বিশেষ প্রতিবেদন

‘ভাষা-সংস্কৃতির ইতিহাস নিয়ে দাঁড়াতে পারলাম না’

হাসান আজিজুল হক। উপ-মহাদেশের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক। গল্প, প্রবন্ধ লিখছেন গণমানুষকে কেন্দ্রে রেখেই। ‘মানুষ মুক্তি পাক সর্বত্র’ এমন বিশ্বাস রেখে নানা সামাজিক আন্দোলনেও সম্পৃক্ত থাকছেন। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষার্থেও কাজ করছেন জীবনের সুদীর্ঘ সময় ধরে।

Advertisement

বাংলা ভাষার উন্নয়ন, ভাষা কেন্দ্রিক জাতিসত্তা দাঁড় করানো, বইমেলা প্রসঙ্গ নিয়ে তিনি কথা বলেছেন জাগো নিউজ-এর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু-

জাগো নিউজ : ভাষা সংস্কৃতির ইতিহাস নিয়ে কোথায় যেতে পারলাম আমরা? হাসান আজিজুল হক : আমরা তো অনেক দূরেই যেতে পারতাম। যাওয়ার কথাই ছিল বটে। ৩০ কোটি মানুষ বাংলায় কথা বলে। বাংলার মতো অন্য ভাষায় আবেগ প্রকাশ করা যায় না। কিন্তু পারিনি ঠিক। ঠেকে যেতে হলো ভীষণভাবে।

জাগো নিউজ : আসলে ঠেকতে হলো কোথায়? এগিয়ে যাওয়ার বেলায় ধাক্কাটি ঠিক লাগল কখন?

Advertisement

হাসান আজিজুল হক : আমাদের শিল্প-সাহিত্যের ওপর আঘাত আসে তো দেশ ভাগের সময়ই। দেশভাগ বড় আঘাত হেনেছে আমাদের জাতিসত্তায়। ১৯৪৭ সালের ঘটনা শুধু মনের ওপর আঘাত হানেনি। বড় আঘাত হেনেছে সাহিত্যে। ভাঙা মনে সৃষ্টিতে ব্যাঘাত ঘটে।

জাগো নিউজ : কিন্তু চূড়ান্ত আঘাতটা তো পাকিস্তান আমলেই...

হাসান আজিজুল হক : হ্যাঁ, পাকিস্তান আমলের খড়গটি ছিল ভয়াবহ। দেশ ভাগের এক বছর পরেই ঢাকায় জিন্নাহ এসে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্র ভাষার ঘোষণা দিল। অথচ জিন্নাহ নিজেই উর্দু ভালো জানতেন না। বাঙালির ভাষা কী হবে, তা জিন্নাহ ঘোষণা করার কে? জিন্নাহ নিজেই ছিলেন পার্সি। শাসন আর শোষণ করতে যে ভাষার ওপর প্রথম আঘাত হানতে হয়, তা জিন্নাহ ঠিক বুঝতে পেরেছিলেন। পাকিস্তানের ওই সময়ের শাসকদের অনৈতিক এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদের কথা সবারই জানা।

জাগো নিউজ : ‘লড়াই করে ভাষার অধিকার রক্ষা’ এমন গৌরব তো একমাত্র বাঙালি জাতির-ই। তবুও তো ভাষা-সংস্কৃতির প্রশ্নে পিছিয়ে রইলাম।

