বিশেষ প্রতিবেদন

এ বছরই ৫০ গডফাদার গ্রেফতার

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর মাদক নির্মূলে বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান। অপ্রতুল জনবল, সাধারণ মানুষ ও অন্যান্য বাহিনীর অসহযোগিতা ও সমন্বয়হীনতার কারণে মাদক নির্মূলে বিশেষ এ প্রতিষ্ঠান এখনও সফলতার মুখ দেখতে পারেনি।

Advertisement

প্রতিষ্ঠানটির কাঠামোগত অসক্ষমতার কারণে অনেকে প্রতিষ্ঠানটিকে 'ঢাল নেই তলোয়ার নেই, নিধিরাম সরদার' বলেও কটাক্ষ করেন। তবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ জামাল উদ্দীন আহমেদ বলেন, প্রতিষ্ঠান হিসেবে সক্ষমতা অর্জন আগে জরুরি। সেটা সম্ভব হলে আদর্শ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা সম্ভব। এ বছরই ৫০ গডফাদারকে গ্রেফতারের কথা জানান তিনি।  

সম্প্রতি জাগো নিউজ'র মুখোমুখি হয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরকে আদর্শ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তিনি। তুলে ধরেন মাদকের ভয়াবহতা, মাদক ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্যের কথা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জসীম উদ্দীন।

জাগো নিউজ : মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কার্যক্রম নিয়ে জনমনে ও সংসদে সমালোচনা হচ্ছে? অধিদফতর কি মাদক নির্মূলে অক্ষম?

Advertisement

জামাল উদ্দীন আহমেদ : মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ওপর মানুষের প্রত্যাশা বেশি। চাপও বেশি। কিন্তু সে চাপ কিংবা প্রত্যাশা পূরণের বাস্তবতা সচেতন মহল হয়তো জানে না। আমরা প্রত্যাশা পূরণে সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছি। সম্প্রতি আমাদের অভিযান ও মাদক উদ্ধারের তৎপরতা নিশ্চয়ই সবার দৃষ্টিগোচর হয়েছে। আমাদের পক্ষ থেকে চেষ্টার কমতি নেই।

আমাদের বড় সমস্যা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অপারেশনাল কর্মকর্তার কারো অস্ত্র নেই। অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতিও নেই। এ অবস্থায় অভিযান পরিচালনা করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। সময় এসেছে বিষয়টি নিয়ে ভাবার। মাদকের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে গেলে অভিযানে অংশ নেয়া কর্মকর্তাদের অস্ত্র থাকা জরুরি। বিষয়টি আমরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। জাগো নিউজ : অধিদফতরের কাজের পরিধির তুলনায় জনবল কী আপনার কাছে পর্যাপ্ত মনে হয়?

জামাল উদ্দীন আহমেদ : আমাদের কাজের পরিধি দেশব্যাপী। পর্যাপ্ত কাজের পরিধি থাকলেও নেই পর্যাপ্ত জনবল। সারাদেশে আমাদের জনবলের সংখ্যা মাত্র এক হাজার ৭০৬। তাদের মধ্যে ১১৯১ জন সক্রিয়। আবার অপারেশনাল কর্মকর্তার সংখ্যাও কম। যানবাহন আরও কম। মাত্র ৫১টি। অস্ত্রধারী মাদকসেবী কিংবা মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চালানোর মতো অবস্থা নেই বললেই চলে।

আমরা আট হাজার ৫০৫ জনবল চেয়েছি। যানবাহন চেয়েছি আরও ৫০টি। আশা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যে এসব পেয়ে যাব। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আন্তরিক। এসব পেলে মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার অবস্থান জানান দিতে পারবো।

Advertisement

জাগো নিউজ : জনবল ও যানবাহনের অপর্যাপ্ততা সত্ত্বেও মাদক নিয়ন্ত্রণে আপনারা কতটুকু সফল?

জামাল উদ্দীন আহমেদ : সক্ষমতা অনুযায়ী আমরা সফল। হয়তো প্রত্যাশা অনুযায়ী এবং মাদকের ভয়াবহতা বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা আমরা নিতে পারিনি। সেটা অসম্ভবও নয়। দরকার জনবল, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, অপারেশনাল অফিসারদের যথাযথ প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র। এসব পেলে আমরা সব সমালোচনার জবাব দিতে পারবো।

জাগো নিউজ : অধিদফতরের কর্মকর্তা বদলি ও বারের লাইসেন্স দেয়া নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ আছে। এটা কেন? আপনি বিষয়গুলো কীভাবে দেখেন?

জামাল উদ্দীন আহমেদ : অভিযোগ তো আসবেই। অভিযোগের সত্যতা পেলে আমরা ব্যবস্থাও নেই।কাজের দুর্বলতা থাকলেও আমরা ব্যবস্থা নেই।

বারের লাইসেন্স দেয়া, না দেয়ার প্রক্রিয়ায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কোনো প্রভাব নেই। আমরা তদন্ত করি। নিয়ম অনুসারে কোন কোন প্রতিষ্ঠান বারের লাইসেন্স পেতে পারে তা মন্ত্রণালয়কে জানাই। সিদ্ধান্ত মন্ত্রণালয়ই নেয়।

জাগো নিউজ : রাজধানীতে ইয়াবাসহ অন্য মাদকের ব্যবহার কেন নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না?

