সবার জানা সব কলকাঠি তার হাতেই। ‘হেড কোচের ’ পদবিটাই শুধু গায়ে লেখা নেই। তার বদলে লেখা, ‘টেকনিক্যাল ডিরেক্টর।’ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে হেড কোচের দায়িত্ব থেকে সরে শ্রীলঙ্কার কোচ হবার পর পদবি বা পরিচয়টা হেড কোচের না হলেও আসলে হাথুরুর জায়গায় এখন খালেদ মাহমুদ সুজনই। তিনিই টিম বাংলাদেশের মূল কোচ।
Advertisement
তিন জাতি টুর্নামেন্ট এবং শ্রীলঙ্কার সাথে টেস্ট এবং ওয়ানডে সিরিজে গেম প্ল্যান আঁটা ও টিম কম্বিনেশন ঠিক করার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অগ্রনী ভুমিকায়। লক্ষ্য-পরিকল্পনা ও কৌশল নির্ধারণটা তারই করা। তার কোচিংয়ের শুরুটাও ছিল দারুণ।
ত্রিদেশীয় সিরিজে জিম্বাবুয়ে ও শ্রীলঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়ে উদ্ভাসিত সূচনা। এরপর ‘তীরে এসে তরি ডোবার মত’- রাউন্ড রবিন লিগের শেষ ম্যাচ ও ফাইনালে লঙ্কানদের কাছে শোচনীয় পরাজয়। চট্টগ্রাম টেস্টের প্রথম ইনিংসে অনেক মজবুত ভিতের ওপর দাঁড়িয়েও চান্দিমালের দলকে বিপাকে ফেলার সুযোগ হাতছাড়া করে উল্টো নিজেরা চাপে পড়ে যাওয়া এবং শেষ পর্যন্ত মুমিনুল আর লিটন দাসের প্রাণপন লড়াইয়ে ম্যাচ বাঁচানো। আর মিরপুরের শেরে বাংলায় শেষ টেস্টে স্পিনিং ট্র্যাকে চরম ভরাডুবি- এসব ব্যর্থতা ও করুন পরিণতির বড় দায় খুব স্বাভাবিকভাবেই এসে বর্তেছে খালেদ মাহমুদ সুজনের ঘাড়ে।
সমালোচকরা নড়ে-চড়ে বসেছেন। কেউ কেউ তার ঘাড়েই ব্যর্থতার সব দায় দায়িত্ব অর্পনের চেষ্টায় ব্যস্ত। কেউ কেউ এমন কথাও বলছেন, হাথুরুসিংহে কোচ থাকলে এতটা বাজে ফল ও পরিণতি হতো না। খালেদ মাহমুদ সুজন দলকে সেভাবে তৈরিই করতে পারেননি। তার লক্ষ্য-পরিকল্পনা আর গেম প্ল্যান সফল হয়নি।
Advertisement
সবচেয়ে বেশি কথা হচ্ছে শেরে বাংলার উইকেট নিয়ে। এই ধরনের স্পিন বান্ধব উইকেটে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে খেলা নিয়ে রাজ্যের কথা-বার্তা। সবার ধারনা, ওই পিচে খেলা বুমেরাং হয়েছে। স্পিন সহায়ক পিচে অনভ্যস্ত ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়াকে হারানো গেলেও সারা বছর প্রায় এই ধরনের পিচে খেলে হাত পাকানো লঙ্কানদের সাথে স্পিনিং ট্র্যাকে খেলার চিন্তা ছিল রীতিমত অদুরদর্শিতার নামান্তর। তারকা খ্যাতি আর নাম-ডাকে ইংলিশ ও অস্ট্রেলিয়ানদের চেয়ে পিছিয়ে থাকলেও লঙ্কানরা টার্নিং উইকেটে অনেক অনেক ভাল দল। এ ধরনের উইকেটে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে অনেক কঠিন ও শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একটা অংশে সমালোচনার ঝড়। টি-টোয়েন্টি সিরিজ শুরুর ৭২ ঘন্টা আগে খালেদ মাহমুদ সুজনের কাছে মিডিয়ার প্রশ্ন, ‘আচ্ছা এ ব্যর্থতার কারণ কি?’ আজ বিকেলে শেরে বাংলায় টাইগারদের প্র্যাকটিস চলাকালিন উপস্থিত সাংবাদিকদের সাথে আলাপে খালেদ মাহমুদ সুজন এর জবাবে যা বললেন, তার সারমর্ম হলো- লক্ষ্য-পরিকল্পনা ও কৌশল নির্ধারনে সমস্যা ছিল না। সেগুলো ঠিকই ছিল। পরিকল্পনার সঠিক ও যথাযথ বাস্তব প্রয়োগ ঘটেনি। আর মূল কথা হলো ক্রিকেটাররা চাপ সহ্য করতে পারেনি। চাপে ভেঙ্গে পড়েছে প্রতিরোধের দেয়াল।
