মতামত

চায়নাবাজি-২

চীনের ইউনান প্রভিন্সের মেয়ে ইয়াং শুপিং পাঁচ বছর আগে আমেরিকার ম্যারিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়েছিল, মনোবিজ্ঞান ও থিয়েটার নিয়ে। গেল বছর মে মাসের ৩য় সপ্তাহে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে অন্যতম সেরা ছাত্রী হিসেবে তাকে বক্তব্য রাখতে দেয়া হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্টের আহ্বানে সে যে বক্তব্য দিয়েছিল তাতে সে খুব তৃপ্ত এবং স্বতঃস্ফূর্ত চিত্তে বলেছিল, যে আমেরিকায় এসেই সে প্রথম চিনেছে বাক স্বাধীনতার মুক্ত সতেজ নিঃশ্বাস। তার সারাজীবন কেটেছে মুখে মাস্ক পরে। আমেরিকায় পা দিয়েই সে টের পেয়েছে এর বায়ু কত সতেজ। সে এই প্রথম মাস্ক খুলে শ্বাস নিয়েছে।

Advertisement

তার এই বক্তব্যে ক্ষোভের আগুন জ্বলে ওঠে ন্যাশনালিস্ট সমাজবাদী চায়নায়। আমার তিন চায়নিজ সহকর্মীদের কথায় বুঝতে পারি সাধারণ জনগণ ফুঁসে উঠেছে যে ইয়াং শুপিং যেই অঞ্চলে বাস করতো, কুনমিং শহর , সেটা চায়নার বিশুদ্ধ বায়ুর জন্য সুখ্যাত। সেটা বেইজিং বা সাংহাইয়ের মত প্রধান বাণিজ্যিক নগরী না যেখানে সবাইকে মাস্ক পরে ঘুরতে হয়।

জনগণ হুমকি দিয়েছে সে যেন চীনে ফিরে না আসে। জানতে চেয়েছে চীন থেকে যারা আমেরিকায় পড়তে যায় তাদের খুবই ধনবান পরিবার থেকেই উঠে আসতে হয়, কাজেই শুপিং এর বাবা মায়ের এই আয়ের উৎস কি? পক্ষান্তরে তারা বোঝাতে চেয়েছে সে ইউএস মিডিয়ার চর বিশেষ। কিন্তু জনতাকে এহেন টুপি পরানো হয়তো চায়না সরকারের বহু বছরের রীতি নীতির কারণেই সম্ভব হয়েছে। কারণ বক্তব্যে শুপিং বিশুদ্ধ বাতাস বলতে আক্ষরিক অর্থে এর জলবায়ুকে বোঝায়নি, বুঝিয়েছে স্বাধীন উন্মুক্ত পরিবেশকে। বাকস্বাধীনতাকে, যেটা চায়নাতে কোন রূপেই নেই।

শুপিং বলেছিল, “ আমেরিকায় আমি শিখেছি কি করে স্বাধীনভাবে এবং বিশুদ্ধতার সাথে নিজেকে প্রকাশ করার অধিকার নিশ্চিত হয়। আমি এমনকি আমার শিক্ষকদেরও মান যাচাই করতে পারি। আমার কণ্ঠ এখানে গুরুত্ব পায়, আমাদের সবার মতামত গুরুত্ব পায়! ” আট মিনিটের বক্তব্যে সে বলেছিল সে তার সহপাঠীদের বর্ণবাদ, লিঙ্গবাদ, রাজনৈতিক মতবাদসহ যেকোন কিছু নিয়ে মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলতে দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়েছে। ” ..কারণ আমি টের পেলাম আমার ভেতরেও এভাবে বলতে পারার এক সুপ্ত দাবানল ছিল। কিন্তু চায়নায় আমি জানতাম যে শুধুমাত্র প্রশাসনেরই এই ক্ষমতা আছে এবং শুধুমাত্র রাষ্ট্রযন্ত্রই নির্ধারণ করে দেবে কোনটা সত্য; কোনটা ভুল, কোনটা শুদ্ধ, কোনটা বলা যাবে, কোনটা না।”

