ফিচার

দাঁতের মাজনে বসন্তদিন!

তখন বসন্ত, আমরা দাঁত মাজি ছাই দিয়ে। ভেবেছিলাম বসন্ত নিয়ে কিছু একটা লিখবো। শুরু করতে গিয়ে দেখি, দাঁত মাজার ছাই চলে এসেছে। কী আর করা। দাঁত মাজার ছাইয়ের সঙ্গে বসন্তের নিশ্চয়ই কোনো সম্পর্ক আছে। না হলে ছাই আসার কথা নয়। এসেছে যখন, দেখাই যাক কী হয়!

Advertisement

সেকালে আমরা ব্রাশ চিনি না। আঠাইল্লা গাছের ডালই ভরসা। সেও আবার বড়দের জন্য। ছোটদের বেলায় চুলার ছাই। আমরা কাকভোরে ঘুমঘুম চোখে উঠে গিয়ে মাটির চুলার পাশে বসি। তারপর চুলার ভেতরের অংশে আঙুল ঢুকিয়ে তার মাথায় ছাই মাখিয়ে দাঁত মাজি! পুকুরে গিয়ে কুলি করে দৌড়! অপেক্ষায় মক্তব আর সালাম হুজুর!

তখন শীত প্রায় শেষ। কিংবা এখনও আছে। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে বাইরে তাকালেই চোখে আগুন লেগে যায়। সবচেয়ে বেশি লাগে দুপুর বেলায়। যেদিকেই তাকাই, আকাশজুড়ে আগুন, দিগন্তজুড়ে আগুন। খালি আগুন, আগুন আর আগুন। সেই আগুন দেখলে বুকের ভেতর কেমন জানি মুহূর্তেই রক্ত ছলকে ওঠে। দমবন্ধ লাগে। মনে হয়, ইস! এতো রঙ! এতো!

সেই রং শিমুলের। আমার সাধ্য নেই তার রূপ বোঝাই। গ্রামের পথ, ঘাট, মাঠ, জমির আলপথভর্তি শিমুল গাছ। অসংখ্য শিমুল গাছ। সেইসব শিমুল গাছ স্পর্ধায় মাথা উঁচু করে থাকে, বিস্তৃত থাকে ভালোবাসা নিয়ে। আমার সত্যি সাধ্য নেই তা বোঝানোর, সম্ভবত শব্দেরও নেই। কেবল মনে হতো, রূপকথার কোনো অবাক দেশ। অপার্থিব ‘পৃথিবী’! অদ্ভুত স্বপ্ন। এই স্বপ্ন না ভাঙুক। না ভাঙুক-

Advertisement

‘এই ঘোরের ভেতর ডুবে যাওয়া চারপাশ এমনই থাকুক।বুকের ভেতর ছুঁতেই থাকুক, কি জানি কি! কি জানি কি!!’

আম্মা অবশ্য সেই ভোরবেলা আমাদের হাতে প্ল্যাস্টিকের বস্তা ধরিয়ে দিয়ে বলতেন, ‘যাও বাজান, হিমিলের ফুল নিয়াও।’ হিমিল মানে শিমুল। আমরা পাড়া ঘুরে ঘুরে হিমিলের ফুল কুড়াতাম। সেই ফুল বস্তায় ভরে নিয়ে বাড়ি ফিরতাম দুপুরে। ঝকঝকে নিকানো উঠোনের একপ্রান্তে গনগনে রোদে সেই ফুল শুকাতে দিতেন আম্মা। এক, দুই, তিন দিন। সপ্তাহখানেক। ফুলগুলো শুকিয়ে শুকিয়ে কালো হয়ে যেত। কড়করে শক্ত কটকটির মতো। কোনো এক সন্ধ্যায় সেই কড়কড়ে হিমিল ফুল চুলার ভেতর জ্বালানী বানিয়ে ভাত রান্না করতেন আম্মা।

