।
প্রতারণার মূল নায়িকা এবং সেই বান্ধবী হচ্ছেন বাংলাদেশের একজন উঠতি মডেল। নাম জেরিন খান। বয়স ২০। জন্ম চট্টগ্রামে, স্কুলে কখনো যাননি। তবে তার কথাবার্তা ও আচার-আচরণ দেখে এটি বোঝার উপায় নেই। ‘এই লাইনে’ আসার পর গত সাড়ে তিন বছরে বাংলাদেশের অন্তত ১১ জন শিল্পপতির সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়েছেন তিনি। এরপর ডেকেছেন শ্যামলীর ফ্ল্যাটে। সেখানে আনন্দঘন মুহূর্তে তার ‘বন্ধুরা’ ডিবি সেজে হানা দেন। অস্ত্রের মুখে ব্যবসায়ীকে বাধ্য করেন নগ্ন ছবি তুলতে। পরবর্তী সময়ে সেই ছবি দিয়ে চলতে থাকে প্রতারণার রমরমা ব্যবসা।
সম্প্রতি বাড্ডার এক টাইলস ব্যবসায়ীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ডিবি পুলিশ ‘খদ্দের’ সেজে রাজধানীর একটি হোটেল থেকে জেরিনকে গ্রেফতার করে। তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ভুয়া ডিবির সদস্য রাজ্জাক হোসেন রাজ, মো. জাকির হোসেন, খসরু ও মো. শহিদুল ইসলামকে গ্রেফতার করা হয়। সঙ্গে গ্রেফতার করা হয় শ্যামলীর যে ফ্ল্যাটে অপকর্ম চলতো সেটির মালিক রেহানা জামান পপিকে। সর্বশেষ গত ৮ ফেব্রুয়ারি ওই ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের মাধ্যমে নগদ ১২ লাখ টাকা, পাঁচ হাজার ডলার (চার লাখ ২০ হাজার টাকা), দুটি ক্রেডিট কার্ড ছিনিয়ে নেয় চক্রটি।
Advertisement
ডিবি পূর্ব বিভাগের সিনিয়র সহকারী কমিশনার (এসি) আতিকুল ইসলাম মুরাদ জাগো নিউজকে বলেন, আসামিরা সংঘবদ্ধ হয়ে প্রতারণা করতো। তারা ব্ল্যাকমেইলিংয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলো জব্দের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দেয়া হবে। এ ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে ভিক্টিম সামাজিক মর্যাদা রক্ষার্থে পুলিশকে অভিযোগ করেন না।
তিনি বলেন, গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে চক্রের আরও বেশ কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। তাদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে।
ডিবি সূত্রে জানা যায়, ৮ ফেব্রুয়ারি মা অসুস্থ বলে জেরিন ইমতিয়াজকে (ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীর ছদ্মনাম) ফোন করে শ্যামলীর ওই ফ্ল্যাটে ডাকেন। ইমতিয়াজ সেখানে গেলে ডিবি পরিচয়ে কয়েজন তাকে বন্দুক ঠেকান ও মারধর করেন। ওই বাড়িতে জঙ্গি কার্যক্রম হয় বলে স্বীকারোক্তি দিতে বলা হয় তাকে। পরে টাকা, ক্রেডিট কার্ড ছিনিয়ে নেয়া হয়। ক্রেডিট কার্ড দিয়ে যমুনা ফিউচার পার্কের ফেন্সি জুয়েলার্স থেকে ২৬ হাজার ১১০ টাকার স্বর্ণালংকার এবং নগদ এক লাখ ২৫ হাজার টাকা তোলেন জেরিন। ক্রেডিট কার্ডটি সচল আছে কিনা তা নিশ্চিত হতে প্রথমে একটি বিউটি পার্লারে ২৫০ টাকার ভ্রু প্লাক করান।
পরবর্তীতে ওই ব্যবসায়ীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতারণা চক্রের সদস্যদের গ্রেফতার করা হয়। পরে তাদের আদালতের মাধ্যমে রিমান্ডে আনে ডিবি। রিমান্ডে তারা জানান, ফ্ল্যাটমালিক পপি ব্যবসায়ীদের নম্বর সংগ্রহ করে জেরিনের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতেন। গত সাড়ে তিন বছরে চক্রটি ব্ল্যাকমেইলিংয়ের মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। জেরিন ছাড়াও আরেক মডেলের (ঐশী) নাম পেয়েছে ডিবি। জেরিনের একটি গাড়ি রয়েছে, সেটিও প্রতারণার মাধ্যমে এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া।