তাইতো মুখে এমন কথা, ‘যে রকম আশা করছিলাম, সেটা তো হয়ইনি। হয়তো বা টেস্ট সিরিজটা আমরা জিততে পারতাম। সেটাও হয়নি। আমরা যে রকম পরিকল্পনা করেছিলাম, যেটা কাজে লাগাতে চেয়েছিলাম, সেটা ঠিকঠাক হয়নি। সবচেয়ে বড় জিনিস আমরা চাপটা নিতে পারিনি ।’
উইকেট নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। যে উইকেটে খেলা হয়েছে, সেটা কি টাইগারদের অনুকুল ছিল? এ পিচে শ্রীলঙ্কাকে হারানো সম্ভব ছিল কি? এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে খালেদ মাহমুদ অনেক কথাই বলেন। তবে তার কিছুতেই মনে হয় না, উইকেট শতভাগ বৈরি ছিল। বরং তার বদ্ধমূল ধারনা ও স্থির বিশ্বাস উইকেট আসলে কোন বাধা ছিল না। ক্যাচ ড্রপ এবং সময়ের দাবি মেটাতে পারলে ম্যাচের ফল অন্যরকম হতে পারতো।
Advertisement
ম্যাচের পর্যালোচনা করতে গিয়ে সুজন বলে ওঠেন, ‘আমি কখনোই মনে করি না উইকেটের জন্য আমরা হেরেছি। যদি উইকেটকে দোষ দিতে হয়, তাহলে আমাদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। আমরা পারিনি কিছু কারণে। প্রথমতঃ আমরা ভাইটাল সময়য়ে ক্যাচ ড্রপ করেছি। প্রথমে ইনিংসে শ্রীলঙ্কার রান যখন ৬ উইকেটে ১১০, তখন ক্যাচ হাতছাড়া হয়েছে। তা না হলে শ্রীলঙ্কাকে ১৪০ রানে অলআউট করতে পারতাম। সেটা হতো তাদের প্রথম ইনিংসের তুলনায় ৭০ থেকে ৮০ রান কম।’
খালেদ মাহমুদ সুজন বোঝাতে চেয়েছেন, প্রথম ইনিংসে ১০০‘র বেশি রানে পিছিয়ে না থাকলেই হয়ত খেলার চালচিত্র ভিন্ন হতে পারতো। এরপর ফর্মের তুঙ্গে থাকা এবং প্রায় ওয়েল সেট মুমিনুলের রান আউটকেও একটা বড় টার্নিং পয়েন্ট মনে করেন সুজন। প্রতিষ্ঠিত ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতার বিপরিতে দু দলের বোলারদের বিশেষ করে দিলরুয়ান পেরেরা, আকিলা, লাকমাল বা ও মিরাজের ব্যাটিংয়ের প্রশংসা করে সুজন বলেন, ‘দেখেন তারা তো সবাই বোলার। তারপরও রান করেছে। আমার মনে হয় আমাদের ব্যাটসম্যানদের কথা যদি বলি আমরা আমাদের কাজটা করতে পারিনি। প্রথম ও শেষ কথা হলো আমরা ভালো খেলিনি। আমাদের মধ্যে উইকেট নিয়ে ভয় বা নেতিবাচক চিন্তা যেটাই হোক, তাদের মধ্যে কাজ করেছে। উইকেট একটা অজুহাত মাত্র। বোলিং-ব্যাটিংয়ে আমরা ভালো করতে পারিনি। ক্রিকেটটাই আমরা ভালো খেলতে পারিনি।’
খালেদ মাহমুদ সুজন মনে করেন, এই উইকেটেই তো নাথান লায়নের মত বোলারের বিপক্ষে খেলেছে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। তার চেয়ে তো অন্যরা বড় স্পিনার হতে পারে না। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের উইকেট দেয়ার ধরণের দিকে তাকাতে বললেন। সবশেষে জানালেন, উইকেটের দোষ দিয়ে লাভ নেই, ক্রিকেটাররাই ভালো খেলতে পারেনি।