Advertisement

প্রথম চায়নায় যাত্রাবিরতিতে ফেসবুক, জিমেইল , উইকিপিডিয়া না পাওয়ার অভিজ্ঞতার পর অনেক বিস্ময় নিয়ে আমার চায়নিজ ছাত্রছাত্রীদের প্রশ্ন করেছিলাম ইন্টারনেট ব্যবহার নিয়ে। দেখলাম তারা ফেসবুকের বদলে নিজস্ব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে। ভাইবার, হোয়াটস অাপের বদলে উই চ্যাট, ওয়েই বো। এমনকি জিমেইল ইউটিউবেও নিষেধাজ্ঞা। হতভম্ব হলাম এমনকি গুগল এবং উইকির বদলে তাদের নিজস্ব সার্চ ইঞ্জিন। এবং এর কারণ খতিয়ে দেখতে গিয়ে জানলাম চায়না সরকারের সম্পূর্ণ নজরদারির আওতায় যা নেই এমন কোন কিছুই সে দেশে বরদাশত করে না।

জিজ্ঞেস করলাম ফেসবুকে না থাকায় তারা নিজেদের বিচ্ছিন্ন মনে করে না কেন? তাদের জবাব ছিল তাদের সমস্ত বন্ধু-বান্ধব সবাই তাদের নিজস্ব নেটওয়ার্কিং সাইটেই আছে, ফেসবুকে কেউ নেই। কাজেই তাদের বিচ্ছিন্ন ভাবার বা যোগাযোগের বাইরে ভাবার কোন কারণই নেই। গুগল বা ইউকিতে যে কেউ ইচ্ছা করলেই যে কোন তথ্য জানতে পারে। কিন্তু চায়না সরকার জনগণকে শুধু সেই তথ্যটুকুই দেবে যা সরকারের ইতিবাচক ইমেইজ দেয়। শুধু ইতিহাসের বইয়ের পাতা থেকেই না, তাদের সার্চ ইঞ্জিন ঘেঁটেও এসব তথ্য পাওয়া যাবে না কোনদিন।

বুকারস পুরস্কারপ্রাপ্ত ভারতীয় লেখিকা অরুন্ধতী রায়কে এক পাঠক এক সম্মেলনে এই প্রশ্ন ছুঁড়েছিলেন যে তিনি ভারতে এত বাক স্বাধীনতার পরেও এহেন সমালোচনা করেন তো চীনে থাকলে কি করতেন যেখানে সামান্যতম বাকস্বাধীনতাও নেই? তিনি কি ভারতবিদ্বেষী নন? তিনি বলেছিলেন তিনি ভারতীয় বলে গর্বিত এবং এজন্যই তিনি এই স্বাধীনতার মান রাখতে চান। এই স্বাধীনতা মেকি বা মানুষভেদে নির্দিষ্ট না করতেই তিনি আওয়াজ তোলেন, আন্দোলনে জীবনপাত করেন। নয়তো দেশকে ভালো না বাসলে তার মতন বিশ্বখ্যাত লেখিকা যে কোন উন্নত দেশে মহাশান্তিতেই বসবাস করতে পারতেন।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য ক্লাসে চায়নিজ শিক্ষার্থীদের মাঝে মাঝেই এটা সেটা জিজ্ঞেস করার ফাঁকে তিয়ানানমেন স্কোয়ারের সবচেয়ে বড় ছাত্র আন্দোলনের ঘটনা কতটা জানে জিজ্ঞেস করেছিলাম। বিস্মিত এবং বিরক্ত হয়েছিলাম বেইজিংএ ১৯৮৯ সনের ২৭ শে এপ্রিলের সারা দেশের লাখো ছাত্রের গণতন্ত্রের দাবি, কয়েক মাসব্যাপী আন্দোলনে সহস্র হত্যাকাণ্ডের ম্যাসাকার সম্বন্ধে তারা কেউই তেমন কিছুই জানে না। বলাবাহুল্য, প্রথমত মনে হয়েছে এ কেমন উন্নাসিক প্রজন্ম যারা দেশের ইতিহাস, আন্দোলন, রাজনীতি সম্পর্কে কিছুই জানে না।

Advertisement

দ্বিতীয়ত, সন্দেহ হয়েছিল হয়তো তারা ঠিকই জানে, ভীনদেশে ততধিক ভীনদেশীকে দেশের অন্ধকার অধ্যায় জানতে দিতে চায় না। একদিকে কঠিন জাতীয়তাবোধ সম্পন্ন প্রজন্ম বা জাতি দেখে মিশ্র অনুভূতি হলো, অন্যদিকে শিক্ষককে দেশের ইতিহাস গোপন করার জন্য কপট মনে হলো। এর মধ্যে একান্ত বাধ্যগত এক ছাত্র সেই ঘটনার ভিডিও কোত্থেকে যোগাড় করে একদিন দেখাতে নিয়ে এলো। কিন্ত ক্লাশে অন্য চায়নিজ ছাত্রদের নিজস্ব ভাষায় ফিসফিসানি দেখে আমি তা দেখতে চাইলাম না। কিন্তু পরে শুনলাম আদতেই তাদের জানার কোন উপায় রাখা হয় না।

