সৃজনশীল মানুষের ঘর বলতেই যেমন ঘরের ছবি ভেসে ওঠে জনপ্রিয় অভিনেতা, গল্প লেখক, চিত্রনাট্যকার এটিএম শামসুজ্জামানের ঘরটা ঠিক তেমন। চারদিক দেশি-বিদেশি বইয়ে ঠাসা। ঘরের দরজা দিয়ে ঢুকতেই নজর কাড়ে একটি অ্যাকুরিয়াম। আলো ভর্তি অ্যাকুরিয়ামে রঙিন মাছের খেলা। আর পুরো ঘরের মেঝেতেই কুশন পাতা। মন ভালো হয়ে যাওয়ার মতো একটা ঘর।
Advertisement
অতিথি পরায়ণ হাস্যোজ্জল মানুষটির সঙ্গে তার ঘরে বসেই আড্ডা হলো সোমবার দুপুরে। সত্তর পার হলেও মনে এখনও তারুণ্যের ছোঁয়া। তিনি কিংবদন্তি অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান। একুশে পদক জয়ী এ অভিনেতার সঙ্গে এক টুকরো সবুজ আড্ডার মাঝ থেকে উঠে আসা আলাপচারিতার চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো জাগো নিউজের পাঠকদের জন্য-
জাগো নিউজ : আপনার সঙ্গে অনেক দিন পরে দেখা হলো। এখন কেমন আছেন ?
এটিএম : ভালোই আছি। এই বয়সেও বেশ চলে ফিরে বেড়াচ্ছি তো।
Advertisement
জাগো নিউজ : এখন আপনার সময় কীভাবে কাটছে?
এটিএম : আমি তো সারা জীবন অভিনয় করে গেলাম। স্ক্রিপ্টও লিখি গল্প লিখি। এখন বর্তমানে নাটক করে বেড়াচ্ছি, ছবিও করছি। খুব ভালো ছবি না হলে করছি না। মোটামুটি স্টোরিটা যদি ভালো থাকে একটা কমিটমেন্ট থাকে তাহলে করছি। যে নাটকগুলো করছি এগুলো নাটকের মধ্যেই পড়ে না। ৫৪ বছর ধরে অভিনয় করছি। নাটক লিখেছি, চিত্রনাট্য লিখেছে। প্রায় ৫২টা গল্প লিখেছি। সেগুলো দেখি, পড়ি।
জাগো নিউজ : এখন কোন কোন নাটকে অভিনয় করছেন?
এটিএম : দুটি ধারাবাহিকে অভিনয় করছি। একটি সাজ্জাদ সুমনের ‘ছলে বলে কৌশলে’ ও অন্যটি রুলিন রহমানের ‘ভালোবাসা কারে কয়’। অনেক প্রস্তাব আসে। কিন্তু ওই যে গল্প ভালো হয় না, তাই ফিরিয়ে দিতে হয়। যেগুলো মন্দের ভালো সেগুলোতে অভিনয় করছি। বর্তমানে যে দুটো নাটকে অভিনয় করছি দুটোর গল্পই ভালো, নির্মাতাও ভালো। ‘নোয়াশাল’ নামের একটি ধারাবাহিকে অভিনয় করছিলাম, ছেড়ে দিয়েছি। ওইটার আর ধারাবাহিকতা নেই, গল্পেরও জোর বলে কিছু নেই। বিরক্তি লেগে গেল তাই ছেড়ে দিলাম।’
Advertisement
জাগো নিউজ : অনেকেই বলছেন বয়সের কারণে কমিয়ে দিয়েছেন অভিনয়। বয়স কী একটু প্রভাব ফেলেনি?
