সৌন্দর্য আসলে কি! আমরা সবাই সুন্দর হতে চাই! আমরা জানি যে, মানুষ মাত্রই সৌন্দর্যের পূজারী। জগতের সর্বত্রই সুন্দরের পরম লীলা চলছে। শুধু মানুষ নয় এমন কোন প্রাণি পাওয়াও দুষ্কর যার মধ্যে সৌন্দর্য চেতনা অনুপস্থিত। ছোট্ট বাবুই পাখি তার সুনিপুণ দক্ষতায় অসাধারণ নীড় তৈরি করে। তাই বলা যায়, সৌন্দর্য ভাবনা কিংবা সৌন্দর্য চেতনা সহজাত ধারণা।
Advertisement
সৌন্দর্যদর্শন বা নন্দনতত্ত্বের প্রধান আলোচ্য বিষয় হচ্ছে সৌন্দর্য। কিন্তু সৌন্দর্যকে কোন সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞায় আবদ্ধ করা কিংবা এর বিজ্ঞানভিত্তিক সার্বজনীন সংজ্ঞা প্রদান করা দুরূহ। কনফুসিয়াসের ভাষায়- ‘Everything has beauty, but not everyone sees it’. সৌন্দর্য কী, তা বর্ননা দিয়ে অপরকে বোঝানো যায় না, এটি অসংজ্ঞায়িত। সৌন্দর্য উপলব্ধির বিষয়, তাই এটি বুঝে নিতে হয়। বার্গমান এর মতে- ‘সৌন্দর্যের বস্তুগত সংজ্ঞা দেওয়া যায় না। সৌন্দর্যের অনুভূতি ঘটে শুধুমাত্র আত্মগতভাবে।’
গ্রিক মিথলজিতে সুন্দরের দেবতা ছিল নার্সিসাস। নিজের রূপ-লাবণ্যে সে এতই আত্মমগ্ন ছিল যে সবাইকে সে অপমান করত। কেউ একবার প্রেমের প্রস্তাব দিলে তাকেও সে অপমান করতো। ফলশ্রুতিতে একবার নেমেসিস নামের প্রতিশোধের দেবতা তাকে অভিশাপ দিলো, ভুলিয়ে পুকুর পর্যন্ত নিয়ে গেল তাকে। পুকুরের পানিতে নিজের প্রতিরূপ দেখে মুগ্ধ হয়ে উপভোগের নিমিত্তে সৌন্দর্য ছুঁতে ছুঁতে আত্মভোলা হয়ে আস্তে আস্তে সে ডুবে মারা যায়। সেই জায়গায় পরে সুন্দর এক ফুলগাছ জন্মে, যেটার নামকরণ করা হয় নার্সিসাস। নার্সিসাস শব্দের অর্থ সুন্দর। ধারণা করা হয়, এই সুন্দর থেকেই সৌন্দর্য, সৌন্দর্যতত্ত্ব, সৌন্দর্য ভাবনা প্রভৃতির যাত্রা শুরু।
সৌন্দর্যই আমাদের প্রেমের বা ভালোবাসার সূচনাকারী। যা সুন্দর তা-ই আমরা চোখের পলকে ভালোবেসে ফেলি। সৌন্দর্যের পূজারী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন- ‘সৌন্দর্য প্রধানত সামঞ্জস্য নির্ভর এবং এই সামঞ্জস্য শুধু সুন্দরের প্রতিটি অংশে নয়, সমস্ত জগতের সঙ্গে। ...সৌন্দর্য হৃদয়ে প্রেম জাগ্রত করিয়া দেয় এবং প্রেমই মানুষকে সুন্দর করিয়া তোলে।’ সুতরাং বলা যায় যে, সৌন্দর্যই প্রেমকে জাগিয়ে দেয়। যেখানে সৌন্দর্য আছে, সেখানে প্রেমও আছে। তাই সৌন্দর্য ও প্রেমের মধ্যে পারস্পরিক কার্যকারণ সম্বন্ধ রয়েছে।
Advertisement
