মতামত

বেছে নাও ক্যারিয়ার ভবিষ্যতের!

টিনএজ ফ্রাস্টেশনের অন্যতম প্রধান উৎস হচ্ছে নিজের ভবিষ্যতকে খুব একটা স্পষ্ট দেখতে না পাওয়া। বাবা-মা চাইছেন এক রকম, সেই রকমের সাথে মিলছে না নিজের পছন্দ। ওদিকে যে ক্যারিয়ার কপালে জুটবে তা দিয়ে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকা যাবে কি না, টিকে থাকতে পারবো কি না, ইত্যাকার নানান দৃশ্য টিনএজারের জীবনে বৈসাদৃশ্য ঘটিয়ে দেয়। ভাবনার হাত থেকে আপাততঃ মুক্তি পেতে অথবা ভাবনাকে এ্যায়সা কায়দায় ট্যাক্ল দিতে পারার মতো করে নিজেকে সুপার হিউম্যান ভাবতে টিনএজার তখন আশ্রয় খোঁজে মাদক কিংবা এরকম অন্ধকার চোরাগলিতে। বেচারার হাত ধরে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো সহানুভূতিশীল মানুষের তখন বড্ড অভাব পড়ে যায়। বাবা-মা নিজেরাই পরিণত হন সমস্যায়, সমাধান আর দেবেন কি!

Advertisement

এরকম কৈশোরের সাথে আজকাল প্রায়ই দেখা হয়ে যাচ্ছে। কী অসহায়ত্ব ঘিরে ধরেছে ওদের, কী অসহায় সময় পার হয়ে এসেছি আমরাও! সমাজ কেবলি বলে, নিজের পায়ে দাঁড়াও। বলে, লেখাপড়া করে যে গাড়িঘোড়া চড়ে সে। বলে, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হও। ‘বলেই খালাস’, এভাবেই খেদ ঝরে পড়েছিল ইমরানের কণ্ঠে। ওর ঠোঁটের কোণে ঝরে পড়া তিক্ত হাসির খোঁচা বলাবলির ঊর্ধ্বে পৌঁছে যেতে বলে। ‘হয়ে ওঠার অপশন খুব কম। যেন এর বাইরে আর কিছু হওয়া চলে না।’ এই রাগ ছিল মিথিলার।

ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-গাড়িঘোড়াওয়ালা ছাড়া আর হতে চাও? এরকম প্রশ্ন যখন করেছিলাম, ওর চোখে অসহায় দৃষ্টিশূন্যতা দেখেছি। আর কি হওয়া যায়? কেন কিছু হতে হবে? খুব দার্শনিক ছিল শুভ্র। বলছিল, ‘টাকাপয়সা কামানো খুব একটা কঠিন কাজ নয়। টাকাপয়সা কামানোর জন্য একটি ক্যারিয়ার বেছে নেব আর তাতে আমার মন শান্তি পাবে না, তেমন তো আমি চাই না।’

বলেছিলাম, মন-কে প্রশ্ন করো, মন কি চায়? না না, মন-কে প্রশ্ন করার কাজটি যেনতেনভাবে করলে হবে না। তোমার মন তোমার সাথে কখন কিভাবে দেখা দেয়, সেটা আগে জেনে নাও। কোন মন খোলা আকাশের নিচে মেলে ধরে নিজেকে। কেউ আবার নিঃশব্দ গাছের কাছে গেলে নিজেকে খুঁজে পায়। তুমি আাগে তোমার মনের মুখোমুখি হও। তারপর প্রশ্ন করো, কিসে তৃপ্ত হবে মন?

Advertisement

একবার নবারুণ পত্রিকা একগাদা শিশুকিশোরকে কাগজ-কলম ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল, কি হতে চাও লিখে ফেল। কেউ কেউ আকাশ হতে চাইল। কেউ চাইল পাখি হতে। কেউ গাছ। এরা খোলা আকাশ দেখে না, খোলা মাঠে ছোটে না। তাই কিছু হতে চাইতে গেলে মনটা চুপিচুপি বলেছিল, মুক্তি চাই। মুক্তি মানে আকাশ, গাছ, পাখি।

ক্লাস সেভেনে পড়া সেক্সপিয়ার সেদিন বলছিল, ও নাকি এমন এক গাড়ি বানাবে, যা কেউ এখনো দেখেইনি। গাড়ির প্রতি ওর ঝোঁক দেখে ওর মায়ের কপালে অসংখ্য ভাঁজ। কে ওকে গাড়ি বানানোর সুযোগ দেবে? কি হবে এই ছেলের? কি হবে ওর ভবিষ্যত?

