এম আবদুল আলীম:
Advertisement
ইতিহাস ও শিল্প পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। ইতিহাসের কঙ্কালের উপর কল্পনার অস্থি-মজ্জা মিশিয়ে লেখক সৃষ্টি করেন সফল শিল্পকর্ম। লেখকের কল্পনার জাদুর কাঠির স্পর্শে ইতিহাসের চরিত্রগুলো জীবন্ত হয়ে ওঠে। ঘটনা ও চরিত্রের দ্ব›দ্ব-সংঘাত এবং ক্রিয়া-কলাপের মধ্যে দিয়ে উপন্যাসের কাহিনি গতিশীল হয়। বাঙালির ইতিহাসের এক তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায় গত শতাব্দীর ষাটের দশকের ছয় দফা আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থান। এটি বাঙালির স্বাধিকার সংগ্রামের ও স্বাধীনতার ইতিহাসে এক বিরাট মাইল ফলক।
ইতিহাসের এই উজ্জ্বল মুহূর্তের প্রধান কুশীলব ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁকে কেন্দ্রবিন্দুতে স্থাপন করে বর্তমান সময়ের শক্তিমান কথাসাহিত্যিক মোস্তফা কামাল রচনা করেছেন ‘অগ্নিপুরুষ’ উপন্যাস। ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন থেকে উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব কীভাবে ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে ওঠেন এবং রূপান্তরিত হন ইতিহাসের অগ্নিপুরুষে, এ উপন্যাসে মূলত তারই আলেখ্য বিধৃত হয়েছে।
ইতিহাসকে আশ্রয় করে উপন্যাস রচনা নতুন কিছু নয়। বাংলা সাহিত্যের সূচনালগ্ন থেকেই এ প্রবণতা লক্ষ করা যায়। বাংলার সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি তথা যুগের অভিঘাত সকল ঔপন্যাসিকের রচনাতেই কম-বেশি উঠে এসেছে। বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস ‘আলালের ঘরের দুলাল’ সেকালের সমাজ-ইতিহাসের বাস্তব দলিল। এরপর রমেশচন্দ্র দত্ত থেকে শুরু করে বঙ্কিম-শরৎ-রবীন্দ্রনাথ এমনকি মানিক-বিভ‚তি-তারাশঙ্করের কথাসাহিত্যেও সমকালীন ইতিহাস তথা যুগ-জীবনের চালচিত্র স্থান পেয়েছে অনিবার্যভাবে।
Advertisement
সাতচল্লিশের দেশভাগের পর উভয় বাংলার কথাসাহিত্যিকদের প্রধান অবলম্বন হয় ইতিহাস। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা এবং ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গ তাদের লেখনীতে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে তাঁদের সাহিত্যের প্রধানতম বিষয়। ইতিহাসের নায়ক, খলনায়ক এবং প্রতিনায়কদের ক্রিয়াকলাপ ও ভূমিকা লেখকদের কুশলী হাতে শৈল্পিক রসমূর্তিতে আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। এরই ধারাবাহিকতায় বাঙালির ইতিহাসের উজ্জ্বলতম পুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে রচিত হয়েছে মোস্তফা কামালের ‘অগ্নিপুরুষ’ উপন্যাস। এতে ইতিহাসের সত্য শিল্পসত্যে রূপান্তরিত হয়েছে।