জামাল উদ্দীন আহমেদ : মাদকের ভয়াবহতা দেশের সবখানে। রাজধানীতে আরও বেশি। সম্প্রতি এটা আরও বেড়েছে। চাহিদা থাকলে সরবরাহও বেড়ে যায়। ডিএমপি’র একটা বিভাগে বেশ কয়েকটি থানা থাকে। থানায় থাকে আরও ৭০-৮০ জনবল। কিন্তু এক থানার জনবলই আমাদের উত্তর ও দক্ষিণ মেট্রো এলাকায় নেই। তাহলে পরিস্থিতিটা বুঝতে পারছেন। এরপরও কিন্তু আমরা কাজ করছি। পুলিশ, আনসার, এপিবিএনসহ বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতা নিয়ে মাদকবিরোধী অভিযান চালিয়ে যাচ্ছি।

জাগো নিউজ : অভিযোগ আছে প্রভাবশালী ও চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীরা প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না...

জামাল উদ্দীন আহমেদ : হাল আমলে আমরা বেশ কজন চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীকে ধরেছি। অনেকে এর আগে ধরা পড়েছে। তবে আইনি লড়াইয়ে তারা আদালত থেকে জামিন নিয়ে বেরিয়ে গাঢাকা দিয়েছে। আত্মগোপনে থেকে মাদক ব্যবসা করে যাচ্ছে। এ বছরই কমপক্ষে ৫০ গডফাদারকে গ্রেফতার করে আমাদের শক্তিমত্তার পরিচয় দেয়া হবে। শিগগিরই তাদের ধরা হবে। প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে কাউকে মাদক ব্যবসা করতে দেয়া হবে না- এ বিষয়ে আমরা বদ্ধপরিকর।

জাগো নিউজ : ঢাকার মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারায় পুলিশের কোনো ব্যর্থতা আছে কিনা?

জামাল উদ্দীন আহমেদ : এ বিষয়ে আমার মন্তব্য করা ঠিক হবে না। এতটুকু বলতে পারি, আমাদের অভিযানের সময় সহযোগিতা চাইলে পুলিশ তা দেয়।

জাগো নিউজ : মাদক সেবন বন্ধে কী কী সচেতনতামূলক কার্যক্রম নিয়েছেন। নিরাময় কেন্দ্রের শয্যা বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ আছে কী?

জামাল উদ্দীন আহমেদ : আমরা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সোশ্যাল মিডিয়া, পাড়া-মহল্লা ও কমিউনিটি প্রতিষ্ঠানগুলোতে মাদকবিরোধী প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি। আইন সম্পর্কে সবাইকে অবহিত করছি। মাদক নির্মূলে সর্বস্তরের জনগণের সহযোগিতা প্রয়োজন। এ বিষয়ে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।

জাগো নিউজ : ঢাকায় ১০৪টি অবৈধ সিসা বার বন্ধে আপনাদের কোনো তৎপরতা নেই, সমস্যাটা কোথায়?

জামাল উদ্দীন আহমেদ : সিসা বার বন্ধে আমরা উদ্যোগ নিচ্ছি। সিসা মাদকদ্রব্য হিসেবে ঘোষণা করা হলেও এখনও তা আইনের আওতায় আসেনি। এ কারণে আমরা কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছি না। আইনের আওতায় আসামাত্র আমরা ব্যবস্থা নেবো।

জাগো নিউজ : প্রধানমন্ত্রী মাদকের বিরুদ্ধে অভিযানে নামতে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। সেটা কি অধিদফতরের একার পক্ষে সম্ভব?

জামাল উদ্দীন আহমেদ : সফলতা জরুরি। মাদক নির্মূল অধিদফতরের একার কাজ নয়। বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটা নিয়ে আমরা কাজ করলেও আরও প্রতিষ্ঠান ও বাহিনী আছে, তারাও কাজ করছে। সবার সহযোগিতা পেলে, বিশেষ করে জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা গেলে মাদক নির্মূল সময়ের ব্যাপার।

জাগো নিউজ : অধিদফতরের কর্মকর্তাদের সক্ষমতা অর্জনে কী ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে?

জামাল উদ্দীন আহমেদ : কর্মকর্তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ৩০০ ফিট এলাকায় একটি ভবন নির্মাণ হচ্ছে। সেখানে দেশি-বিদেশি প্রশিক্ষকের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে।

জাগো নিউজ : নিরাময় কেন্দ্র বাড়াতে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে কি-না?

জামাল উদ্দীন আহমেদ : মাদকাসক্তরাও মানুষ। তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে প্রত্যেকটি বিভাগীয় শহরের পাশাপাশি জেলা শহরেও ৫০ শয্যার নিরাময় কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে। রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য ল্যাবরেটরি এবং মাদকবিরোধী অভিযানে অংশ নেয়া কর্মকর্তাদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও এ বছর চালু হবে।

এখন আমরা ৩২ ধরনের সেবা দিচ্ছি। আগামীতে এসব সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে অনলাইন ভিত্তিক এ সেবা চালুর উদ্যোগ নেয়া হবে।

জেইউ/এমএআর/আরআইপি