এখন রোরো ধান চাষের মৌসুম চলছে। কৃষকের মাঠের ব্যস্ততা বেড়েছে দ্বিগুণ। ধান রোপণের পর মাঠের আগাছা দমনে ব্যস্ত সব কৃষক। সড়ক দিয়ে চলার পথে চোখের দৃষ্টি আটকে যাবে দলবেঁধে নারীদের মাঠে কাজের ব্যস্ততার চিত্র দেখে।
Advertisement
এরা আদিবাসী ‘ওঁরাও’ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। কঠোর পরিশ্রমী। পুরুষের সঙ্গে সমানতালে তারা মাঠে কাজ করে যাচ্ছেন। কাজের ব্যস্ততার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে তাদের দিন বদলের স্বপ্ন।
ওঁরাও সম্প্রদায়ের শতাধিক পরিবারের বাস গাজীপুরের শ্রীপুরে। একটা সময় ছিল সময়ের সঙ্গে টিকে থাকতে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে তাদের।
তবে, নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতায় তাদের ভাগ্য সহায় ছিল না। বিভিন্ন কারণে দিন দিন তাদের সংখ্যা কমে যাওয়া সত্ত্বেও এখনও যারা টিকে আছে। তারা দিনবদলের স্বপ্নে বিভোর। বর্তমান সরকার তাদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাও বাড়িয়েছে।
Advertisement
ওঁরাও দক্ষিণ এশিয়ার একটি বড় উপজাতি। ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্য, ছত্রিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, ওড়িশ্যা ও পশ্চিমবঙ্গে এদের বাস। বাংলাদেশেও রয়েছে এদের বাস।
তারা কুরুখ ভাষায় কথা বলেন। অনেক জায়গায় এদের কুরুখ জাতি বলা হয়। দেশের উত্তরবঙ্গেও ওঁরাও সম্প্রদায়ের বসবাস। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুয়ায়ী বাংলাদেশে ওঁরাওদের বসবাস ছিল প্রায় ছয় হাজার।
গাজীপুরের শ্রীপুরে ব্রিটিশ শাসনামল থেকে চলছে ওঁরাওদের বসবাস। উপজেলার তেলিহাটি ইউনিয়নের টেংরা গ্রামে ১২টি পরিবারে ৬৮ জন, রাজাবাড়ি ইউনিয়নের বিন্দুবাড়ি গ্রামে ২৫টি পরিবারে ১১৮ জন বসবাস করছেন।
সনাতন ধর্ম পালনকারী ওঁরাও সদস্যরা দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে শ্রীপুরে তাদের জনসংখ্যা হাজারের কাছাকাছি থাকলেও অভাব-অনটনের সঙ্গে টিকতে না পেরে অনেকইে ভারতে চলে গেছেন। আবার অনেকেই ধর্মান্তরিত হয়ে অন্য ধর্মগ্রহণ করেছেন। এভাবে শুধু তাদের সংখ্যা দিন দিন কমে গেছে। অতীতে বিশেষ ভাবে ওঁরাও নারীরা নিগৃহীত থাকলেও এখন সব কাজে ওঁরাও নারীদের এগিয়ে যাওয়া লক্ষ্যণীয়।
Advertisement
বিন্দুবাড়ি গ্রামের শতবর্ষী লালমোহন দেওয়ানী জানান, তাদের পূর্ব-পুরুষের বসতি ভারতের নাগপুরে। ব্রিটিশরা বাংলাদেশে রেলপথ তৈরি করার উদ্দেশ্যে তাদের কাজ করাতেন। সে সূত্র ধরেই তারা বাংলাদেশে এসে বসতি স্থাপন করেন। তাদের পূর্ব-পুরুষরা মূলত রেলপথের মাটি কাটার কাজ করতেন। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে এখন তারা কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
একই গ্রামের বকুল ওরাং জানান, একটা সময় ছিল তারা নানাভাবে কষ্ট করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এখন আর তাদের সেসব কষ্ট নেই। এখন তাদের পাশাপাশি নারীরাও মাঠে কাজ করেন। বর্তমানে তারা ভালোই আছেন।
টেংরা গ্রামের কুসুমতারা জানান, নারী বলে আগে তাদের কেউ কাজে নিত না। এখন সবার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে গেছে। ওঁরাও নারীরা কাজে ফাঁকি না দেয়ার কারণে এখন তাদের কদরও বেড়েছে। পুরুষদের পাশাপাশি তারা মাঠে কৃষিকাজ করেন। এখন স্বামী সন্তান নিয়ে আগের চেয়ে ভালোই আছেন।
নিরালা একট্রা জানান, ওঁরাওরা খুবই পরিশ্রমী। এখানে অলসতার কোনো স্থান নেই। সংসারের সবাই কাজ করেন। তাদের ছেলে-মেয়েরা এখন বিদ্যালয়ে যায়। তারাও পড়ালেখার ফাঁকে বাবা ও মায়েদের সাহায্য করেন। তার তিন সন্তান এখন বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছেন।
ঢাকার নটরডেম কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ালেখা করছেন মিঠুন একট্রা। তিনি জানান, ওঁরাওরা এখন লেখাপড়া করে বিভিন্ন কুসংস্কার ভেদ করে এগিয়ে যাচ্ছে। তাই ভবিষ্যতে পড়াশোনা শেষ করে সরকারি চাকরি করার ইচ্ছা তার।
বিন্দুবাড়ি গ্রামের সবুজমনি জানান, তাদের এলাকায় সবাই দরিদ্র। তার নিজেরসহ আরও ৮ জন মহিলা বিধবা হলেও এখন পর্যন্ত বিধবাভাতার ব্যবস্থা হয়নি। তার আশা সরকার তাদের উন্নয়নে দৃষ্টি দেবে।
রাজাবাড়ি ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ড সদস্য মিজানুর রহমান নিহার জানান, এক সময় পুরো বিন্দুবাড়ি এলাকাটি ওঁরাওদের বসবাস ছিল। তবে নানা কারণে তাদের সংখ্যা কমছে। এখন যারা টিকে আছে তারা মাঠে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে সন্তানদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করছে। ওঁরাওরা এখন দিনবদলের স্বপ্ন দেখছেন।
উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মন্জুরুল হক জানান, ইতোমধ্যেই অনেককে সরকারের সামাজিক উপকারভোগীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সমাজে তাদের প্রতিষ্ঠিত করতে নানা ধরনের বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। তবে আশার কথা ওঁরাও নারীরা এখন দিন দিন স্বাবলম্বী হচ্ছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রেহেনা আকতার জানান, বর্তমান সরকার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদেরকে সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এরই ধারাবহিতায় শ্রীপুরে ওঁরাও সম্প্রদায়ের লোকজনের মধ্যে সরকারি সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে। অতীতের তুলনায় তারা এখন ভালো আছেন। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে ওঁরাও নারীদের এগিয়ে যাওয়া সত্যিই প্রশংসনীয়।
আমিনুল ইসলাম/এএম/পিআর