Advertisement
গ্রেফতারের পর প্রতারণার বিষয়ে পুলিশকে বিস্তারিত জানান জেরিন। পুলিশ জানায়, জেরিন খান বাংলাদেশের একজন উঠতি মডেল। হ-য-ব-র-ল নামের একটি নাটকে নীরব খানের সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন। এরপর নীরবের মাধ্যমে ডিরেক্টর রয়েল খানের সঙ্গে পরিচয়। রয়েল খানই নাকি তাকে দেহ ব্যবসায় আনতে বাধ্য করেছেন- এমন দাবি জেরিনের।
জেরিন আরও জানান, রয়েলের মাধ্যমে বাংলাদেশের নামীদামি ব্যবসায়ীর সঙ্গে পরিচয় হয় তার। তাদের সঙ্গে কখনো স্পেন, কখনো ব্যাংকক আবার কখনো মালয়েশিয়া ভ্রমণ করেন জেরিন। এক প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর সঙ্গে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে ভ্রমণের সময়ে প্লেনচলাকালীন ককপিটেও যান জেরিন। প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর অনুরোধে ছবিও তোলেন পাইলটদের সঙ্গে।
জেরিন জানান, কয়েক বছর ধরে চলছে তার এ প্রতারণা। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে হাতানো টাকা রাখেন নিজের ইস্টার্ন ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে। ছয় মাস আগে শাকিল নামে এক ব্যবসায়ীকে ব্ল্যাকমেইল করে ১২ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। তাদের প্রধান টার্গেট বিবাহিত ব্যবসায়ী। বিবাহিতরা সামাজিক মর্যাদা রক্ষায় খুব সহজেই টাকা দিয়ে দেন।
গ্রেফতারের কয়েকদিন আগে দেশের অন্যতম বৃহৎ এক শিল্পগোষ্ঠীর মালিকের ছেলের সঙ্গে দেখা করে ২০ হাজার টাকা নেন জেরিন। তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতারও দাবি করেন তিনি। পুলিশকে জেরিন জানান, ওই প্রতিষ্ঠানের মালিকের ছেলের সঙ্গে অনেক মডেল দেখা করে টাকা আনেন। শারীরিক চাহিদা মেটানোর জন্য মডেলদের নগদ টাকার পাশাপাশি দামি উপহারও দেন ওই শিল্পপতি মালিকের ছেলে।
তদন্তে ডিবি আরও জানতে পারে, প্রতারণা এ চক্রে জেরিন ছাড়া আরও অনেক মডেল রয়েছেন। তাদের নামের তালিকা তৈরি হচ্ছে।
চক্রের অন্যতম সদস্য পপি। জেরিন ব্যবসায়ীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করে শ্যামলীর খিলজি রোডের যে ফ্ল্যাটে নিয়ে যেতেন সেটির মালিক পপি। পপির অধীনে প্রতারণার কাজ করে অসংখ্য মডেল ও ছেলে। দেশের বড় বড় শিল্পপতিদের নম্বর ও ফেসবুক আইডি সংগ্রহ করে মডেলদের দেয়া ছিল তার কাজ। এরপর মডেলরা দু-তিন মাসের মধ্যে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করে তাদের ওই ফ্ল্যাটে আনতেন।
কেন এমন প্রতারণায় জড়ালেন- পুলিশের এমন প্রশ্নে ‘মায়াকান্না’করে পপি জানান, স্বামী গুরুতর অসুস্থ। তার এ প্রতারণার অর্থ দিয়ে চলে স্বামীর চিকিৎসা।
ডিবি জানায়, ভুয়া ডিবি রাজ্জাক হোসেন রাজ কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সদস্য। তিনি প্রাইম ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ছিলেন। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতিও ছিলেন তিনি।
বাকিদের একজন একটি ফার্মে ওকালতি প্র্যাকটিস করেন, আরেকজন একটি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী। প্রতারণার ঘটনায় আসামিদের বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়েছে।
এআর/জেএইচ/পিআর