উপন্যাসের আখ্যানভাগ জুড়ে রয়েছে ৬৬-র ছয় দফা আন্দোলন ও ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাস। পাকিস্তানের লাহোরে ছয়দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে শেখ মুজিবুর রহমানের ‘ঢাকা বিমানবন্দরে পা রেখে স্বস্তির নিশ্বাস’ ছাড়ার মধ্য দিয়ে উপন্যাসের কাহিনি শুরু হয়েছে।
এরপর ছয় দফকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের শঙ্কা ও চ্যালা-চামুণ্ডাদের নানা অপতৎপরতা ; তার সেনাপতি মুসা খান, ইয়াহিয়া খান, গভর্নর মোনায়েম খান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং সরকারের বিভিন্ন সংস্থার নানা কার্যকলাপ ; শেখ মুজিব ও তাঁর অনুসারী তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামারুজ্জামান, খন্দকার মোশতাক আহমদ, ড. কামাল হোসেন, মতিয়া চৌধুরী, তোফায়েল আহমদ, শেখ ফজলুল হক মণি প্রমুখের ছয় দফার পক্ষে গণআন্দোলন সৃষ্টি; তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, সিরাজুদ্দিন হোসেন, আসাফ-উদ-দৌলা, জহুর হোসেন চৌধুরী, আহমদুল হক, সন্তোষ গুপ্ত, বজলুর রহমান, শহীদুল্লা কায়সারসহ তখনকার খ্যাতিমান সাংবাদিকদের ছয় দফার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন; ফজিলাতুন্নেসা রেণু, হাসু, জামাল, কামাল ও রাসেলকে ঘিরে শেখ মুজিবের পারিবারিক আনন্দ-বেদনা; মওলানা ভাসানীর দ্বিমুখী আচরণ এবং শেষপর্যন্ত বাঙালিদের স্বাধিকার সংগ্রামে শামিল হওয়া; পাকিস্তান সরকারের রবীন্দ্রবিরোধিতা; শেখ মুজিবসহ অন্য নেতাদের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ফাঁসানোর চেষ্টা; ছাত্রদের এগার দফা ভিত্তিক আন্দোলন, সার্জেন্ট জহুরুল হক হত্যাকাণ্ড, উত্তাল গণঅভ্যুত্থান, গোলটেবিল বৈঠক, শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভ‚ষিত করা এবং ক্ষমতার দৃশ্যপট থেকে আইয়ুব খানের বিদায়ের মধ্য দিয়ে উপন্যাসের কাহিনি শেষ হয়েছে। একই সঙ্গে আখ্যানভাগে স্থান পেয়েছে সমসাময়িক আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ঘটনা এবং ইতিহাসের খুঁটিনাটি নানা চিত্র।
উপন্যাসের প্রধান চরিত্র শেখ মুজিব। তাঁকে কেন্দ্র করে উপন্যাসের সকল ঘটনা ঘনীভ‚ত হয়েছে এবং আপরাপর চরিত্রগুলো আবর্তিত হয়েছে। তাঁর নেতৃত্বের সম্মোহনী শক্তি, ব্যক্তিত্ব, আবেগ-উচ্ছ্বাস, দৃঢ়তা, ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতির প্রকাশ এবং সর্বোপরি ইতিহাসের মহানায়কে পরিণত হওয়ার বিষয়টি ঔপন্যাসিক অতি দরদের সঙ্গে তুলে ধরেছেন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শত নির্যাতন, জেল-জুলুম কোনো কিছুই শেখ মুজিব চরিত্রকে বিচলিত করতে পারেনি। ইতিহাসের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের নায়করূপে তিনি আবির্ভূত হয়েছেন।
Advertisement