এটিএম : আমার মনে হয় না। অভিনয় বয়সের ধার ধারে না। অভিনয় তার নিজস্ব গতিতে চলে। বয়সও তার নিজস্ব গতিতে চলে। যে চরিত্র আমাকে দিয়ে করানো দরকার। আমি মনে করি চরিত্রটা আমাকে মানাবে। তাহলে আমি সে চরিত্রে অভিনয় করি। আসলে, আমার শরীরের চেয়েও বেশি খারাপ এখনকার নাটক-সিনেমার গল্প। তাই অভিনয়ে অনিয়মিত। শরীর খারাপ বলে কাজ করছি না ব্যাপারটি তা নয়। আমি কাজ করে আনন্দ পাই। এ মাসে সাইদ তারেকের একটি ধারাবাহিকে কাজ করার কথা চলছে। নাম ‘লাইফ পার্টনার ডটকম’। স্ক্রিপ্ট পড়ছি। ভালো লাগলে অভিনয় করবো। কিন্তু ভালো না লাগলে কারো মন রক্ষার্থে আর করবো না।’
জাগো নিউজ : কিছু দিন আগে আপনার চোখের একটা অপারেশন হয়েছিল। চোখের এখন অবস্থা কী?
এটিএম : সেটা অতটা সফল হয়নি। এখন দেখতে পাচ্ছি এটাই অনেক কিছু।
জাগো নিউজ : সর্বশেষ কোনো সিনেমায় অভিনয় করেছেন?
এটিএম : পাংকু জামাই নামের একটা ছবিতে শেষ অভিনয় করেছি। শাকিব খান ও অপুও অভিনয় করেছে ছবিটিতে। মুক্তির অপেক্ষায় আছে ছবিটি। আরও ছবিতে অভিনয় করতে চাই। এখন নতুন ছেলেরাও ভালো সিনেমা বানাচ্ছে। কেউ যদি ভালো গল্প নিয়ে আসে। আমি যদি মনে করি ছবিটি আমার করা উচিৎ তাহলে অভিনয় করেবো।
জাগো নিউজ : একটু প্রসঙ্গ পাল্টাই। বর্তমাতে যৌথ প্রযোজনার ছবি নির্মাণ হচ্ছে অনেক। আপনাকে অনেক আগে পাওয়া গেছে যৌথ প্রযোজনার ছবিতে। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে যৌথ প্রযোজনা নিয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।
এটিএম : এটার সুফল ছাড়া কোনো কুফল নাই। ভালোই হচ্ছে। আমাদের ছেলে মেয়েরা ওদের ছবিতে কাজ করছে। ওরা আমাদের এখানে কাজ করছে। এটা তো ভালো দিক। এটা নিয়ে যারা বিতর্ক সৃষ্টি করে তাদের নিয়ে আমার কিছু বলার নাই। এটা বুঝা উচিৎ বাংলাদের শিল্পীদের ভারতের শিল্পীরা এক সময় কোনো পাত্তাই দিতো না। এখন আমাদের ছেলেরা ওখানে গিয়ে একটা জায়গা করে নিয়েছে। যেমন জয়া আহসান। সে ওখানে গিয়ে একটা বিরাট জায়গা দখল করেছে। শোনতেই ভালো লাগে। আগে ফেরদৌস ছিলো বেশ ভালো প্রভাব নিয়ে। এগুলো আমাদের জন্য একটা বিরাট ব্যাপার। কাজেই জয়েন্ট ভেঞ্চার নিয়ে কথা বলার কোনো দরকার নাই। তোরাও পারবি না ওদেরও করতে দিবি না এটা হয় না। যদি নিয়মে সমস্যা থাকে তবে সেগুলো নিয়ে কথা বলে ঠিক করে নাও। কিন্তু আমি পারি না বলে হিংসায় অন্যকে আটকে রাখার মানসিকতা ভালো নয়।
জাগো নিউজ : হল মালিকরা অভিযোগ করেন আমাদের এখানে ব্যবসা সফল ছবি কম হয়। আপনি কি মনে করেন?
