সাহিত্য

কোন এক বাবাকে : স্মৃতিময় দিনগুলো

বিস্তৃত জীবনের উপাখ্যান নিয়ে গড়ে ওঠে প্রতিটি উপন্যাসের পটভূমি। জীবনের নানা বাঁক বদলের গল্প এতে প্রতিফলিত হয়। ফলে পাঠক নিবিষ্ট মনে উপন্যাসের স্বাদ গ্রহণ করবেন। উপন্যাসের গল্প বলার পরম্পরায় পাঠকও খুঁজে পাবেন আপন জীবনের প্রতিচ্ছবি। এমনই একটি উপন্যাস ‘কোন এক বাবাকে’। এটি সালমা হোসেনের প্রথম উপন্যাস। এর আগে তার ‘আমার কবিতার খাতা’ শিরোনামের একটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। তার কবিতার বইটি এরই মধ্যে পাঠকমহলে সমাদৃত হয়েছে। এ বইয়ে যেমন তুলে এনেছেন জীবন ও বাস্তবতা; তেমনটি উপন্যাসেও বিধৃত করেছেন জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

Advertisement

সালমা হোসেনের উপন্যাসের পাতায় পাতায় এক বাবার আপত্য স্নেহ, ভালোবাসা ও মমতার কথা প্রকাশ পেয়েছে। একজন সন্তানের কাছে বাবা কতটা আশ্রয়ের ও নির্ভরতার প্রতীক, তা সালমা হোসেনের এ উপন্যাসের মাধ্যমে উপলব্ধি করা যায়। একজন বাবা তার জীবনের সব সফলতা সন্তানের মাধ্যমে দেখতে চান। ‘কোন এক বাবাকে’ পড়ে মনে হয়েছে সালমা হোসেন তার জীবনের গল্পই পরিবেশন করেছেন। উপন্যাসের শুরুতে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করা একজন মানুষের চাকরির পেছনে ছুটে চলার প্রেক্ষাপট চিত্রিত হয়েছে। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র তনু ঢাকার বাইরের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে এসেছেন। চাকরির পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার জন্য ঢাকায় এসে কোচিংয়ে ভর্তি হয়েছেন। এ নিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘দেশের শীর্ষস্থানীয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি থেকে পড়ালেখা শেষ করে বিসিএস কোচিং আর চাকরির উদ্দেশ্যে কয়েক মাস হলো ঢাকা শহরে এসেছি। ফার্মগেইটে ছোট্ট একটা ফ্ল্যাটে আমার ছোট বোন আর আমি থাকি।’ উপন্যাসের শুরুতে ঔপন্যাসিক সালমা হোসেন একজন মানুষের জীবন যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার কথা জানান দিচ্ছেন। ঢাকা শহরের মানুষের জীবন-যাপনের কথা অত্যন্ত সুনিপুণভাবে সালমা হোসেন বলেছেন তার উপন্যাসে। তিনি লিখেছেন, ‘সিএনজির সাথে একজনের দরদামে মেটে না তো আরও ক’জন ছুটে আসে। সবাই কি ব্যস্ত? নাকি অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এ শহরে সর্বত্রই যেন টিকে থাকার প্রতিযোগিতা।’ সত্যিই চোখের সামনে তিনি ঢাকার নাগরিক ব্যস্ততা এখানে তুলে ধরেছেন। শহুরে জীবনের কথা তিনি আরো পরিষ্কার করে ফুটিয়েছেন এই কথার বুননে, ‘মফস্বলের মানুষদের মধ্যে স্বস্তি আছে। এত ছুটাছুটি নাই। মানুষের জন্য মানুষের সময় আছে। মানুষ সেখানে মেশিনের মত না।’

ব্যস্ত ঢাকা শহরে এসে তনুর চেষ্টা সেই মফস্বলের জীবনধারা ধরে রাখা। তাই তো লোকারণ্য নগরীর মধ্যে বাস করেও তনু শুনতে পান যেন তার নাম ধরে ডাকে। এই ডাকে সাড়া দিয়ে পেয়ে যান ভার্সিটি জীবনের বান্ধবী সুমির দেখা। এরপর সুমিকে তার বাসায় নিয়ে আসেন। হারিয়ে যান ফেলে আসা দিনগুলোতে। লেখাপড়া সম্পন্ন করে তনুর এ পর্যন্ত আসায় প্রতিটি পদক্ষেপে রয়েছে তার বাবার অবদান। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে একজন বাবা তার মেয়েকে আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়তে কতটা উদার হতে পারেন, তা এই উপন্যাস থেকে জানা যাবে। তনু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই তাদের বাড়িতে ঘটকের আনাগোনা বেড়ে যায়। একদিন এক ঘটককে তনুর বাবা বললেন, ‘এ সময় মেয়ের বিয়ে দিলে পড়ালেখায় বাধা পড়বে। পড়ালেখা শেষ হোক তখন দেখা যাবে।’ঘটক বলে, ‘এমন যোগ্য পাত্র হাতছাড়া করে ঠিক করছেন না। কত মেয়েই তো বিয়ের পর পড়ালেখা করে বড় বড় চাকরি করছে।’ঘটক গোটা দশেক মেয়ের উদাহরণ দিলো বিয়ের পর যারা লেখাপড়া করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।তনুর বাবা বললেন, ‘খোঁজ করলে বিয়ের পর লেখাপড়া বন্ধ হওয়া শ’খানেক মেয়ের উদাহরণ এই শহরেই মিলে যাবে।’

উপন্যাসের নায়িকা তনুর বাবাকেই ঘিরে ছিলো তার পৃথিবী। উপন্যাসে তার বক্তব্যেই সে কথা জানা যাক, ‘যতদিন বাবা ছিলেন আমার জীবনটা ছিলো সহজ সরল। কোনো কিছু নিয়েই ভাবতে হতো না। যদি কখনও কোনো সমস্যা এসেও পড়তো মুহূর্তে সব সমাধান হয়ে যেত। চাইতেই প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় সবকিছু পেয়ে যেতাম।’ এভাবেই ‘কোন এক বাবাকে’ উপন্যাসের প্রতিটি পরতে পরতে বাবার স্মৃতি এবং তার অবদানের কথা লেখা হয়েছে।

Advertisement

বাবাকে নিয়ে এমন সুন্দর উপন্যাস উপহার দেওয়ার জন্য সালমা হোসেনকে ধন্যবাদ জানাতেই হয়। সত্যিই এ উপন্যাসটি প্রতিটি পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে যাবে। এবারের অমর একুশে বইমেলায় উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছে নন্দিতা প্রকাশ থেকে। অনুপম করের প্রচ্ছদে উপন্যাসটির মূল্য ১৫০ টাকা। উপন্যাসটির বহুল প্রচার কামনা করছি।

এসইউ/আরআইপি