অরলান্ডোর রাস্তা জুড়ে জ্যাম। আধা ঘণ্টার রাস্তা এক ঘণ্টাতেও শেষ হবে বলে মনে হয় না আজ। কাজের তাড়া আছে। ছুটি কাটিয়ে কাজে ফেরার পর একগাদা কাজ জমে থাকে। রমিজ সাহেবকে হাসপাতালে দেখতে যাবো প্রথমে, তারপর অফিস।
Advertisement
রমিজ সাহেব একজন অবসরপ্রাপ্ত বাংলাদেশি অধ্যাপক। ক্যানসাস থেকে এ শহরে এসেছেন অবসরে যাবেন বলে। অরলান্ডোর আবহাওয়া তার পছন্দ। ফলিত পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে এদেশে এসেছিলেন গবেষণা করতে। দেশে ফেরা হয়নি। প্রবাস জীবনের শুরুতেই তার এক সহকর্মী নেলিকে বিয়ে করে ফেললেন।
দীর্ঘ দশ বছরের বিবাহিত জীবন ভেঙে গেল। কী কারণে ভেঙে গেল জানি না। এদেশে এসব জিজ্ঞেস করতে নেই। এটি নিছক তাঁর নিজের ব্যাপার।
বছর দেড়েক পর রুমানিয়ার এক চমৎকার মহিলা ইরিনার সঙ্গে তাঁর পরিচয় হলো। দীর্ঘদিন তাঁরা একসাথে আছেন। একটি সন্তান তাদের। সন্তানটি জন্মগতভাবে বধির। এ নিয়ে রমিজ সাহেবের অনেক দুঃখবোধ আছে।
Advertisement
তাঁর স্ত্রী বাংলাতে কথা বলতে পারেন না। তিনি ভেবেছিলেন তাকে বাংলা শিখিয়ে নেবেন। কিন্তু হয়নি। আর ছেলেটিও বাংলা বলতে পারে না।
আমি তাঁকে গত পাঁচ বছর ধরে চিনি। পরিপাকতন্ত্রের বিশেষ কোনো সমস্যা নেই তাঁর। তিনি নিছক বাংলাতে কথা বলার জন্য আমার কাছে আসেন। আমি তাঁকে বাংলায় লেখা বই, বাংলা গানের সিডি ধার দেই। তিনি আমাকে মজার মজার সব ভ্রমণ কাহিনি বলেন। তবে অবাক ব্যাপার দেশ ছাড়বার পর আর দেশে ফিরে যাননি তিনি।
একটি মানুষ এত বাংলা শুনতে পছন্দ করেন, অথচ জীবনসঙ্গিনী বাংলা জানেন না। আর বাংলাদেশে যাবার কথাও ভাবেন না!
মানুষের জীবন বড় বিচিত্র।
Advertisement
দু’মাস আগে রমিজ সাহেব আমাকে বললেন- এই ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশে যাবার ইচ্ছে আছে তাঁর। আমি তাঁকে একগাদা উপদেশ দিয়ে দিলাম। আর তাঁর জন্য একটি কবিতা আবৃত্তির সিডি দিয়ে দিলাম। খুব খুশি হলেন তিনি। বললেন, শুনে ফেরত দেবেন।
গত পরশুদিন তাঁকে বাড়ির উঠোনে অচেতন অবস্থাতে পেলেন ইরিনা। হাসপাতালে আনলে দেখা গেলো মাথায় রক্তক্ষরণ হয়েছে। ক্রমাগত অবস্থার অবনতি হচ্ছে।
অচেতন নিথর রমিজ সাহেবকে দেখে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো। তাঁর মাথার কাছে আমার দেয়া সেই কবিতাটা বাজছে দেখে অবাক হলাম। ইরিনা সেটা বুঝতে পেরে বলল, এ সিডিটি তিনি দিন-রাত মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনতেন।
বলা যায় অনেকটা যন্ত্রপাতি দিয়ে রমিজ সাহেবকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে।
আমি আলতো করে তাঁর হাত ধরলাম। আমি কবিতা শুনতে পাচ্ছি। সাথে সেতারের মায়াজাল। আমার মনে হলো তিনি ম্লান হাসলেন।
মহাদেব সাহার ‘ঝরে যাই আমি ঝরাপাতা’ বাজছে তখন...
‘তুমি থাকো নক্ষত্র খচিত রাত্রি, শুভ্র মেঘউজ্জ্বল সকালথাকো বৃক্ষ, থাকো বন, থাকো শিশু ও কিশোরথাকো মাতৃ স্নেহ, থাকো অপার করুণাথাকো প্রেম,থাকো নিবিড় চুম্বনঝরে যাই আমি ঝরাপাতা।’
এসএইচএস/পিআর