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা গৎবাধা কিছু টিপ্স দিতে পারে, এমএ পাস করে সরকারি অফিসের পিওন পদে আবেদন জমা দিতেও কুণ্ঠিত অনুভব দেয় না। এভাবেই কেটে গেছে দিন, আমাদের দিন। কিন্তু, এভাবে চিরকাল যাবে না। দুনিয়া বদলাচ্ছে বলে বাংলাদেশ ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে ওঠার যুদ্ধে নেমেছে। আইডিয়ার সন্ধানে সরকারি অফিসে পর্যন্ত ইনোভেশন টিম গড়ে তুলে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে আইডিয়ার। পৃথিবীর সম্পদ কমে যাচ্ছে, আইডিয়া দিয়ে ন্যূনতম সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন ছাড়া টিকে থাকা যাবে না, এটা সরকারি পর্যায়ে বোধগম্যতা এলেও আপামর জনগোষ্ঠী কি বুঝতে পেরেছে? আমি বুঝেছি? আপনি বুঝেছেন? আমরা সবাই কি বুঝতে পেরেছি? আর কত সময় লাগবে আমাদের সবাইকে বুঝে ওঠার সমান পর্যায়ে আসতে?

আর তাই, যতো দিন যাচ্ছে টিনএজারের জীবনের আঁধার ততোবেশি গাঢ় হচ্ছে। একালের টিনএজারের উপর অভিযোগও আছে কম না। আমাদের কালে পৃথিবী চোখের পলকে কম্পিউটারের পর্দায় বা হাতের মোবাইলে হাজির হ’ত না। এখন হয়। মেকানিক্স বুঝতে পারছিলাম না বলে চোখের পানিতে খাতার পাতা ভিজিয়ে ফেলেছিলাম। এখন তো খান একাডেমি’র মতো অসংখ্য শিক্ষণীয় সাইট আছে না বোঝাকে বুঝিয়ে দিতে। এরপরও ইন্টারনেটকে শিক্ষা অর্জনের মাধ্যম হিসেবে না নিয়ে গৎবাধা ‘কোচিং সিস্টেম’ গিলছে কেন টিনএজার? কেন হতাশ হচ্ছে? ভবিষ্যতের ক্যারিয়ার, ক্যারিয়ারের ভবিষ্যত নিয়েও কি কম তথ্য আছে? কেন সেসব চেখে দেখছে না? ইন্টারনেট অনিরাপদ, সোজাসাপ্টা এ যুক্তি শুনতেও রাজি নই। নিরাপদ ইন্টারনেটকে কিভাবে চেনা যাবে, সেটা শেখার উপায়ও কিন্তু আছে ইন্টারনেটে।

Advertisement

বলছিলাম ভবিষ্যতের ক্যারিয়ার, ক্যারিয়ারের ভবিষ্যত নিয়ে কথা। মাইক্রোসফট-এর ওয়েবসাইটে একটি নিবন্ধ পড়ছিলাম। খুব বেশি দিন পরের ভবিষ্যত নয়, ২০২৫ সাল নাগাদ কোন্ কোন্ ক্যারিয়ার পৃথিবীর জন্য অত্যন্ত দরকারি হয়ে উঠবে, তাই নিয়ে তথ্য আছে ওখানে। ২০২৫ সাল নাগাদ ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি হয়ে উঠবে লাখ লাখ মানুষের সময় কাটানোর প্রধান ডিজিটাল স্পেস। ওখানেই তারা থাকবে, কথা বলবে, শিখবে, খেলবে এবং কাজ করবে। গোটা বিশ্বকে দেখতে চাইলে জানালা খুলে তাকানোর দরকার পড়বে না। অনলাইনে যে দুনিয়া, সেটাই আসল দুনিয়া, হয়ে যাবে এরকম সব। এর আভাস পাচ্ছি কিন্তু এখনি।