এটিএম : সে আর নতুন কী। অনেকদিন ধরেই শুনছি। কিন্তু এর উত্তরণে কারো আগ্রহ ও মাথা ব্যাথা দেখি না। সবাই আছে নিজেকে জাহির করার চিন্তায়। নিজে ভালো থাকতে পারলেই সব ভালো। কিন্তু সিনেমা এমনটা ছিলো না। আমরা চেষ্টা করতাম সবাই মিলে ভালো থাকার। গল্পে জোর দিতে হবে ব্যবসা সফল সিনেমার জন্য। আমার লেখা ‘মোল্লা বাড়ির বউ’ বাংলাদেশের এমন কোনো দর্শক নাই ১৭ থেকে ১৮ বার দেখেনি। কোটি কোটি টাকার ব্যাবসা করেছে। আসলে গল্প হচ্ছে প্রধান। এরপর গল্প অনুযায়ী চরিত্র নির্বাচন, তারপরে একজন পরিচালকের মুন্সিয়ানা। এগুলো সব যদি এক সাথে হয় তাহলে দর্শককে ছবি দেখতেই হবে।
ছবি তিন প্রকার। কমার্শিয়াল, প্যারালাল মুভি ও ক্লাসিক মুভি। আমরা কমার্শিয়াল ও প্যারালাল মুভি বানাতে পারি। আমাদের এখানে কোনো ক্লাসিক মুভি হয় না। যেটা হয়েছে সেটা প্যারালাল মুভি। প্যারালাল মুভির জনক হচ্ছেন শ্যাম বেনেগাল। ভারতে প্যারালাল মুভির জন্ম দিয়েছেন তাদের মতো নির্মাতারা। সেই মুভিগুলোকে আমরা যদি অনুসরণ করি আমাদের চলচ্চিত্র আরও এগিয়ে যাবে।
জাগো নিউজ : আর ক্লাসিক মুভি নিয়ে আপনার অভিমত.....
এটিএম : ক্লাসিক মুভি করতে হলে তিন পুরুষের দরকার। যেমন সত্যজিৎ রায়। তার বাবা সুকুমার রায়। সুকুমারের বাবা উপেন্দ্র কিশোর রায়। উপেন্দ্র ‘দত্যি দানো’র গল্প লিখতেন। এর ভিতরে জীবন দিলেন সুকমার রায়। ছড়ার মধ্যে এই জীবনকে তিনি বিশ্লেষণ করলেন। এর পরে সত্যজিৎ রায় এলেন। যার ডাক নাম মানিক। ইনি চলচ্চিত্রে এসে ধ্রুপদ চলচ্চিত্রের প্রমাণ দিলেন ‘পথের প্যাঁচালি’ নির্মাণ করে।
জানা দরকার ধ্রুপদ চলচ্চিত্র কেমন হয়? ‘পথের প্যাঁচালি’-কে বলা হলো হিউম্যান ডকুমেন্টেশন। কাজেই এর পরে ঋত্বিক ঘটক যেগুলো বানালেন এগুলো একটাও ধ্রুপদ চলচ্চিত্র হয়নি। এগুলো সব প্যারালাল চলচ্চিত্র। আমার একটা জিনিস ভালো লাগে। আমাদের বাবারা ছিলেন মৌলভী। সেই গর্ব নিয়েই দেশভাগ করেছিলো আমাদের বাবারা। তাদের ছেলে হয়ে আমরা এখন লেখক, পরিচালক, গল্পকার, অভিনেতা। আমরা এক পুরুষ। ক্লাসিক মুভি হতে হলে তিন পুরুষ লাগে। আমরা মৌলভীর ছেলে হয়ে এত দূর এগোতে পেরেছি এতেই আমি খুশি। সামনে আরও ভালো দিন আসবে। সময় তো দিতেই হবে।
জাগো নিউজ : কিন্তু আমাদের দেশে অনেক তারকার ছেলে মেয়েরাই মিডিয়াতে আসেন না। তবে কীভাবে তিন পুরুষের বিকাশটা ঘটবে বলে মনে করেন?
এটিএম : তারকার সন্তানকেই আসতে হবে এমন কথা নেই। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মগুলোই আমাদের উত্তর পুরুষ হবে। আগে মিডিয়াতে আসতে চাইতেন না অনেকেই এখন কিন্তু মিডিয়ায় আগ্রহীদের সংখ্যা বেশি। মিডিয়া নিয়ে পড়াশোনাও হচ্ছে। আমাদের প্রজন্মই শেখাচ্ছে। সেখান থেকে যারা আসবে তারা তো আমাদেরই প্রতিনিধি হবে। আর তারকাদের ছেলেমেয়েরা আসছে না সেটাতেও আমি একমত নই। আমজাদ হোসেনের ছেলে সোহেল আরমান, সোহেল রানার ছেলে ইয়ুল রাইহান, দিলিপ বিশ্বাসের ছেলে দেবাশীষ এমন বেশ কজনকেই সেকেন্ড জেনারেশন পেয়েছি আমরা। এটা কিন্তু ভালো ব্যাপার। আলী যাকেরের ছেলে কাজ করছে। অনেক আছে। ওরাই একটা ধাক্কা দিতে পারবে বলে বিশ্বাস করি।
জাগো নিউজ : এবার ফিরবো আপনার ঘরে। রোজ সকাল থেকে সন্ধ্যা- কীভাবে কাটে আপনার?