নান্দনিক দিক থেকে সুন্দর বস্তুর পরিচয় হচ্ছে সৌন্দর্য, যার কোন কার্যকারণ নেই, কোন উদ্দেশ্য নেই, যা প্রয়োজন- অতিরিক্ত। সুন্দর সৌন্দর্য প্রকাশ করে। সুন্দরের পাশাপাশি অসুন্দরের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম, কেননা অসুন্দর হচ্ছে সুন্দরের উদ্বোধক। সুন্দর বৈধ ও আকর্ষণীয় অসুন্দরের কারণেই। সুন্দর ও অসুন্দরের পাশাপাশি অবস্থান, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া থেকেই নান্দনিক অনুভূতির সৃষ্টি হয়। আমরা যে রূপকথার রাজকন্যা, ট্রয়ের হেলেন বা শকুন্তলার কথা বলি তা হলো ‘আদর্শ সৌন্দর্যের’ প্রতীক, রূপকথার রাজপুত্র সেই সৌন্দর্যের সাধক। রূপকথার কাঠামো ও প্রতীকী যাত্রায় নন্দনতাত্ত্বিকের নিজস্ব যাত্রা ও পরিচয়টি লুকায়িত থাকে। নান্দনিক নিজেও রূপের মধ্য দিয়ে রূপের অতীতকে, অসুন্দরের মধ্য দিয়ে সুন্দরকে আবাহন করে থাকে। অর্থাৎ সুন্দরের পরিচয় সুন্দরের জন্যই। অসুন্দর যে অসুন্দর, সুন্দর নয় বলেই। সৌন্দর্যের অভাববোধকেই অসুন্দর বলা হয়। সুতরাং সৌন্দর্য প্রকৃতপক্ষে একটি মানসিক বোধ, যা জাগ্রত হয় ‘সুন্দরের’ সান্নিধ্যে।
সৌন্দর্য বিষয়টি সম্পূর্ণ আপেক্ষিক, যা স্থান-কাল-পাত্রভেদে পরিবর্তিত হয়। একজনের কাছে যা সুন্দর, অন্যজনের কাছে তা সুন্দর না-ও হতে পারে। আমার কাছে নুসরাত ফারিয়া সুন্দর, অন্যের কাছে তা না-ও হতে পারে। ভারতবর্ষের লোকজনের কাছে কালো হরিণ মায়াবী চোখ, কালো চুল সুন্দর কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বে নীল চোখ, সাদা চুল সুন্দর। ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি, জাতি, আবহাওয়া, সভ্যতা, সংস্কৃতি সৌন্দর্যের ভিন্ন ভিন্ন মানদণ্ড তৈরি করেছে। তবে নান্দনিকদের মতে, সৌন্দর্যবোধের তিনটি ধারা বা স্তর রয়েছে: চোখে ভালো লাগার জিনিস সুন্দর হতে পারে; প্রাণের ভালো লাগার জন্য এবং বুদ্ধির ভালো লাগার জন্য সুন্দর হতে পারে।
জগতের সর্বত্রই সৌন্দর্যের পরম লীলা চলছে। সৌন্দর্যের রস লাভ করতে হলে কঠোর সাধনার প্রয়োজন। সৌন্দর্য ধ্যানের বস্তু, অনুশীলনের দ্বারা সৌন্দর্য ভোগ ও তাকে অপরের ভোগ্য করে তোলার কৌশলটি আয়ত্ত করা যায়। ব্রহ্মচর্য, সংযম ও নিয়মনিষ্ঠার সাধনা করতে হবে, সংযমই সৌন্দর্যলোকে প্রবেশের সিংহদ্বার। আলস্য নয়, চৈতন্যের জাগ্রতদীপ্তিই জগৎ ও জীবন থেকে সৌন্দর্য গ্রহণ ও সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে পারে। মানবচেতনার পথ ধরেই মানব সংস্কৃতিতে সৌন্দর্য এসেছে, ভালোবাসা এসেছে। নান্দনিকদের মতে, সৌন্দর্য হচ্ছে পূর্ণতার প্রকাশ। যে প্রকাশে আমরা পূর্ণতা খুঁজে পাই তাকেই বলা হয় সুন্দর। এই পূর্ণতার উদ্ভব ঘটে তিনটি বিষয়কে কেন্দ্র করে: বস্তু, মন এবং অভিব্যক্তি (Expression)। বিশ্লেষণ করে দেখলে দুটি বিষয় লাভ করা যায়- একটি বস্তু আর দ্বিতীয়টি শিল্পীর মন, এই দুয়ের মিলনেই সুন্দরের সৃষ্টি।