২০১৭ সালে ১ কোটি ২০ লাখ ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি (ভিআর) হেডসেট বিক্রি হয়েছে। ২০২০ সাল নাগাদ ভিআর প্রযুক্তির মার্কেট শেয়ার দাঁড়াবে বিশ্বব্যাপী ৪০ বিলিয়ন ডলার। আগামি দশকে স্মার্টফোনের জায়গা নেবে ভিআর প্রযুক্তি। তাই এই প্রযুক্তির দরকার পড়বে লাখ লাখ স্মার্ট তারুণ্যের, গত বছরই চীন প্রযুক্তিখাতের সেরা মেধাদেরকে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে খুঁজে নিয়ে ভিআর প্রযুক্তিতে লাগিয়ে দিয়েছে। ২০১৪ সালের সাথে হিসেব করলে ভিআর প্রযুক্তিতে দক্ষ জনবল চেয়ে করা চাকরির বিজ্ঞাপনের পরিমাণ বেড়ে গেছে ৮০০%। সব দেশ স্কুল-কলেজ-য়্যুনিভার্সিটিতে ভিআর প্রযুক্তি শিখিয়ে দক্ষ করতে চাইছে। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে বিশ্বে এই প্রথম শুরু হ’ল গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা কোর্স, অস্ট্রেলিয়ার ডিয়াকিন য়্যুনিভার্সিটিতে। একই সময়ে লুজিয়ানাতে ডিজিটাল মিডিয়া ইনস্টিটিউট থ্রিডি মডেলিং, টেক্সচারিং, অ্যানিমেশন এবং মোশন ক্যাপচারিং-এর উপর দু’টি কোর্স চালু হয়, যার উদ্দেশ্য হচ্ছে ছাত্রছাত্রীদেরকে স্থাপত্য, তেল-গ্যাস খাতে, রেলশিল্পে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও সামরিক বাহিনীতে খুব শিঘ্রি যে ভিআর প্রযুক্তি অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়বে, তাতে সুযোগ পেতে প্রস্তুত করা।

অনলাইন গেমিং থেকে শুরু করে সফটওয়্যার অ্যাপ্লিকেশনে দ্রুত জায়গা করে নেওয়া ভিআর প্রযুক্তি তৈরি করছে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের ক্যারিয়ার।

হতাশাগ্রস্ত টিনএজার ও তাদের বাবামায়ের এই রকম ক্যারিয়ার নিয়ে আগ্রহ কি জন্মাবে? হয়তো সোজা বাক্যটা উচ্চারিত হবে, আমরা কি পারব? ছাপোষা মধ্যবিত্তের অত এডভেঞ্চার দরকার নেই। সোজা-সাপটা একখানা চাকরি হলেই হবে। সরকারি চাকরি হচ্ছে প্রথম পছন্দ। ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে চমৎকার রেজাল্ট করে শিক্ষাজীবন শেষ করা এক তরুণের মা আমার সহকর্মী ছিলেন। তিনি খুব মন খারাপ করে বলছিলেন, ছেলে যে কী আবোল তাবোল বলে! সরকারি একটা চাকরি যদি হ’ত! এই ধরুন, অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার...!

কম্পিউটার সায়েন্স পড়া তরুণ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার পোস্টে আবেদন করেন, কোন্ চাপে করেন, তা বলাই বাহুল্য। এর পরও দেখা হয় বাঁধ ভেঙে দেওয়া তরুণদের সাথে। সেই ফ্যাশন ডিজাইনার তরুণ যেমন মায়ের কথা মতো নিজের গলা নিজে টিপে বসেননি। ফ্রিল্যান্সার আহমদ আকবর শুভ তৈরি করে দিয়েছেন ‘নবারুণ মোবাইল অ্যাপ’। সামাজিক নিরীক্ষণে তার এই কাজ কোন কাজ নয় বলে মানসিক চাপ নিতে হয়, সে কথাও জেনেছি তার কাছ থেকে। এতসব চাপ মেনে নিয়ে বাংলাদেশের তারুণ্য ফ্রিল্যান্সিং-এ বিশ্বের মাঝে প্রথম সারির দেশ হতে পেরেছে, তা কেবল এই অদম্য তারুণ্যের কৃতিত্বেই। কাজেই, ভয় করো না বন্ধু। বরং কণ্ঠ ছাড়ো জোরে!

লেখক : কথাসাহিত্যিক।

এইচআর/জেআইএম