ঘটনা এখানেই শেষ নয়। শুরু। রান্না শেষে চুলার ভেতর থেকে যত্ন করে হিমিল ফুলের পুড়ে যাওয়া ছাইগুলো বের করে শুরু হতো পাঁটা-পুঁতায় পেষা। পিষে পিষে মিহি করে ফেলা ছাইয়ের সাথে মিশিয়ে দিতেন সুগন্ধি কর্পূর! সেই সুগন্ধি কর্পূরে মেশা শিমুল ফুলের ছাই যত্ন করে ভরে রাখতেন কাঁচের বোতলে। বোতলের গলায় সুতো দিয়ে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখতেন ঘরের বারান্দায় বাঁশের চৌকাঠের সঙ্গে।

আমরা পরদিন আবার ঘুমঘুম চোখে কাকভোরে ঘর থেকে বের হই। তারপর সেই শিমুল ফুলের ছাইয়ের বোতলের ভেতর থেকে কর্পূরের আবেশি গন্ধ মাখা দাঁতের মাজন হাতের তালুতে নিয়ে জিহ্বার ডগা ছোঁয়াই। আহ! অদ্ভুত আবেশে যেন বন্ধ হয়ে আসে চোখ।

Advertisement

আঙুলের ডগায় ছাই নিয়ে দাঁত মাজি। আর পুকুরের জলের স্বচ্ছ আয়নায় ঠোঁট ফাঁক করে দেখি, ঝকঝকে দাঁত! চকচকে দাঁত! সেই দাঁত আঙুলে ঘঁষে দিলে ছস্প্লাশ ছস্প্লাশ শব্দ হয়! সেই শব্দ পৃথিবীর আর সকল শব্দের চেয়ে মধুর।

কিন্তু দিন সাতেক বাদেই সেই সকাল, সেই কর্পূরের গন্ধ মাখা দাঁতের মাজন, সেই পুকুরের স্বচ্ছ জলের আয়নায় ঝকঝকে দাঁত, দাঁতের ছস্প্লাশ ছস্প্লাশ শব্দ সবকিছুই কেমন বিবর্ণ লাগে। কারণ, আকাশের আগুনগুলো ফুরিয়ে এসেছে, দিগন্তের রংগুলোও। ইস! হিমিল ফুলের মৌসুম শেষ! আমাদের বুকের ভেতর সেই রূপকথার কোনো এক দেশ, অপার্থিব কোনো এক ‘পৃথিবী’, সেই অদ্ভুত স্বপ্নগুলো কেমন ফিকে হয়ে মন খারাপের কান্না নিয়ে আসে!

দাঁতের মাজন দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে শিমুল ফুলের গাছগুলোর দিকে তাকালেই বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠে। কী বিষণ্ন চারপাশ! কী কান্না! চুপচাপ সেই পুকুরপারের ঘাসে বসে শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকতাম। শিমুল ফুলের গাছগুলোর সেই অপার্থিব আগুনরঙা ফুলগুলো ধীরে ধীরে ফল হয়ে উঠছে। তার ভাঁজে ভাঁজে জেগে উঠছে শিমুল তুলো। তুলোগুলো ভেসে যাচ্ছে বাতাসে বাতাসে।

আমারও হঠাৎ শিমুল ফুলের তুলোর মতন বাতাসে বাতাসে ভেসে যেতে ইচ্ছে হয়! ভেসে ভেসে ফিরে যেতে ইচ্ছে হয় আরেক বসন্তে! আবার বসন্তে! আগুনলাগা অপার্থিব বসন্তে! অদ্ভুত ঘোরের মতন রূপকথা সেই বসন্তে!

আমি কাঙালের মতন তৃষ্ণার্ত চোখে তাকিয়ে থাকি, বুকের ভেতর হু-হু করে ওঠে বসন্তের মন কেমন করা মাদক বাতাস। অচিনপুরের কান্না। আমি শিমুল ফুলের অপেক্ষায় থাকি। অপেক্ষায় থাকি বসন্তের। কিন্তু আমার হাতের ভেতর কর্পূরের গন্ধওয়ালা শিমুল ফুলের পুড়ে যাওয়া ছাইগুলো গন্ধ ছড়ায়!

আমার কান্না পায়, বসন্ত কবে আসবে? কবে?

এসইউ/এমএস