সৌন্দর্য আত্মগত (Subjective) নাকি বস্তুগত (Objective) এটি শিল্পী ও নান্দনিকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কোন কোন নান্দনিকের মতে, সৌন্দর্যের নিজস্ব কোন মূল্য নেই, এটি পরতঃমূল্যে মূল্যবান। সৌন্দর্যকে আমরা আমাদের মন ও আত্মোপলব্ধির মাধ্যমে পাই। কবিগুরুর ভাষায়: ‘আমারই চেতনার রঙে পান্না হলো সবুজ, চুনী উঠল রাঙা হয়ে’ কিংবা ‘আমার মনের মাধুরী মিশায়ে, তোমারে করেছি রচনা’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুন্দরের প্রসঙ্গে বলেন যে, বস্তুজগত ও আত্মার জগতের মধ্যবর্তী সেতু হলো সৌন্দর্য-চেতনা। বস্তুজগতকে যখন আমরা মনের মধ্যে ধারণ করি তখন আমাদের আত্মিক চেতনার ভিত্তিতে তাকে একটি নতুন চেতনা দিয়ে গড়ে তুলতে চাই, তখনই শুরু হয় সৌন্দর্যের প্রতিষ্ঠা।
Advertisement
নান্দনিক বা শিল্পী তার নিজের মতো করে বিশ্বজগত সংসারকে দেখতে পেয়েছেন, নিজের কল্পনা ও ভাবনার দ্বারা জগতের রূপকে প্রত্যক্ষ করেছেন এবং সবার জন্য উপস্থাপন করেছেন। সৌন্দর্য এখানে ব্যক্তি নির্ভর, ব্যক্তির ভাবগত ধারণার উপর সৌন্দর্য নির্ভর করে। অর্থাৎ সৌন্দর্যের বিষয়টি আত্মগত। আবার কোন কোন নান্দনিকের মতে, সৌন্দর্য স্বতঃমূল্যে মূল্যবান। সৌন্দর্য বস্তু বা জিনিসের মধ্যেই অর্থাৎ বস্তুটাই সুন্দর, সুন্দর বলেই তা সুন্দর দেখা যায়। পূর্ণিমার চাঁদ কিংবা গোলাপ ফুল নিজেই সুন্দর। জিনিসটা সুন্দর বলেই আমরা সৌন্দর্য উপভোগ করে থাকি। এ মতাদর্শীরা সুন্দরের জন্য সুন্দর, শিল্পের জন্য শিল্প- এই তত্ত্বে বিশ্বাসী। এরা মনে করেন সংগীত, নৃত্য, শিল্প প্রভৃতির মাধ্যমে মানুষ সৌন্দর্যকে প্রকাশ করে এবং সৌন্দর্য স্বতঃমূল্যে মূল্যবান বলেই এগুলো আমাদের চিত্তকে আকৃষ্ট করে। দর্শনের বস্তুবাদ ও ভাববাদের মতো সৌন্দর্যদর্শনেও সৌন্দর্য আত্মগত নাকি বস্তুগত- সেই রহস্য উদ্ঘাটনে সমস্যা। সুন্দরের বস্তুগত মূল্যকে আমাদের যেমন স্বীকার করতে হবে ঠিক তেমনি আত্মগত মূল্যকেও স্বীকার করতে হবে। কোন বস্তুর সৌন্দর্য উদ্ঘাটন করার জন্য বস্তুটির মধ্যে যেমন সুন্দর গুণটি থাকা চাই, ঠিক তেমনি বস্তুর সৌন্দর্য উপলব্ধি করার মতো সুন্দর মন-মানসিকতাও আমাদের একান্তভাবে থাকা প্রয়োজন।
