জিম্বাবুয়ে এবং শ্রীলঙ্কা- গত দু’বছর এই দু’দলের পারফরম্যান্সের তুলনা করলে কাউকেই এগিয়ে রাখা সম্ভব নয়। তলানীতে যাচ্ছে দু’দলই। জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট তো হারিয়ে যাওয়ার একেবারে শেষ মুহূর্তে এসে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কাও ধীরে ধীরে নামছে তলানীতে। মাহেলা জয়াবর্ধনে আর কুমারা সাঙ্গাকারার বিদায়ের পর শ্রীলঙ্কা যেন ‘চুপসে যাওয়া বেলুন’। ঘুরে দাঁড়ানোর মন্ত্র এই দলটিকে কেউ ফুঁকে দিতে পারছে না।
Advertisement
যে কারণে, জিম্বাবুয়ের মত দল এসে শ্রীলঙ্কাকে তাদেরই মাটিতে ওয়ানডে সিরিজে ৩-২ ব্যবধানে হারিয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশ সিরিজ হারিয়ে আসতে না পারলেও টাইগারদের বিপক্ষে তারা জিততেও পারেনি। ভারত তাদের মাটিতে গিয়ে জিতে এসেছে ৫-০ ব্যবধানে। আরব আমিরাতের মাটিতে পাকিস্তান জিতেছে ৫-০ ব্যবধানে। ভারতের মাটিতে গিয়ে একটি ম্যাচ জিতলেও সিরিজ হেরেছে ২-১ ব্যবধানে।
টেস্ট ক্রিকেটে ওয়ানডের মত এতটা খারাপ হয়নি সত্য। কারণ, রঙ্গনা হেরাথের মত অভিজ্ঞ এক স্পিনার রয়েছে দলটিতে। যে কারণে, নিজেদের মাটিতে অস্ট্রেলিয়াকে ৩-০ ব্যবধানে হারিয়ে হইচই ফেলে দিয়েছিল অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউজের দল। তবে দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে ৩-০ ব্যবধানে হেরে এসেছে। নিজেদের মাটিতে বাংলাদেশের সঙ্গে ১-১ ড্র করতে হয়েছে। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে কোনমতে জিততে পেরেছে ঘরের মাটিতে। এরপর ভারত তাদের মাটিতে গিয়ে জিতে এসেছে ৩-০ ব্যবধানে। আরব আমিরাতে পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ জিতেছে ২-০ ব্যবধানে।
এরপর ভারতের মাটিতে গিয়ে ৩ ম্যাচের টেস্ট সিরিজ হেরেছে ১-০ ব্যবধানে। অর্থ্যাৎ ২টি ম্যাচই ড্র করতে সক্ষম হয়েছে তারা। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে এসে জিতেছে ২ ম্যাচের সিরিজ ১-০ ব্যবধানে। টি-টোয়েন্টির অবস্থা ওয়ানডের মতই। বাংলাদেশের বিপক্ষে নিজেদের মাটিতে ১-১ ব্যবধানে ড্র। এরপর নিজেদের মাটিতেই ভারতের কাছে ১-০ ব্যবধানে হার, আরব আমিরাতে পাকিস্তানের কাছে ৩-০ ব্যবধানে হার এবং ভারতের মাটিতে গিয়ে হেরেছে ৩-০ ব্যবধানে।
Advertisement
সব মিলিয়ে লঙ্কান ক্রিকেট আসলে পায়ের তলায় মাটি পাচ্ছিল না। এমনই এক মুহূর্তে সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের একজন মাত্র ব্যাক্তির প্রয়োজন ছিল। যিনি শুধু ‘সিংহে’র কানে ঢুকিয়ে দেবেন- তারা আসলেই সিংহের বাচ্চা। জাদুর কাঠির ছোঁয়া লাগাবেন। এরপরই ভোজবাজির মত বদলে যাবে সবকিছু। আগের সেই লড়াকু শ্রীলঙ্কার পূনর্জন্ম ঘটে যাবে। সেই জাদুরকাঁঠি ছোঁয়ানো ব্যাক্তির হাত ধরে আবারও লঙ্কানরা উঠে আসবে ‘ক্রিকেটের মূল ট্র্যাকে।’
একেবারে খাঁটি সময়েই তারা পেয়ে গেলো এমন একজন ব্যক্তির, যার খোঁজে ছিল শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট। চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। ২০১০ সালেই শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে লঙ্কান ক্রিকেট থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন যিনি। যদিও, তখন হাথুরুসিংহে ছিলেন সহকারী কোচ; কিন্তু শ্রীলঙ্কা হয়তো তখন খাঁটি জহুরীকে চিনতে ভুল করেছিল।
অবশেষে অস্ট্রেলিয়া ঘুরে চন্ডিকা হাথুরুসিংহে যখন বাংলাদেশে এসে সাফল্যের মালা একের পর এক পরে নিচ্ছেন, তখন পুরনো ইতিহাস ভুলে লঙ্কানরা আবারও দ্বারস্থ হয়ে গেলো হাথুরুসিংহের। নিজ দেশের আহ্বান, জন্মভূমির প্রতি টান এবং স্বদেশের জন্য কিছু করার সুযোগ পেলে কে ছাড়বে বলুন! হাথুরু তাই আর দেরি করলেন না। শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট বোর্ডের আহ্বানে সাড়া দিলেন সঙ্গে সঙ্গেই।