এটিএম : নানা রকম বিষয়ে আমি সারাটা জীবন পড়াশুনা করেছি। ক্লাস সেভেন থেকে আমার পড়ার শুরু। আজও পড়ার অভ্যেসটা আছে। একটা দিনও আমার পড়াশুনা ছাড়া কাটে না। অবসর সময়ে বিশ্বের নামি দামি ক্ল্যাসিক মুভি দেখি। বোঝার চেষ্টা করি। গল্পে বিভিন্ন দিক লক্ষ করি। বাঁক। এগুলো নিয়ে ভাবি।
জাগো নিউজ : অনেক সময় পার করেছেন শিল্প সংস্কৃতির সাথে। ইচ্ছে ছিল কিন্তু করা হয়নি এমন কিছু কি আছে?
এটিএম : একজন মানুষ প্রতিদিন ভাত খায়, সে কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে অমুক দিন ভাত খেয়ে সব চেয়ে বেশি শান্তি পেয়েছিলাম। তেমনি একজন শিল্পী, লেখক, পরিচালকের ক্ষেত্রে একই কথা। সে সারা জীবন তার কাজে ব্যস্ত থাকে এবং কাজটি করার পরে সে বলে এটা হয়নি। আরও ভালো পারি আমি। তার কাজের আকাঙ্খা আরও বেড়ে যায়। যেইদিন কোনো শিল্পী তার কাজের প্রতি সন্তুষ্ট হবে সেইদিনই তার ভালো কাজের শেষ দিন। সৃষ্টিশীল মানুষ চিরকাল অতৃপ্ত থাকে। আমার খুব মনে হয়, আজ পর্যন্ত আমাকে দিয়ে সেরা অভিনয়টা কেউ করাতে পারেনি। আমি আরও ভালো অভিনয় করতে পারতাম। আরও অনেক ভালো চরিত্র আমার প্রয়োজন ছিলো। এখনো অনেক কিছু করা যায়। কিন্তু গল্পকার-নির্মাতারা আমাদের নিয়ে ভাবেন না। তারা একটা ফ্রেম পেয়েছে ভালোবাসার, সেখানেই আটকে আছে। সত্তর বছর বয়সেও যে নান্দনিক ভালোবাসার গল্প থাকতে পারে সেটা মাথাতেই নেয় না ওরা। যখন নিজেরা বুড়া হবে তখন হয়তো নেবে, কিন্তু তখন বয়স ওদেরকে কাজের শক্তি দেবে না।
জাগো নিউজ : অনেক কিছ শেখা হলো আজ আপনার পাশে বসে। বর্তমানে যারা অভিনয় করছে সামনে যারা আসবে তাদের প্রতি আপনার পরামর্শ কী?
এটিএম : আমি তো নতুনদের প্রতি সব সময় দুর্বল। তারা যে ছবিগুলো বানাচ্ছে চিন্তার দিক থেকে তারা অনেক সমৃদ্ধ। এরা চলচ্চিত্রকে একটা জায়গাতে নিয়ে যাচ্ছে। তারা আরও ভালো করবে। এজন্য ব্যতিক্রমী ভাবনা, আবিষ্কারের নেশা, খ্যাতির চেয়ে অমরত্বের ভাবনাটা বেশি দরকার। খ্যাতি টিকে থাকে না। সত্যজিৎ, ঋত্বিক, দিলীপ বিশ্বাসরা টিকে গেছেন।
জাগো নিউজ : জীবনের এই সময়টাতে এসে কী চান, কী আশা করেন?
এটিএম : জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কাজ করে যেতে চাই। এবং অবশ্যই সেটা ভালো কাজ।
এমএবি/এলএ/আরআইপি