ক্যাম্পাস

একাডেমিক উন্নয়ন ও সেশন জট কমানো মূল লক্ষ্য : জাবি উপাচার্য

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববদ্যিালয়রে উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম ২০১৪ সালের মার্চ মাসের ২ তারিখে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান। সেই হিসেবে ২০১৮ সালের মার্চে মেয়াদকাল পূর্ণ হতে যাচ্ছে তার। দেশের প্রথম নারী উপাচার্য হিসেবে তিনি ইতোমধ্যে ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছেন।

Advertisement

প্রতিষ্ঠার পর থেকে ৪৮ বছরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাভাবকিভাবে মেয়াদকাল পূর্ণ করতে পেরেছেন খুব কম সংখ্যক উপাচার্য। সম্প্রতি অতীতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক উপাচার্যই শিক্ষক বা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে পদ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। তবে অধ্যাপক ফারজানার মেয়াদে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় তুলনামূলক স্থিতিশীল রাখতে পেরেছেন।বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকটকালীন সময়ে দায়িত্বগ্রহণ করে অস্থিতিশীল পরিবেশ থেকে স্থিতিশীল পরিবেশ ফিরিয়ে এনে শিক্ষাকার্যক্রম স্বাভাবিক করেছেন তিনি। নিজের অভিজ্ঞতার এ সব বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন জাগো নিউজের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে।

১. জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রী সমান হারে ভর্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এটা একটি ভালো উদ্যোগ। কিন্তু এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশের কোনো লঙ্ঘন হয়েছে কিনা?

অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম: অধ্যাদেশ অনুযায়ী যতগুলো সিট ততজনকে ভর্তি করতে হয়। এতদিন ছেলেদের জন্য বেশি আবাসিক হল ছিল তখন ছেলেদেরকে বেশি ভর্তি করা হত। মেয়েদের জন্য আবাসিক হল বেশি ছিল না, এখন মেয়েদের হল বেশি তাই মেয়েদের বেশি ভর্তি করানো হচ্ছে। এছাড়া আগামীতে ছেলে ও মেয়েদের জন্য আরো ৬টি আবাসিক হল নির্মাণ করা হবে, প্রত্যেকটি হল এক হাজার আসন সংখ্যার। তখন আরও বেশি ছেলে-মেয়ে ভর্তি করা হবে।

Advertisement

২. বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের রেজিস্টার্ড গ্রাজুয়েট প্রতিনিধি নির্বাচন ১৯ বছর ধরে বন্ধ ছিল। কিন্তু ১৯ বছর পর আপনি নির্বাচন দিয়ে গণতান্ত্রিক ধারা ফিরিয়ে এনেছেন। এটি আপনার বড় সফলতা। এক্ষেত্রে কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে?

অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম: অনেকেই নির্বাচনের ব্যাপারে প্রস্তুত ছিলেন না। নির্বাচন করা যাবে কিনা সে বিষয়েও অনেকেই প্রথমদিকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না এবং চিন্তিতও ছিলেন। কিন্তু যোগ্য রিটার্নিং অফিসার, নির্বাচন কমিশনারের জন্য এবং ওই সেলের সকল সদস্যের জন্য এই নির্বাচন বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছে। আমরা যেসব কিছুকে বাধা হিসেবে মনে করছিলাম সেগুলো সেভাবে হয়নি। ফলে সুষ্ঠু নির্বাচন বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছে।

৩. একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে কার ভূমিকা উল্লেখযোগ্য বলে মনে হয়?

অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম: এটি একটি টিমওয়ার্ক এখানে একজন প্রশাসকের নেতৃত্বে সবাই একসঙ্গে কাজ করে। যিনি নেতৃত্বে থাকেন তার অনেক গুণাবলী দিয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গ সংশ্লিষ্ট সকলকে নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে কাজ করতে হয়।

Advertisement

৫. বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার গুণগত মান ও গবষেণার উন্নয়নে আপনার উল্লেখযোগ্য অবদান কী? দায়িত্ব গ্রহণের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনার উল্লেখযোগ্য আবদান কী কী?

অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম: বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম সমাবর্তনের মতো অনেক বড় কাজ দিয়েই আমি আমার দায়িত্ব শুরু করেছি। ১০টি নতুন বিভাগ রেখে গেছেন প্রাক্তন উপাচার্য, এর মধ্যে অধিকাংশ বিভাগ যেমন, জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগসহ বিভিন্ন বিভাগের নির্দিষ্ট জায়গা ছিল না তাদের জন্য নির্দিষ্ট জায়গার ব্যবস্থা করেছি। এছাড়া যেসব বিভাগে পর্যাপ্ত শিক্ষকও ছিল না সেসব বিভাগে পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। নতুন বিভাগে অনেক ধরনের শিক্ষা সারঞ্জামের অভাব থাকে সেসবও পূরণ করার চেষ্টা করছি। বিজনেস স্টাডিজ অনুষদের সকল বিভাগের জন্য জায়গার ব্যবস্থা করেছি।

নতুন চালু হওয়া বঙ্গবন্ধু তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইনস্টিটিউট এবং ইনস্টিটিউট অব রিমোট সেন্সিংয়ের জন্য জায়গার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আইবিএর জন্য জায়গার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে যেটার খুব শিগগিরই নির্মাণ কাজ শুর করবে। পর্যাপ্ত পরিমাণে এসব নতুন বিভাগ ও হলে শিক্ষক ও অফিস স্টাফ নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

নতুন প্রশাসনিক ভবনের নির্মাণ কাজ শেষ করার ফলে যেসব অফিসের জন্য নির্দিষ্ট জায়গা ছিল না তারা তাদের জন্য জায়গা বরাদ্দ পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন গ্যারেজ বিশমাইলে স্থানান্তর করা হয়েছে। সিএসই ভবনের কাজ শেষ করা হয়েছে, জহির রায়হান মিলনায়তনের সেমিনার কক্ষ নতুন করে সংস্কার করা হয়েছে।

এছাড়া একাধিক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করেছি এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ‘রিসেন্ট অ্যাডভান্সেস ম্যাথমেটিক্যাল অ্যান্ড ফিজিক্যাল সায়েন্সেস’ বিষয়ক গাণিতিক ও পদার্থ বিজ্ঞান অনুষদের আয়োজনে আন্তর্জাতিক সম্মেলন, বাংলা বিভাগের আয়োজনে আন্তর্জাতিক বঙ্গবিদ্যা সম্মেলন, ইনস্টিটিউট অব রিমোট সেন্সিং এর আয়োজন জিওস্পাটিয়াল এ্যাপ্লিকেশন অব ডিসাস্টার ম্যানেজমেন্ট শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলন, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ভূগোল সম্মেলন। মুক্তি সংগ্রাম নাট্যেৎসব আয়োজন, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা প্রদান এবং ম্যাসব্যাপী ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস পালন, চারুকলা বিভাগে প্রথম বার্ষিক শিল্পকর্ম প্রদর্শনী এবং দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকা অমর একুশে ভাস্কর্যের সংস্কার কাজ প্রায় শেষ করেছি।

গবেষণার মান উন্নয়নে ইউজিসি থেকে গবেষণা বরাদ্দ বাড়িয়ে এনেছি। শিক্ষকরা গবেষণা খাতে এখন আগের চাইতে অনেক বেশি বরাদ্দ পাচ্ছেন। বিভিন্ন দেশের যেমন, চীন, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, কোরিয়া ও যুক্তরাজ্য সহ বিভিন্ন দেশের সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছে। লাইব্রেরি সপ্তাহে সাতদিন খোলা রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া সকাল ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত লাইব্রেরি খোলা রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিসি ক্যামেরার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

৬. বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের আসন সংকট পুরোপুরিভাবে নিরসন হয়নি ও অধিকাংশ শৌচাগারগুলো অকেজো রয়েছে। শৌচাগারে প্রবেশের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সিরিয়াল অনুসরণ করতে হয় যা খুবই দুঃখজনক ও বিব্রতকর। এতে শিক্ষার্থীরা খুবই ক্ষুদ্ধ। তা নিরসনের আপনার উল্লেখ্যযোগ্য উদ্যোগ কী?

অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম: লাইব্রেরিতে সিট সংখ্যা অনেক বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ডিজিটাল সার্ভে করে থ্রিডি মাস্টার প্ল্যান করা হয়েছে। এসব কিছুর মধ্যে লাইব্রেরি বাড়ানোর কাজটিও রয়েছে যা ইতোমধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাস হয়ে গেছে একনেকে পাস হলেই লাইব্রেরির বর্ধিত অংশের বাস্তবায়ন কাজ শুরু হবে। এসব কিছুর কারণে আমরা নতুন কাজ করতে পারিনি। লাইব্রেরির কাজ শুরু হলেই সকল দুর্ভোগ কমে যাবে।

৭. বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে বাণিজ্যিক ও সান্ধ্যকালীন কোর্স চালুর পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে যা সাধারণ শিক্ষা কার্যক্রমকে ব্যহত করছে। সাধারণ শিক্ষা কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে আপনার ভূমিকা কী? বাণিজ্যিক কোর্স চালুর কারণে শিক্ষকদের প্রতি সাধারণ শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ বাড়ছে বলে আপনি মনে করেন কি?

অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম: যেসব বিভাগ বাড়িয়েছে তার অধিকাংশই বাইরের দাবি বা চাহিদার প্রেক্ষিতেই বাড়িয়েছে। একজন প্রশাসন ও শিক্ষক হিসেবে আমি মনে করি একজন শিক্ষক সীমারেখা রেখা তার মূল কোর্সকে ব্যাহত না করে বাড়তি কোর্স নিতে পারেন। শিক্ষকদেরকে তাদের প্রধান বা মূল ছাত্রদের উপর দায়িত্ব বাড়াতে হবে যাতে এই জায়গায় প্রশ্নবিদ্ধ না হয়ে যায়। আগামীতে বাণিজ্যিক কোর্সকে একটি সুষ্ঠু সীমার মধ্যে রাখার চেষ্টা করব এজন্য শিক্ষকদের সাথে আমি কথা বলব।

৮.বহিরাগতদের আগমনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকার্যক্রম ও ক্যাম্পাসে বসবাসরত ছাত্র-শিক্ষক-কর্মকর্তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যহত হচ্ছে যা শিক্ষার্থীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশাসনের সমালোচনা করছে-এক্ষেত্রে আপনি কিভাবে দেখছেন বিষয়টি?

অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম: বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচুর পরিমাণে অতিথি আসে কারণ ঢাকার কাছাকছি এত সবুজ ও মনোরম জায়গা পাওয়া যায় না। আর প্রাক্তন ছাত্রদের এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে তাই চাইলেও প্রশাসন বাধা দিতে পারে না। তবে আমরা তাদেরকে গাড়ি পার্কিং করার ব্যবস্থা করে দিয়েছি তাদের গাড়ি ভিতরে আসতে দেওয়া হবে না। তাহলে এই সমস্যা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।

৯. সম্প্রতি উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের জন্য ১১ (১) ধারার বিভ্রান্তিমূলক ব্যাখ্যা সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কী?

অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম: সকল শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তাদের কাছে অনুরোধ করব আপনারা এই ধারা পড়ে দেখুন ও বুঝে দেখুন।

১০. শিক্ষার্থীদের অভিযোগ- শিক্ষকরা নিয়মতি রুটিন অনুযায়ী ক্লাস নেন না এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশন জট বেড়েছে এ বিষয়ে আপনার মতামত কী।

অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম: উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মো. আবুল হোসেন, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক অসিত বরণ পাল চেষ্টা করছেন এ সমস্যা সমাধান করার জন্য। এছাড়া যদি প্রত্যেক অনুষদের ডিন ও বিভাগের সভাপতি দায়িত্ব গ্রহণ করেন তাহলে এ সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হবে এজন্য আমরা কজ করে যাচ্ছি।

১১. আপনাকে পুনারায় উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলে আপনি প্রথমেই কী কাজ শুরু করবেন?

অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম: ব্যাঙের ছাতার মতো বাজার গড়ে উঠেছে যা নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। কিছুক্ষেত্রে চেষ্টা করলেও কতিপয় ব্যক্তির জন্য করতে পারিনি। কিন্তু পরবর্তীতে নির্বাচিত হলে এই বাজার বন্ধ করার চেষ্টা করব। বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি শান্ত ও শিক্ষার পরিবেশ বজায় রাখতে দল-মত নির্বিশেষে শিক্ষক ও ছাত্রের সহাবস্থান নীতির চর্চা করব এবং মূল কাজটি হবে একাডেমিক উন্নয়ন ও সেশন জট কমানো।

হাফিজুর রহমান/এফএ/জেআইএম