অবস্থা এমনি যে আমাদের দেশের পত্রিকা বা আন্তর্জাতিক মাধ্যমেও কোন অদ্ভুত খবর দেখে আমি তাদের জিজ্ঞেস করলে দেখতাম কেউ কেউ অসন্তুষ্ট হতো যে এহেন নেতিবাচক খবর কেন কেউ জানবে! জাপানিরাও সরকার বা রাজনীতি বিষয়ে নাক গলাতে দেখিনা। জিজ্ঞেস করলে শীতল জবাব দেবে যে ওটা রাজার কাজ, সরকারের কাজ। তার কাজ তার জীবিকা, সেটাই সে ভালোমত করতে চায়। কিন্তু চায়নিজদের অবস্থা দেখলাম আরো কয়েক কাঠি। তাদের জানার উপায় নেই, ইচ্ছাটাও যেন জন্মায়নি। কি অদ্ভুত মগজ ধোলাই!

মুসলিম অধ্যুষিত উইগুরস্থানের এক ছাত্র ছিল আমার। একেবারে পাকিস্তানি চেহারার। নাম দিলশাদ চ্যাং। তাকে পেয়ে আমার প্রশ্ন ফুরায় না। জানলাম হান জাতি (চায়নিজদের নৃতাত্বিক সত্তা) হিসেবে ম্যান্ডারিন ভাষায় উইগুরের বাইরে কথা বললেও এলাকায় উইগুর ভাষায় কথা বলে যা পারসী- আরবী স্ক্রিপ্টে লেখা তুর্কি ভাষারই এক প্রকরণ। জিজ্ঞেস করলাম রোজা পালন, নামাজ নিষিদ্ধ সত্যিই কিনা। সে জানালো চায়না সরকার ধর্ম পালনে সম্মতি দেয় না। তার মানে এই না যে রোজা রাখলে কোন শাস্তি আছে। কিন্তু রোজা পালনের জন্য দুর্বলতায় যদি কাজ কম হয় বা ছুটি চাওয়া হয়, বা ইফ্তার বা নামাজের আলাদা সময় চাওয়া হয় আইন অনুযায়ী, তা দেয়া হবে না। কিন্তু তার বাবা মা নিয়মিত রোজা পালন করেই অফিস করতেন, সে নিজেও নামাজ পড়েই ক্লাস যেতো। কখনো সমস্যা হয়নি এতে।

এভাবে ভেতর থেকে অনেক কিছুই জেনেছি ইনার মঙ্গোলিয়া, তিব্বতসহ বিভিন্ন এলাকার শিক্ষার্থীদের কাছে। এতো বড় এক দেশ, বৈচিত্র্যের সীমা নাই। নিজেরাই অনেক কিছু জানেনা নিজের এলাকা বা প্রভিন্সের বাইরে অন্য এলাকার। যেমন এক সন্তান নীতি ৮০র দশক থেকে চালু । কিন্তু ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য তা প্রযোজ্য না। আবার হান বংশোদ্ভূত হলেও সরকারকে ২য় সন্তানের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ অংক, ৩য় সন্তানের জন্য আরো বেশি অংক দিলেই সন্তান নেয়ার অনুমতি মিলবে। খাবারের ক্ষেত্রেও আমরা জানি ওরা সর্বভূক; কিন্তু সেটা উত্তরাঞ্চলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, সর্বত্র না। কাজেই চায়নিজ পেলেই ধুম করে এহেন প্রশ্ন করে বসলে তাদের মারমুখি ন্যাশনালিস্ট রূপও দেখতে হতে পারে।

লেখক : কলামিস্ট; প্রাক্তন রিসার্চ ফেলো, কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়; বিভাগীয় প্রধান, বিজনেস প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্ট, স্মার্ট সার্ভিস টেকনোলজিস কো. লিমিটেড, ফুকুওকা, জাপান।neeta2806@yahoo.com

এইচআর/আরআইপি