বিশ্বায়নের এই যুগে সমগ্র বিশ্ব আজ একটি গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হয়েছে। গ্লোবালাইজেশনের সাথে সাথে সৌন্দর্য বিষয়টি বাণিজ্যিকীকরণে পরিণত হচ্ছে। পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদী দেশগুলো পণ্য-উৎপাদন ব্যবস্থায় আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সৌন্দর্যকে বাণিজ্যিকীকরণের মাধ্যমে বুর্জোয়া অর্থনীতির আরো বিস্তৃতি ও বিকাশ ঘটিয়েছে। সৌন্দর্য ধারণাটির সঙ্গে সাদা-কালোর সম্পর্ক জুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সাদা বা উজ্জ্বল ফর্সাই সুন্দর, অভিজাত- এ ধারণা বিশ্বায়ন ও নব্যচিন্তাধারায় প্রচার করা হচ্ছে। মাত্র সাত দিনে উজ্জ্বল ফর্সা ত্বক, রং ফর্সাকারী ক্রিম, সাবানের ঘন মোলায়েম ফেনা ত্বককে করে সুন্দর আর উজ্জ্বল। বিশ্বজুড়ে তারকাদের সৌন্দর্য সাবান, ফুলের মতো কোমনীয় স্নিগ্ধ সতেজ ত্বকের জন্য কসমেটিক মেখে সহজেই বড় চাকরি পাওয়া ও বিয়ের বাজারে হিড়িক পড়া কিংবা স্টার হয়ে যাওয়া বিজ্ঞাপনগুলো সৌন্দর্যকে বাণিজ্যিকীকরণ করতে গিয়ে বিশ্ববাজারে পুঁজিবাদের হাতকে প্রসারিত করে।
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, সৌন্দর্য একটি অসংজ্ঞায়িত ধারণা যা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শ্রব্যরূপে হোক, দৃশ্যরূপে হোক বা বিশুদ্ধ কল্পনারূপে হোক আমাদের সত্তায় যুক্ত হয়। ভারতীয় দর্শনে সৌন্দর্য, সত্য ও মঙ্গলকে একীভূত করা হয়েছে। ‘সত্যম্, শিবম্, সুন্দরম্’- ভারতীয় দর্শনের এই তত্ত্বটি থেকে বোঝা যায় যে, সুন্দরের ধারণার মধ্যে এমন একটি মৌলিক এবং সহজাত সত্যবস্তু রয়েছে যে মঙ্গলবোধ তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আদর্শ সৌন্দর্যের আলোয় উদ্ভাসিত হোক জগতের প্রতিটি কর্ম। ১৯৩০ সালের ১৪ জুলাই বার্লিনে রবীন্দ্রনাথ ও আইনস্টাইনের মধ্যকার কথোপকথনের একপর্যায়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন: ‘আমাদের বিশ্ব শাশ্বত মানুষের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সামজ্ঞস্যপূর্ণ; এটাই আমরা ‘সত্য’ হিসেবে জানি এবং ‘সৌন্দর্য’ হিসেবে অনুভব করি।’ সৌন্দর্যচর্চা বা সৌন্দর্য ভাবনার মধ্য দিয়ে আমরা অসুন্দর থেকে সুন্দর, অমঙ্গলকে দূর করে মঙ্গল, দুর্নীতি থেকে সুনীতি, অসত্য থেকে সত্যে উপনীত হয়ে একটি সুখী, সমৃদ্ধ, মানবিক বিশ্ব প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হবো।
এসইউ/আইআই