এছাড়া পিতা হিসেবে, স্বামী হিসেবে এবং পরিবারের কর্তা হিসেবে শেখ মুজিব কতটা আন্তরিক ছিলেন তাও লেখকের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। কী সূক্ষ তাঁর বর্ণনা : ‘রাসেলকে কোলে নিয়ে শেখ মুজিব খাটের ওপর বসলেন। তাঁকে ঘিরে কামাল, জামাল ও রেহানা। হাসিনাও এক পাশে গিয়ে বসলেন। ... ফজিলাতুন্নেসা রেণুও তাদের সঙ্গে যুক্ত হন। চা খেতে খেতে শেখ মুজিব পরিবারের সবার খোঁজখবর নেন। কে কোথায় পড়ে, কী পড়ে, কে কীভাবে স্কুলে যায়; এসব কথাবার্তা আর পারিবারিক আলোচনায় মশগুল হয়ে যায় সবাই।’ (পৃ. ১৭) শেখ মুজিব ছাড়াও বাঙালির স্বাধিকার-সংগ্রামের অনুঘটক চরিত্রগুলো; যেমনÑতাজউদ্দিন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী, মানিক মিয়া, মতিয়া চৌধুরী, তোফায়েল আহমদ প্রমুখকে লেখক অতি দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন। উপন্যাস পাঠকালে মনের অজান্তেই এসব চরিত্রের প্রতি পাঠকের শ্রদ্ধাবোধ জেগে ওঠে।
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও তাদের তল্পিবাহক চরিত্রগুলো নেতিবাচক দৃষ্টিতে রূপায়িত হয়েছে, যা এই ঐতিহাসিক উপন্যাসের কাহিনিকে বাস্তবধর্মী করে তুলেছে। যে চরিত্রকে যেভাবে তুলে ধরলে ইতিহাসের দায়বদ্ধতা রক্ষিত হবে, তিনি সেভাবেই তাদের তুলে ধরেছেন। স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের চরিত্রটি স্বমূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করেছে। তার উৎকণ্ঠা, ভেতর-বাইরের দ্বন্দ্ব, কঠোরতা, নিষ্ঠুরতা, ভাঁড়ামি এবং নানা কূটকৌশল সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হওয়া তথা খলনায়কে পরিণত হওয়ার বিষয়টি লেখক বিচক্ষণতার সঙ্গে রূপায়িত করেছেন। আইয়ুব খানের প্রধান সেনাপতি মুসা খান, সেনাপতি ইয়াহিয়া খান, গভর্নর মোনেম খান, মন্ত্রী সাহাবউদ্দিন প্রমুখ চরিত্র তোষামুদে এবং ব্যক্তিত্বহীন।
মোনায়েম খানের স্বরূপ উন্মোচনে ঔপন্যাসিক লিখেছেন : ‘প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের ফোন পেয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন মোনেম খাঁন। তিনি স্যার স্যার বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেললেন। একপর্যায়ে প্রেসিডেন্ট সাহেব বলতে বাধ্য হলেন, এত স্যার স্যার বলার দরকার নেই।’ (পৃ. ২৩) ইয়াহিয়া খান কপটতা ও কুটিলতায় পরিপূর্ণ এক ধূর্ত চরিত্র। প্রেসিডেন্টকে খুশি করার জন্য নানা কলাকৌশল অবলম্বন করে। ছয় দফা আন্দোলন দমন ও শেখ মুজিবকে শায়েস্তা করতে প্রেসিডেন্টকে নানা কুপরামর্শ দিয়ে এবং মোসাহেবি করে সে মুসা খানকে হটিয়ে পদোন্নতি পেয়েছে। লেখকের বর্ণনা : ‘ইয়াহিয়া খানের বক্তব্যে খুশি হলেন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব। তাঁর চেহারা দেখেই তা বোঝা যাচ্ছে। সেনাপ্রধান মুসা খান আড়চোখে তাকাচ্ছেন আর তাঁর চোখে-মুখে খুশির ঝিলিক দেখতে পাচ্ছেন। তিনি মনে মনে বলেন, এ কারণেই ইয়াহিয়া তরতর করে উপরে উঠে যাচ্ছেন।’ (পৃ. ২০)