তাতে অন্য কারো সঙ্গে চুক্তি ভঙ্গ হয় তো হোক। সব কুচ পরোয় নেহি। নিজের দেশের জন্য হয়তো পেশাদার ক্যারিয়ারে কিছুটা কালিমা লেপন হয়েছে ঠিক; কিন্তু দেশের ডাকে তো সাড়া দেয়া গেলো! চন্ডিকা হাথুরুসিংহে লঙ্কান দলের দায়িত্ব নিলেন ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে। জানুয়ারির মাঝামাঝি আসলেন বাংলাদেশে। এখানেই যে তার প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট! সাবেক শিষ্যদেরই প্রথম প্রতিপক্ষ বানিয়ে নিলেন হাথুরুসিংহে।
Advertisement
এতে তার লাভ হয়েছে দুটি। এক, সাবেক শিষ্যরাই যেহেতু ত্রিদেশীয় সিরিজের প্রধান প্রতিপক্ষ- তাদের বিপক্ষে কিভাবে পরিকল্পনা সাজাতে হবে, প্রতিপক্ষের দুর্বলতা কোথায় কোথায়- সেটা একেবারে পয়েন্ট আউট করে নতুন শিষ্যদের দেখিয়ে দিয়েছেন তিনি এবং সে অনুযায়ী ঔষধও দিয়ে দিলেন। গুরুর শিক্ষা প্রথম দুই ম্যাচে কাজে লাগাতে পারেননি হাথুরুর শিষ্যরা। হয়তো শিক্ষাটা ভালোভাবে ধরতে পারেননি। যেই না ধরতে পারলেন, অমনি বদলে গেলো পুরো শ্রীলঙ্কা।
গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে বাংলাদেশকে ১০ উইকেটে হারানো দিয়ে শুরু। এরপর ফাইনালও জিতে নিলো লঙ্কানরা। টেস্ট সিরিজে চট্টগ্রাম টেস্টও তার সাজানো ছকেই এগুচ্ছিল সবকিছু। কিন্তু শেষ দিনে গিয়ে মুমিনুল আর লিটন কুমার দাস অবিশ্বাস্য ভালো খেলায় সে যাত্রায় কোনমতে রক্ষা পেলো বাংলাদেশ; কিন্তু ঢাকা টেস্টে বাংলাদেশের পরিকল্পনা যেন পুরোপুরি জানতেন হাথুরু। সে জানা থেকেই নিজের পরিকল্পনা এবং ছক সাজালেন। বাংলাদেশের ফাঁদকেই উল্টো পেতে দিলেন বাংলাদেশের জন্য। পরিকল্পনা পুরোপুরি সফল। আড়াই দিনেই হার টাইগারদের। হাথুরুর সাজানো পরিকল্পনার কাছেই হারলো বাংলাদেশ।
বলতে গেলে, লঙ্কান ক্রিকেটারদের মধ্যে নতুন কোন কিছুরই হয়তো উদ্ভাবন করেননি তিনি। শুধু একটা মন্ত্রই ফুঁকে দিয়েছেন, কিভাবে তারা পারবে। সেটাই কাজে লাগিয়েছে হেরাথ, আকিলা ধনঞ্জয়া কিংবা চান্ডিমালরা। হাথুরু যে একটা ভালো পরিকল্পনা করে নিজের যা শক্তি আছে সেটার সদ্ব্যবহার করতে জানেন এবং দারুণ প্রতিদ্বন্দ্বীতা গড়ে তুলতে পারেন- সেটা ভালোভাবেই দেখিয়ে দিয়েছেন এই টেস্ট সিরিজে।
হাথুরু নিজেই জানিয়েছেন সে কথা। ঢাকা টেস্ট জয়ের পর বাংলাদেশের মিডিয়ার সামনে কথা বলতে গিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে হাথুরু বলেন, ‘আপনাকে সব সময়ই ভালোভাবে তৈরি হতে হবে। দলের শক্তিমত্তা আপনাকে বুঝতে হবে। নিজের শক্তি বুঝেই পরিকল্পনা ও কৌশল সাজতে হবে। আপনি যদি ভালোভাবে তৈরি থাকেন ও নিজের শক্তি অনুযায়ী ভালো পরিকল্পনা থাকে, বলছি না সব জায়গায় সফল হতে পারবেন। তবে সব জায়গায় ভীষণ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দল হতে পারবেন।’
লঙ্কান দলের অভিজ্ঞ ক্রিকেটার, বিশ্বের অন্যতম সেরা স্পিনার রঙ্গনা হেরাথও মানছেন, হাথুরুর অধীনে পূনর্জন্ম হয়েছে শ্রীলঙ্কার। যদিও তিনি আরব আমিরাতে পাকিস্তানের বিপক্ষে ২-০ ব্যবধানে টেস্ট সিরিজ জয়ের প্রসঙ্গও টানছেন। তবে স্বীকার করেছেন, ভারতের বিপক্ষে একটা বাজে সিরিজ গিয়েছে। এরপরই তাদের লক্ষ্য ছিল, নতুন করে শুরু করার। সেটাই জানালেন হেরাথ।
একই সঙ্গে জানালেন, চন্ডিকা হাথুরুসিংহের প্রধান কোচ হিসেবে নিয়োগ দলের মধ্যে দারুণ পরিবর্তন এনে দিয়েছে। তা কারণেই আগের তুলনায় বিশাল পার্থক্য রয়েছে এই সিরিজে। হাথুরু সম্পর্কে হেরাথের মূল্যায়ন, ‘ক্রিকেট সম্পর্কে তার জ্ঞান এবং মেধা অনেক বেশি। সবচেয়ে বড় কথা, কাকে কোথায় কিভাবে ব্যবহার করবেন, সেটা তিনি খুব ভালোভাবেই জানেন। তিনি সব সময়ই চেষ্টা করেন একটি ভালো পরিবেশ তৈরি করার। যেটা খুবই ইতিবাচক। প্রতিটি মুহূর্তেই প্রতিটি বিষয়ে তারু সুক্ষ নজর থাকে।’
আইএইচএস/আরএস