Advertisement

হাসান আজিজুল হক : আমরা তো লড়াই করেই এতদূর এগিয়েছি। লড়াই করা আমাদের রক্তের সঙ্গে মিশে আছে। গণতন্ত্রের জন্য, নিজের অধিকারের জন্য লড়াই করার ইতিহাস বাঙালির হাজার বছরের। লড়াই করছে মানুষ এখনও। ভাষা-সাহিত্য নিয়ে কথা বলতে গেলে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিকেই আগে আনতে হবে। একটি ভাষার লড়াইয়ের ইতিহাসের ওপর জাতিসত্তা দাঁড়াতে পারে, তা তো আমরাই প্রমাণ করেছি। ভাষার ওপর জাতিসত্তা দাঁড়িয়েছে দুনিয়ার অন্যত্রও। ভাষা ছাড়া মানুষের আর আছে কী? ভাষাই তো মানুষের অস্তিত্ব। ভাষা হারালে আর কিছুই থাকে না। ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ বেদিতে গেলে সব সামনে ভেসে আসে। গর্ব হয়, নিজের অস্তিত্ব প্রকাশ পায়। বুঝতে পারি ২১ ফেব্রুয়ারির মধ্য দিয়েই আমাদের সব আন্দোলনের রূপরেখা দাঁড়ালো। নইলে মুক্তিযুদ্ধসহ সব আন্দোলন এত স্বতঃস্ফূর্ত হয় কী করে!

জাগো নিউজ : ভাষা-সংস্কৃতির বইমেলার আয়োজন থেকে আমরা কী পেলাম?

হাসান আজিজুল হক : ২১ ফেব্রুয়ারির চেতনা থেকেই বইমেলার আয়োজন। এ আয়োজনের উদ্দেশ্য ছিল ভাষা-সাহিত্যের বিকাশ এবং উন্নয়ন। প্রায় অর্ধশত বছরে বাংলাদেশ। কিন্তু কোথায় যেন থমকে গেল! আমরা ঠিক ভাষা-সংস্কৃতির ইতিহাস নিয়ে দাঁড়াতে পারলাম না। ২১-এর চেতনায় এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এ চেতনা নিয়ে এখন রাজনীতি হয় তীব্রভাবে। আমরা ইতিহাস ভুলে যাই বলেই আজকের সংকট। বইমেলার আয়োজনও একই প্রশ্নে সফল হয়নি বলে মনে করি।

জাগো নিউজ : মায়ের ভাষা রক্ষার্থে লড়াই করলো বাঙালি। অন্যের ভাষার মর্যাদা দিতে পারছি আমরা?

হাসান আজিজুল হক : বাংলা অধিকারে লড়াই করেছিলাম, অন্য আরও ভাষার মর্যাদা এবং সম্মান দেয়ার জন্য। কিন্তু আমরা কি তা পারলাম? পাহাড়ের ভাষার মর্যাদা দিতে আমরা দ্বিধাবোধ করি। সমতলের সাঁওতালরা ভাষা হারা হয়ে যাচ্ছে। নিজেদের ভাষা ওরা প্রায় ভুলেই বসেছে। অথচ রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব সব ভাষা এবং সংস্কৃতির উন্নয়ন এবং সংরক্ষণ করা। তা কিন্তু হলো না। বইমেলায় নানা আলোচনা হয় রোজ রোজ। এসব সংকট নিয়ে আলোচনা হয় না। আদিবাসীরাও তো আমাদের সমাজেরই মানুষ। অথচ মানুষ হিসেবে রাষ্ট্রও ঠিক তাদের স্বীকৃতি দিতে চাইছে না।

জাগো নিউজ : রাষ্ট্র কেন এমনটি করে বলে মনে করেন?

হাসান আজিজুল হক : ভাষা দিয়ে ভাষা গ্রাস করার ইতিহাস অনেক আছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলো তো ভাষা-সংস্কৃতির কবলে পড়েই হারিয়ে যাচ্ছে। নিজস্ব স্বকীয়তা, ঢংয়ের আর কিছুই ধরে রাখতে পারছে না। আদিবাসীরা মিশে যাচ্ছে বাঙালি স্রোতে। এতে সমাজের ভিত্তি দুর্বল হচ্ছে। বৈচিত্র্যতা হারিয়ে যাচ্ছে।

আমরা আমাদের দায় থেকে শিল্প-সাহিত্যের বিকাশ ঘটাতে পারছি না বলেই সব কিছুই রাজনীতির দখলে চলে যাচ্ছে। বই লেখা, প্রকাশ এবং বইয়ের মেলাও। এএসএস/এমবিআর/আরআইপি