ইতিহাসের চরিত্র ও ঘটনাকে উজ্জ্বল করতে অপ্রধান বহু চরিত্রের সন্নিবেশ ঘটেছে উপন্যাসে। তাদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের নানা প্রসঙ্গ উপন্যাসের কাহিনিকে পূর্ণতা দান করেছে। বিশেষ করে, মতিয়া চৌধুরীকে কেন্দ্র করে তাঁর পিতা মহিউদ্দিন আহমেদ ও মাতা নূরজাহান বেগমের প্রাত্যহিক জীবনের অনেক ছোট ছোট ঘটনা এ উপন্যাসের কাহিনিকে অভিনবত্ব দান করেছে।
চাল-বিক্রেতা রহিম বক্স, মাছ-বিক্রেতা, মুরগি-বিক্রেতা এবং সবজি-বিক্রেতা লেখকের কুশলী হাতে স্ব-রূপে প্রকাশিত হয়েছে। ঐতিহাসিক উপন্যাসে এ ধরনের চরিত্র রূপায়ণ এবং ঘটনার সন্নিবেশ উপন্যাসের শিল্পকাঠামোকে সমৃদ্ধ করে এবং কাহিনিকে বাস্তবধর্মী করে তোলে। উপন্যাস তো কেবল ইতিহাসের ঘটনার হুবহু বয়ান নয়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় লেখক ‘সেই সত্য’ রচনা করবেন, যা ঘটে তা ‘সব সত্য’ নয়। কাহিনির পূর্ণতা দানের জন্য লেখক কল্পনার পাখায় ভর করেন। এ উপন্যাসের ক্ষেত্রেও লেখক সে-কাজটিই করেছেন।
উপন্যাসটি পড়তে পড়তে মনে হয়Ñএতে ইতিহাসের আবহ নির্মাণ, যুগের চালচিত্র রূপায়ণ এবং উপন্যাসের কাহিনি-বর্ণনা ও ভাষাশৈলী সৃষ্টিতে লেখক সফল হয়েছেন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্যমূলক আচরণ এবং সীমাহীন শোষণে পূর্ব পাকিস্তানে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বঘতিসহ নানা সঙ্কট সৃষ্টি হয়। আন্দোলনের তুঙ্গ মুহূর্তে অগ্নিপুরুষ শেখ মুজিব চলে আসেন ইতিহাসের কেন্দ্রবিন্দুতে আর খলনায়ক আইয়ুব খান চলে যান দৃশ্যপটের বাইরে। ‘বাজারের অবস্থা খুব খারাপ।
হঠাৎ চালের দাম বেড়ে গেছে। মানুষ কী খেয়ে বাঁচবে তাই চিন্তা করছি।’ কিংবা ‘১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্র“য়ারি। ... মহাবীরের বেশে কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টের কারাগার থেকে বের হয়ে আসেন শেখ মুজিব। ... একদিকে চলে শেখ মুজিবকে বরণ আর অন্যদিকে বিক্ষুব্ধ জনতা ক্যান্টমেন্টে প্রতিষ্ঠিত সামরিক আদালত জ্বালিয়ে দেয়।’ (পৃ. ২৫৫) এসব বর্ণনায় সমকালীন যুগচিত্রের ছাপ স্পষ্ট। গতিময় ও আবেগপূর্ণ বাক্য, তদ্ভববহুল শব্দ এবং প্রাসঙ্গিক প্রবাদ-প্রবচন ও লোকসংগীতের ব্যবহার উপন্যাসের ভাষাশৈলীকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে। সর্বোপরি, ইতিহাসের প্রাণপুরুষ শেখ মুজিব উপন্যাসমধ্যে অগ্নিপুরুষরূপে চিত্রিত হয়ে উপন্যাসের নামকরণ সার্থক করে তুলেছে।
ইতিহাসের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের শৈল্পিক বয়ানরূপে উপন্যাসটি নতুন প্রজন্ম তথা পাঠকের কাছে সমাদৃত হবে বলে আমার বিশ্বাস।
অগ্নিপুরুষ : মোস্তফা কামাল। প্রচ্ছদ : ধ্রুব এষ। প্রকাশক : পার্ল পাবলিকেশন্স, ফেব্রুয়ারি ২০১৮। মূল্য : ৪০০ টাকা।
এইচআর/জেআইএম