সুজন বলেন, ‘প্রতিদিন সূর্য ওঠে। আমি হতাশ হলেও হতাশ নই! আমার প্রত্যাশা অনেক বেশি ছিল। আমি বিশ্বাস করছিলাম এই দলটা নিয়ে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজ জেতা সম্ভব। তিন সংস্করণেই চিন্তা করেছিলাম সিরিজ জিতব। খুব আনলাকি সাকিবকে মিস করেছি ফাইনালে। টেস্টেও ছিল না...। টি-টোয়েন্টিতেও হয়তো নেই। সে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সাকিব থাকলে দুই জায়গায় কাজটা সহজ হয়ে যায়। এটা কোনো অজুহাত নয়। বাকিদের সামর্থ্য আছে। আমরা চাপটা নিতে পারেনি। ওয়ানডেতেও উইকেট নিয়ে কথা উঠেছে। (ফাইনালে) ২২০ করতে মনে হয় না উইকেট লাগে। আমরা পারিনি। টেস্টে অনেকে বলছে ঘূর্ণি উইকেটে খেলেছি কেন। ভুলে গেছি আমরা বিশ্বমানের স্পিনার লায়নের বিপক্ষে খেলেছি। প্রথম ইনিংসে দেখেন, শুরুতে লাকমল উইকেট তুলে নিয়েছে, কোনো স্পিনার নেয়নি। কোন বল আউট হয়েছে, ওদের টেল এন্ডারদের ব্যাটিং, মিরাজের ব্যাটিং- ময়নাতদন্ত করলে অনেক কিছু বের হবে। সেটা বের করতেও চাই না। উইকেটকে দোষ দেওয়ার কিছু নেই। সবচেয়ে বড় কথা আমরা ভালো খেলতে পারিনি।’
উইকেট যে এমন হবে, তা ১৫-২০দিন আগে থেকেই সবার জানা ছিল। বাংলাদেশ সেভাবে প্রস্তুতিও নিয়েছে; কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হলো, খেলোয়াড়রাই ভালো খেলেনি। খালেদ মাহমুদ সুজন বলেন, ‘উইকেট যে এমন হবে এটা ১৫-২০ দিন আগে থেকে সবাই জানে। এই ইনফরমেশন ছিল সবার কাছে যে আমরা এই উইকেটে যাচ্ছি। তবে আমরা আনলাকিলি যে চিটাগংয়ে এই উইকেট হওয়ার কথা ছিল, হয় নাই। সেটা যে কারণেই হোক, হয় নাই। তারপরে ঢাকায় হয়েছে সেটা আমরা জানতান যে, হবে। অস্ট্রেলিয়ার সাথে টার্নিং উইকেটে খেলা যাবে কেন শ্রীলংকা কি গড? এমন কি আছে শ্রীলঙ্কার সাথে আমরা খেলতে পারবো না? ব্যাটিং লাইনআপ যদি দেখেন- কুশল মেন্ডিস, ধনণঞ্জয়, এরা কে কয়টা টেস্ট ম্যাচ খেলেছে? আমাদের স্ট্রেংথ তাদের স্ট্রেংথ (তুলনা করুন)। আমাদের স্পিনার নেই। বলতে পারেন আমাদের সাকিব নেই। আমাদের রাজ্জাক ৫০০ উইকেট পাওয়া ফার্স্ট ক্লাস বোলার। কিভাবে বলবো অভিজ্ঞতা নেই? তাইজুলকে যদি দেখেন- আকিলা ফার্স্ট টেস্ট ম্যাচ খেলে ৫ উইকেট নিলো। তাইজুলতো আরও বেশি খেলছে। মিরাজ ইংল্যান্ডের সাথে ১৯ উইকেট নিয়েছে। আমরা কিভাবে বলবো আমাদের অভিজ্ঞতা নেই! আমার কথা হলো আমরা কেউ এই জিনিসগুলো চিন্তা করি না। আমরা বলি শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আমাদের উচিত হয়েছে কী না (এমন উইকেট বানানো)। কেন হবে না? শ্রীলঙাকা কি গড? ওদের প্লেয়াররা কি গড? ওরা কি স্টিভ (স্টিভেন) স্মিথ? বা এরকম কিছু যে ২শ টেস্ট ম্যাচ খেলা প্লেয়ার। কেন এগুলো চিন্তা করি না যে, আমাদেরে প্লেয়াররাই ভুল খেলেছে?’
এআরবি/আইএইচএস/আরআইপি